Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ছোট্ট পিঠে বিদ্যের বোঝা ডেকে আনছে নানা রোগ

পিছন থেকে দেখলে মনে হবে যেন আস্ত একটা ব্যাগ হেঁটে যাচ্ছে। বহরে, উচ্চতায় সেই স্কুলব্যাগ এতই বড় যে, ঠিক করে সোজা হয়ে চলতেই পারে না ক্লাস সিক্সের লাবণ্য। বাড়ি ফিরে ব্যাগ নামিয়েই নেতিয়ে পড়ে।

ভারী সওয়ারি।— নিজস্ব চিত্র

ভারী সওয়ারি।— নিজস্ব চিত্র

মধুরিমা দত্ত
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:০২
Share: Save:

পিছন থেকে দেখলে মনে হবে যেন আস্ত একটা ব্যাগ হেঁটে যাচ্ছে। বহরে, উচ্চতায় সেই স্কুলব্যাগ এতই বড় যে, ঠিক করে সোজা হয়ে চলতেই পারে না ক্লাস সিক্সের লাবণ্য। বাড়ি ফিরে ব্যাগ নামিয়েই নেতিয়ে পড়ে। কয়েক বছর যেতে না যেতেই কাঁধে ব্যাগ নিতেই পারে না আর। প্রথমে ‘ফ্রোজেন শোল্ডার’ মনে হলেও পরে চিকিত্সকদের কাছে গিয়ে বোঝা গেল, অস্টিওপোরোসিস বাসা বেঁধেছে লাবণ্যর শরীরে।

কোমরে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছিল অদ্রির। মাঝেমধ্যেই ভয়ানক যন্ত্রণায় প্রায় শয্যাশায়ী। এক্স-রে করিয়ে ডাক্তাররাও থ। এত অল্প বয়সেই মেরুদণ্ড সামান্য বাঁ দিকে বেঁকে স্পন্ডিলোসিস ক্লাস টেনের ছেলের শরীরে।

ভারী স্কুলব্যাগের সঙ্গে বয়ে চলা এ সব রোগ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে— তা মানছেন চিকিত্সকেরাই। সমস্যার শিকড় এতটাই গভীরে যে তার আঁচ পৌঁছেছে খাস রাজ্যের শিক্ষা কমিশনেও। কমিশনের চেয়ারম্যান সমীর ব্রহ্মচারী বলছেন, ‘‘আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ করছি, সিলেবাসের বোঝা কমিয়ে খেলা, নাচ, গান, আঁকার মতো সহশিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হোক।’’

বেশ কয়েক বছর আগে সমীক্ষা চালিয়ে পড়ুয়াদের বয়স ও ওজনের সঙ্গে তাদের ব্যাগের ওজনের তালিকা তৈরি করে এক বেসরকারি সংস্থা। সেই সমীক্ষা অনুযায়ী প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়াদের ব্যাগের ওজন হওয়া উচিত ২ কেজি বা তার কম। একই ভাবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জন্য ৩ কেজি, পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৪ কেজি এবং নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ৬ কেজি। আদতে যার কোনওটাই হয় না।

বাড়তে থাকা এই বোঝার কারণটা ঠিক কী? পাঠভবন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সান্ত্বনা রায় জানান, অনেক সময়ে নির্দিষ্ট ক্লাস না থাকলেও ছেলেমেয়েরাই সেই বিষয়ের বই নিয়ে আসে। যাতে কোনও বিশেষ ক্লাস থাকলে বইয়ের অভাবে পিছিয়ে পড়তে না হয়। অভিভাবকদেরও একটা প্রচ্ছন্ন চাপ থাকে। তার থেকেও বড় হল, প্রতিটা বিষয়ের আলাদা খাতা। সঙ্গে জলের বোতল, টিফিন, ছাতার ওজন তো আছেই। সাধারণত প্রতিটি স্কুলেই দিনে সাত-আটটা ক্লাস থাকে। একটু উঁচু ক্লাস হলে বাড়ে বইয়ের আকার-ওজনও।

ক্লাসের সংখ্যা কমিয়ে কি বইয়ের চাপ কমানো যায়?

মেদিনীপুরের এক শিক্ষকের কথায়, ‘‘ক্লাস কমালে বহু ক্ষেত্রে অভিভাবকেরাই আপত্তি করেন। তাঁদের ধারণা, কম ক্লাস মানেই সন্তান পিছিয়ে পড়বে। এর কারণ মূলত হোম-ওয়ার্কের কাজ স্কুলেই আগেভাগে এগিয়ে রাখা। ফলে দেখা যায়, টি‌ফিনেও বাচ্চারা খেলাধুলো না করে ক্লাসে বসে পড়ছে।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার রুটিন বাঁধা নিয়মে ক্লাসের সংখ্যা কমালে সিলেবাস শেষ হবে না। আবার যদি সিলেবাস শেষ করতে হয়, তা হলে ক্লাসের সংখ্যা বাড়াতেই হবে।’’

পাঠ্যবই স্কুলেই রাখার জন্য পড়ুয়া পিছু লকার তৈরির বিকল্প পথ ভেবেছিলেন বেশ কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষ। এখনও শহরের নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোয় রয়েছে এই ব্যবস্থা। সান্ত্বনা রায় বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলে লকার তৈরির পরিকাঠামো নেই। তা ছাড়া এখন সরকারের দেওয়া বইগুলো আকারে বেশ মোটা। সেই বই বয়ে আনা সমস্যার।’’ লা মার্টিনিয়ার ফর বয়েজের প্রধান শিক্ষক সুপ্রিয় ধর বলেন, ‘‘একটু উঁচু ক্লাসের জন্য লকার ব্যবস্থা আছে আমাদের। প্রায় প্রতি পড়ুয়ারই দুটো করে বইয়ের সেট— একটা স্কুলে রাখে, অন্যটা বাড়িতে।’’

খাস কলকাতার প্রথম সারির স্কুলে এই ব্যবস্থা করা গেলেও জেলার পড়ুয়াদের অনেকেরই স্কুলের সব বই কিনে উঠতে পারাটাই রীতিমতো চিন্তার। বর্ধমানের এক শিক্ষক জানান, ‘‘যারা পাশ করে বেরিয়ে যায়, তাদের বলি বইগুলো পরের ক্লাসের জন্য দিয়ে যেতে। অনেক পড়ুয়া তো প্রতিটা বিষয়ের আলাদা খাতাও কিনে উঠতে পারে না।’’ তবে ভারী ব্যাগ বয়ে যে সব রোগ অল্প বয়সেই শরীরে বাসা বাঁধছে, সেগুলো আদতে ডেকে আনা রোগ বলে মনে করছেন শিক্ষকদেরই একাংশ।

তা হলে দায়ী কে?

টাকি বয়েজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক পরেশকুমার নন্দের দাবি, গলদটা আদতে শিক্ষাব্যবস্থায়। যা এ রাজ্যে ভীষণ অবৈজ্ঞানিক। পুঁথিভিত্তিক শিক্ষার বিকল্প ভাবতে গিয়ে সবাই ঘুরেফিরে সিলেবাসের জালেই বন্দি হয়ে যাচ্ছে। ‘‘বাচ্চার বিকাশ যে বইয়ের গণ্ডির অনেকটা বাইরে— তা অভিভাবক তো দূরস্থান, খোদ শিক্ষকদেরও ধারণায় নেই,’’ বলছেন তিনি। আর সুপ্রিয়বাবুর কথায়, ‘‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা রাতারাতি পাল্টানো সম্ভব নয়। বিদেশে ট্যাব বা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প়ড়াশোনা হচ্ছে। ব্যাগের গল্পই নেই। এখানে সেটা ভাবাই যায় না।’’ বিকল্পের খোঁজে শিক্ষকেরা অবশ্য আবারও জোর দিচ্ছেন খেলাধুলো এবং অন্য নান্দনিক বিষয়ে। এক শিক্ষকের আক্ষেপ, ‘‘এখন বহু স্কুলে বাচ্চাদের খেলার মাঠও নেই। যত বেশি বিকল্প পদ্ধতি দিতে পারব, ব্যাগ ভারী করে স্কুলে আসার প্রবণতা কমবে। পড়াশোনাটাও হতে হবে অনেকটা আলোচনামূলক।’’ ক্লাসে মোটা বই খুলে পড়ার চেয়ে নাটকে কোনও গল্পকে তুলে ধরা, বা ক্যুইজ শুধু যে শেখার পরিধিই বাড়ায়, তা নয়। ব্যাগভর্তি বই বওয়ার বদলে একটা সুস্থ বিকল্প পথও দেখায়— জানাচ্ছেন শিক্ষকরাই।

এ নিয়ে কী ভাবছে সরকার? রাজ্য সরকারের সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার জানান, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পড়াশোনার ভার কমানোর কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই আমরা সিলেবাসের বোঝা কমাতে শুরু করেছি। যত দিন যাবে, তত পড়ুয়াদের কথা ভেবে শিক্ষাব্যবস্থায় আরও বদল আনা হবে, যাতে তারা আরও আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারে।’’

ভবিষ্যতে যা-ই হোক, আপাতত স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ে বেশ চিন্তায় চিকিৎসকেরা। ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ রাজেশ প্রামাণিক বলেন, ‘‘যে কোনও স্কুলের সামনে দাঁড়ালে দেখা যায়, বাচ্চাদের হাঁটাচলার ধরনটাই বদলে গিয়েছে। সকলের মধ্যেই কমবেশি ন্যুব্জ ভাব। শরীরে হাড় ও তার সংযোগস্থলের মধ্যে একটা স্বাভাবিক ছন্দ কাজ করে। সংযোগস্থলে হঠাত্ চাপ আসতে থাকলে সেই ছন্দের তাল কেটে যায়।’’ চিকিৎসকদের মতে, ভারী ব্যাগ বইতে প্রাথমিক ভাবে কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু পরবর্তী কালে তার প্রভাব হতে পারে মারাত্মক। ছোট থেকেই বাচ্চাদের শারীরিক ভঙ্গিমা এমন বাঁকতে শুরু করে, যা বড় হয়ে ভয়ঙ্কর আকার নিতে পারে। অতিরিক্ত ভার নেওয়ায় হাড়ের সংযোগস্থলে ঘর্ষণ বাড়তে থাকে। তাতে বড় হয়ে হাড়ের ক্ষয় দেখা দেয়। হাড়ের বৃদ্ধি সঠিক ভাবে না হওয়ায় তা অস্বাভাবিক আকারও নিতে পারে।

হাড়ের বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে ভিটামিন ডি। তা একমাত্র মেলে সূর্যের আলোয়। রাজেশবাবুর প্রশ্ন, এখন বাচ্চারা মাঠে খেলেই না। গায়ে রোদ লাগবে কোথায়?

অস্থি বিশেষজ্ঞ তিলক মাল বলেন, ‘‘স্কুলে যাওয়ার সময়ে ভারী ব্যাগ বয়ে নিয়ে যেতে বাচ্চাদের তেমন আপত্তি থাকে না। কিন্তু স্কুল থেকে ফিরে শরীর জবাব দিয়ে দেয়।’’ ব্যাগের অতিরিক্ত ওজন মেরুদণ্ডে চাপ সৃষ্টি করে ঠিকই। তবে সমস্যা বেশি হয় পেশীর, জানান তিলকবাবু। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের বসা, দাঁড়ানো সবের একটা আদর্শ ভঙ্গিমা আছে, যা আমাদের ‘স্পাইন কার্ভেচার’ বা বক্রতা বজায় রাখে।’’ ব্যাগের ভারে তার ক্ষতি হয়।

শরীরের রোগ না হয় ওষুধে সারল। কিন্তু ব্যাগের ভারে ঝুঁকে যাওয়া শৈশব-কৈশোরের দাওয়াই কী? চিকিত্সক, শিক্ষক সকলেরই উত্তর— খোলা মাঠ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE