Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
হাসপাতালের হাল

ট্রলি পেতে টাকা কেন, ক্ষোভের চিঠি স্বাস্থ্য ভবনকে

আর জি করের স্ত্রী-রোগ বিভাগে এক আত্মীয়াকে ভর্তি করতে গিয়েছিলেন বরাহনগরের তাপস ধর। শয্যা মিলল, কিন্তু ইমার্জেন্সি থেকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার ট্রলি মিলল না! টানা আধ ঘণ্টা চেষ্টার পরে ১০০ টাকার বিনিময়ে হাসপাতালেরই এক কর্মী ট্রলি জোগাড় করে দিলেন বটে, তবে তার চাকা ভাঙা। হাতলের খানিকটা অংশও ভাঙা এবং জং ধরা। তাতে চাপিয়েই কোনও মতে ওয়ার্ডে পৌঁছনো হল। কিন্তু ট্রলি থেকে নামানোর সময়েই রক্তারক্তি কাণ্ড। ভাঙা অংশে হাত কেটে পাঁচটা সেলাই পড়ল তাপসবাবুর।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৪ ০১:০১
Share: Save:

আর জি করের স্ত্রী-রোগ বিভাগে এক আত্মীয়াকে ভর্তি করতে গিয়েছিলেন বরাহনগরের তাপস ধর। শয্যা মিলল, কিন্তু ইমার্জেন্সি থেকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার ট্রলি মিলল না! টানা আধ ঘণ্টা চেষ্টার পরে ১০০ টাকার বিনিময়ে হাসপাতালেরই এক কর্মী ট্রলি জোগাড় করে দিলেন বটে, তবে তার চাকা ভাঙা। হাতলের খানিকটা অংশও ভাঙা এবং জং ধরা। তাতে চাপিয়েই কোনও মতে ওয়ার্ডে পৌঁছনো হল। কিন্তু ট্রলি থেকে নামানোর সময়েই রক্তারক্তি কাণ্ড। ভাঙা অংশে হাত কেটে পাঁচটা সেলাই পড়ল তাপসবাবুর। দিন কয়েক পরে তা থেকে সেপটিকও হয়ে যায়। যা সারাতে খরচ হয় প্রায় ২৫ হাজার টাকা।

স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি লিখে তাপসবাবুর প্রশ্ন, বর্তমান স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় এটাই কি দস্তুর? রোগীকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে এলে অন্যেরা অসুস্থ হয়ে পড়বেন? কেন একটা ট্রলি পর্যন্ত পাওয়া যাবে না, কেন ডাক্তার-নার্সদের চোখের সামনে টাকার বিনিময়ে ট্রলি ভাড়া দেবেন হাসপাতালকর্মীরা? আর জি কর কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।

এক দিকে কোটি কোটি টাকা দামের যন্ত্রে সাজছে সরকারি হাসপাতাল। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন ভবন। তবু রোগী পরিষেবার ছবিটা যে পাল্টাচ্ছে না সাম্প্রতিক এই ঘটনা রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার সেই চিরন্তন সমস্যার দিকেই আরও এক বার আঙুল তুলে দিল।

আর জি করের এই ঘটনার কথা শুনে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, “এ তো মারাত্মক বিষয়। এ নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই তত্‌পর হতে হবে। এত বড় বড় হাসপাতালে একটা ট্রলি কেন পাওয়া যাবে না, সেই কৈফিয়ত তাঁদের দিতে হবে। আগেও বহু বার বলেছি। আবারও বলব।” বহু ক্ষেত্রে লোকাভাবের জন্য ট্রলি বিভিন্ন ওয়ার্ডে পড়ে থাকে, ফেরত আনার লোক থাকে না, তাই সমস্যা হয় বলেও জানান তিনি। তবে মূল সমস্যা যে সদিচ্ছার, মেনে নিয়েছেন সে কথাও।

ট্রলি পাওয়া নিয়ে এই সমস্যা অবশ্য শুধু আর জি করেই নয়। এসএসকেএম, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, নীলরতন সরকার, ন্যাশনাল, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ, মেদিনীপুর সর্বত্র ছবিটা একই। সর্বত্রই ট্রলি না পাওয়া নিয়ে একাধিক লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে প্রায় প্রতিদিনই। কিন্তু তাতে সমস্যাটা বদলায় না। ক’দিন আগে এসএসকেএমের অর্থোপেডিক ওটি থেকে তরুণী মেয়েকে পাঁজাকোলা করে ওয়ার্ডে ফিরিয়ে আনতে হয়েছিল হুমায়ুন রহমানকে। সেই সময়ে এক জায়গায় হোঁচট খান তিনি। তার জেরে ঝাঁকুনি পড়ে তাঁর মেয়ের শরীরেও। সদ্য অস্ত্রোপচারের পর ওই ঝাঁকুনির জেরে তাঁর অবস্থার যথেষ্ট অবনতি হয়েছিল। হাসপাতালে অভিযোগ জানিয়েছেন হুমায়ুনও।

স্বাস্থ্যকর্তারা স্বীকার করেছেন, কোথাও ৫০ টাকা। আবার কোথাও ১০০। ট্রলির ভাড়া আপাতত এটাই। শুধু টাকা খরচ করলেই হয় না। পরম ধৈর্য নিয়ে ওয়ার্ডবয়দের দুর্ব্যবহারও সহ্য করতে হয়। কোথাও কোথাও আবার শুধু ট্রলির টাকা নয়, ট্রলি ঠেলার জন্যও আলাদা ‘রেট’ রয়েছে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের। রোগীর বাড়ির লোকেরা তা মানলে ভাল, নচেত্‌ নিজেদের রোগীর ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হয়!

স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “এমনিতে ট্রলির দেখা মেলে না। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের টাকা দিলে নিমেষে ট্রলি হাজির হচ্ছে। বস্তুত, ট্রলিকে ঘিরেই একটা দুষ্ট চক্র তৈরি হয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালে। এটা ভাঙা জরুরি।” কোনও হাসপাতালেই ট্রলি মেরামতিতে নজর দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ। পরিবর্তে ট্রলি কেনার দিকেই কর্তাদের ঝোঁক বেশি। কিন্তু সেই নতুন ট্রলিও প্রয়োজনে পাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও উঠছে।

প্রশ্ন হল, এ সব অভিযোগের কোনওটাই তো নতুন নয়। তা হলে প্রতি বারই বিষয়গুলি সামনে আনা হলে স্বাস্থ্যকর্তারা কেন ‘ব্যবস্থা নেব’ জাতীয় মন্তব্য করেই দায় এড়ান? কেন বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও রোগীদের ন্যূনতম ভোগান্তি এড়ানোর দিকে তাঁদের নজর পৌঁছয় না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE