কারও আছে ঝুলি ভরা অভিজ্ঞতা। কারও কাছে আবার তৈরি পরিকাঠামো। কিন্তু সে সব নেওয়ার লোক কোথায়? ওঁদের সাহায্য নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের তরফে কোনও উদ্যোগই চোখে পড়েনি। অন্তত শুক্রবার পর্যন্ত।
অথচ এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত উত্তরবঙ্গ এখন কার্যত ‘নেই রাজ্য’। এনসেফ্যালাইটিস রোগ, তার চিকিৎসা পদ্ধতি, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত অভিজ্ঞ চিকিৎসক প্রায় নেই, যাঁরা স্থানীয় চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারবেন।
রোজ সংবাদপত্রে এই দুর্দশার কথা পড়ে উত্তরবঙ্গের প্রায় নাকের ডগায়, কাটিহারে বসে হাত কামড়াচ্ছেন দুই প্রবীণ চিকিৎসক। বিজয় মুখোপাধ্যায় ও মৃন্ময় ঘোষ। এনসেফ্যালাইটিসের সঙ্গে যুদ্ধে তাঁদের দু’-তিন দশকের অভিজ্ঞতা ওঁরা চিকিৎসকদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইছেন। কিন্তু রাজ্য সরকারের তরফে কোনও আমন্ত্রণ নেই। একই আক্ষেপ নিয়ে বসে আছেন বেলেঘাটার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ (নাইসেড)-এর চিকিৎসক-বিজ্ঞানী-কর্তাদের। দ্রুত রোগ নির্ণয়ের পরিকাঠামো হাতে থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার এখনও তাঁদের সাহায্যই নেয়নি। এনসেফ্যালাইটিস-সহ জীবাণুঘটিত রোগ নিয়ে চিকিৎসায় প্রায় ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ বিজয় মুখোপাধ্যায়ের। আটের দশকে বর্ধমান ও সংলগ্ন বাঁকুড়ায় হানা দিয়েছিল জাপানি এনসেফ্যালাইটিস। রোগটা তখন এই তল্লাটে প্রথম। তাই সমস্যা ছিল বেশি।
বিজয়বাবুর কথায়, “আমরা শেষে সফল হয়েছিলাম। কী ভাবে রোগটা ছড়াচ্ছে, তা ধরে নিয়ে আটকে দিয়েছিলাম সংক্রমণ। স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন থেকে তখন ভাইরোলজিস্ট মনীশ চক্রবর্তী, পতঙ্গবিদ অমিয় কুমার হাটি নিয়মিত আসতেন। আমরা এনসেফ্যালাইটিসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম তখন। এনসেফ্যালাইটিসের যে টিকা আছে, তার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয় আমাদের ওখান থেকেই।”
৬৭ বছরের ওই চিকিৎসকের আক্ষেপ, “এখন রোজ উত্তরবঙ্গের এনসেফ্যালাইটিস সংক্রমণের কথা পড়ছি আর কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু আমি তো নিজে থেকে যেতে পারব না।! রাজ্য সরকার যদি ডাকে যাব।”
আর এক প্রবীণ চিকিৎসক, কলকাতার আইডি হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ মৃন্ময় ঘোষ। তাঁর মনে পড়ছে ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আইডি হাসপাতলে এনসেফ্যালাইটিস, এডসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা। কথা প্রসঙ্গে বলছেন, কী ভাবে ফার্মাকোলজির বই ঘেঁটে ঘেঁটে ওই সময় তাঁরা জীবাণু-ভিত্তিক ওষুধ প্রয়োগ করতেন। উত্তরবঙ্গের অবস্থা দেখে মৃন্ময়বাবুর মন্তব্য, “আমাদের খুব খারাপ লাগছে। এত মানুষ মরছে। আমরা বিষয়টা জেনেও কিছু করতে পারছি না। আমরা এখন আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাকুরেও নই। ভিন্ রাজ্যে আছি। রাজ্য সরকার না ডাকলে যা-ই কী করে!”
স্বাস্থ্য ভবনের একাধিক কর্তা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেও মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ওই দুই অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়ার কথা বলার সাহসই পাচ্ছেন না। বৃহস্পতিবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী পরিকাঠামোর অভাবের কথা বলতে গিয়ে বারবার অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবের কথা বলেছেন। কিন্তু বিজয়বাবুর নাম তাঁর কানে তোলেননি কোনও স্বাস্থ্য-কর্তা।
উত্তরবঙ্গে রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রের ক্ষেত্রেও পরিকাঠামোজনিত অভাব আছে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল ছাড়া কোথাও জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু নির্ণয়ের পরিকাঠামো নেই। সেখানেও কিটের খামতি রয়েছে (মুখ্যমন্ত্রী এ দিন জানান, ওই হাসপাতালে কিট পাঠানো হচ্ছে)। মানুষকে সচেতন করার জন্য স্বাস্থ্য কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ারও পরিকাঠামো নেই স্বাস্থ্য দফতরের। কিন্তু যাদের কিট আছে, প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকাঠামো রয়েছে, সেই নাইসেডের সাহায্য নেয়নি রাজ্য।
কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা নাইসেডের অধিকর্তা শেখর চক্রবর্তী এ দিন বলেন, “সবে বৃহস্পতিবার কয়েকটা রক্তের নমুনা এসেছে। কিন্তু গোটা প্রক্রিয়ায় কী রোগ নির্ণয়ে, কী এলাকায় গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের সাহায্য করার জন্য রাজ্য সরকার আমাদের কাছ থেকে এখনও কোনও সাহায্য চায়নি। আমাদের যে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ভাইরাস চেনার যন্ত্র আছে, তা রাজ্য সরকারের জানা।”
নাইসেডের এক বিজ্ঞানীর আক্ষেপ, “ঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় না হওয়ার জন্য উত্তরবঙ্গে মানুষ মারা যাচ্ছেন, আর আমরা এখানে বসে হাত কামড়াচ্ছি। আমাদের কাছে রক্তের নমুনা পাঠালে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার রিপোর্ট আমরা দিতে পারি। আমরা পরিকাঠামো নিয়ে বসে আছি, অথচ রাজ্য আমাদের ডাকছেই না।”
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে সব সাহায্যের আশ্বাস দেন। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের অফিসারদের মধ্যে ঘন ঘন আলোচনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। এই অবস্থায় তাঁরা নাইসেডের সাহায্য নিচ্ছেন না কেন? রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব মলয় দে বলেন, “রাজ্যের বিশেষজ্ঞ অর্থাৎ স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন এবং মেডিক্যাল কলেজের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ গোড়া থেকেই নেওয়া হচ্ছে। বাইরের বিশেষজ্ঞ আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। সে ব্যাপারে রাজ্যের কোনও ভূমিকা নেই।”
কিন্তু ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া নিয়ে রাজ্য তো সব সময়েই নাইসেডের পরামর্শ নেয়। এ ক্ষেত্রে নেওয়া হল না কেন? মলয় দে বলেন, “আগামী সপ্তাহে নাইসেডের কাছে যাব।” একই বক্তব্য রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীরও। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য অবশ্য কোনও মন্তব্য করেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy