Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ব্যর্থ রাজ্য

ডাক্তার নেই, থমকে মোবাইল হেলথ ইউনিট প্রকল্প

শিল্পতালুক গড়ার জন্য বিভিন্ন রকম সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও শিল্পপতিদের টানতে পারছে না রাজ্য সরকার। ঠিক একই ভাবে টাকা হাতে নিয়ে বসে থেকে স্বাস্থ্য দফতর রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায় ‘মোবাইল হেলথ ইউনিট’ চালানোর জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে উৎসাহী করতে পারছে না।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:৪২
Share: Save:

শিল্পতালুক গড়ার জন্য বিভিন্ন রকম সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও শিল্পপতিদের টানতে পারছে না রাজ্য সরকার। ঠিক একই ভাবে টাকা হাতে নিয়ে বসে থেকে স্বাস্থ্য দফতর রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায় ‘মোবাইল হেলথ ইউনিট’ চালানোর জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে উৎসাহী করতে পারছে না।

রাজ্যের ৬টি জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় ১৯টি মোবাইল হেলথ ইউনিট চালানোর জন্য প্রায় ৮ মাস আগে আগ্রহী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার থেকে দরপত্র ডেকেছিল রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু দরপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা বার বার বাড়িয়েও আবেদনকারী পাওয়া যাচ্ছে না। ওই অঞ্চলগুলির মানুষের স্বাস্থ্য পরিষেবাও দেওয়া যাচ্ছে না।

যথেষ্ট টাকা পাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি মোবাইল হেলথ ইউনিটে আগ্রহ দেখাচ্ছে না কেন? সরকারের সঙ্গে কাজে কেন তাদের আপত্তি?

স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, ‘জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন’-এর নিয়মানুযায়ী, মোবাইল হেলথ ইউনিটে এমবিবিএস পাশ চিকিৎসক, ডিগ্রিপ্রাপ্ত নার্স-ল্যাব টেকনিশিয়ান-প্যাথোলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট, এক্স-রে টেকনিশিয়ান থাকতে হবে। এই লোকবল বিশেষ করে এমবিবিএস পাশ ডাক্তার জোগাড় করতেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে। কোনও ডাক্তার ওই সব দুর্গম এলাকায় গিয়ে ভ্যানে বা লঞ্চে-লঞ্চে ঘুরে বেড়াতে রাজি হচ্ছেন না। তুলনায় শহরে তাঁরা অনেক বেশি টাকায় আরামের কাজ পেয়ে যাচ্ছেন।

ডাক্তারের অভাব বা গ্রামে চিকিৎসকদের যেতে না চাওয়ার সমস্যা বহু পুরনো, যার জেরে জেলায়-জেলায় স্বাস্থ্য পরিষেবা চালাতে স্বাস্থ্য দফতরকে নাজেহাল হতে হয়। প্রশ্ন উঠেছে, সে ক্ষেত্রে যাতে আয়ুর্বেদিক, ইউনানি বা হোমিওপ্যাথ ডাক্তার দিয়েই কাজ চালানো যেতে পারে সে ব্যাপারে কেন্দ্রকে কেন অনুরোধ করছে না রাজ্য? কেন্দ্রে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের এক সচিব বলেন, “ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ডের মতো বেশ কয়েকটি রাজ্য আমাদের সঙ্গে কথা বলে অনুমতি নিয়ে আয়ুর্বেদ-ইউনানি ডাক্তারদের ছাড়পত্র দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সমস্যায় পড়লে তারাও আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে। নিয়ম শিথিল করা যেতে পারে।”

কিন্তু স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে এ ব্যাপারে বলেন, “আমরা চিকিৎসকদের মানের সঙ্গে আপস করতে চাইছি না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকেন বলে সেখানকার মানুষ এমবিবিএস ডাক্তারের পরিষেবা পাবেন না এটা কাম্য নয়। একই কারণে রাজ্যচালিত অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তারের অভাব সত্ত্বেও আমরা ইউনানি বা আয়ুর্বেদ ডাক্তার নিয়োগ করিনি। এটা অনেক বড় নীতি নির্ধারণের বিষয়। হঠাৎ করে নীতি পরিবর্তন করা যায় না। বরং কিছুদিন ধৈর্য ধরা যেতে পারে।”

স্বভাবত প্রশ্ন উঠেছে, কোনও পরিষেবা দিতে না-পারা আর এমবিবিএসের বদলে আয়ুর্বেদ বা ইউনানি চিকিৎসক দিয়ে অন্তত কিছুটা পরিষেবা দিতে পারার মধ্যে কোনটা কাম্য? এমবিবিএস ডাক্তারের অভাবে রাজ্যের নিজস্ব বেশ কিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ করতে হচ্ছে। আয়ুর্বেদ ও ইউনানি চিকিৎসকেরাও সরকার-স্বীকৃত। তা হলে কেন এঁদের কাজ চালানোর জন্য ব্যবহার করা হবে না?

মলয়বাবুর জবাব, “সব রোগের চিকিৎসা আয়ুর্বেদ বা ইউনানি পদ্ধতিতে হয় না। অস্ত্রোপচারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতেও সমস্যা হবে। তাই এই চিকিৎসকদের হেলথ ইউনিটে পাঠানোয় অসুবিধা রয়েছে। এমবিবিএস ডাক্তার আমরা নিয়োগ করছি। পাশাপাশি অর্থ দফতরের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে দরপত্রে একটি বা দু’টি আবেদন পড়লেও তা খোলা যেতে পারে। সেই চেষ্টা চলছে।”

যে ১৯টি মোবাইল হেলথ ইউনিট নিয়ে সমস্যা, তার মধ্যে মালদহে ছিল ৩টি, বাঁকুড়ায় ৪টি, জলপাইগুড়িতে ৩টি, পূর্ব মেদিনীপুরে ২টি, পশ্চিম মেদিনীপুরে ১টি, দার্জিলিং-এ ৪টি ও উত্তর দিনাজপুরে ২টি। কিন্তু শুধুমাত্র মালদহের একটি ইউনিটের জন্য তিনটি সংস্থার আবেদন জমা পড়েছে। বাকি ১৭টি কেন্দ্রের জন্য মাত্র একটি করে আবেদন জমা পড়েছে এবং দার্জিলিংয়ের একটি কেন্দ্রের জন্য একটিও আবেদন জমা পড়েনি। অন্তত তিনটি আবেদন জমা না পড়লে সেই দরপত্র খোলা যায় না। ফলে ১৯টির মধ্যে ১৮টি হেলথ ইউনিটের চালুর ব্যাপারে এগোতে পারছে না রাজ্য সরকার।

রাজ্যের এমন অনেক দূরবর্তী-দুর্গম এলাকা আছে যেখানে এখনও কাছাকাছি সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতাল নেই। সেখানকার মানুষদের স্বাস্থ্যপরিষেবা দিতে মোবাইল হেলথ ইউনিটই ভরসা। অর্থাৎ, ওই ব্লকগুলিতে ভ্যান বা লঞ্চে করে চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, প্যাথোলজিস্ট, ওষুধপত্র, এক্স-রে মেশিন প্রভৃতি নিয়ে গিয়ে পরিষেবা দেওয়া হয়। দরপত্র ডেকে এই ইউনিটগুলি চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে। তার বিনিময়ে সরকার থেকে তারা টাকা পায়। এই টাকা আসে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন’ থেকে, যা কেন্দ্র দেয় রাজ্যকে। এক-একটা মোবাইল ইউনিট চালানোর জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির জন্য বছরে প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। অর্থাৎ, এক সপ্তাহে ৬ দিন মোবাইল ইউনিট চালাতে দেওয়া হবে প্রায় ৬৬ হাজার টাকা।

রাজ্যে আপাতত এইরকম ৩২টি ইউনিট চালু রয়েছে। তার মধ্যে অন্তত ১৫টি ইউনিটের পরিচালক সংস্থা দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চাইছে। অনেক জায়গাতেই সপ্তাহে ৬ দিন ইউনিট চলছে না। এক সংগঠনের কর্তা মহম্মদ আব্দুল ওয়াহাব জানান, সরকার প্রতি ক্লিনিক হিসেবে পেমেন্ট করে। ধরা যাক এক দিন ক্লিনিকে বাকি সকলে এলেন কিন্তু ডাক্তার এলেন না। তখন সেই ক্লিনিক বাতিল বলে গণ্য হবে এবং টাকা মিলবে না। কিন্তু যাঁরা সে দিন হাজির ছিলেন তাঁদের টাকা তখন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে পকেট থেকে দিতে হবে। আরেকটি সংগঠনের তরফে নির্মাল্য মুখোপাধ্যায় জানান, গাড়ি ভাড়া, ডাক্তার-টেকনিশিয়ান ফি-ওষুধের দাম যা পড়ছে তাতে সরকারের দেওয়া টাকা যথেষ্ট হচ্ছে না।

তবে স্বাস্থ্য দফতরের কিছু কর্তা অবশ্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির অনাগ্রহের অন্য কারণ দেখিয়েছেন। গত এক বছর যাবৎ মোবাইল হেলথ ইউনিটের কাজকর্মের উপর স্বাস্থ্য দফতর নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছে। নিয়ম না-মেনে কেন্দ্র চালানোর জন্য এবং টাকাপয়সা নয়ছয়ের অভিযোগে ছ’ মাসের মধ্যে ৭টি কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কর্তাদের কথায়, সরকারি টাকায় আর বেনিয়ম করা যাবে না বুঝেই অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মোবাইল হেলথ ইউনিটের ভার নিতে চাইছেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parijat bandyopadhyay mobile health unit
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE