Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ডায়েরিয়া নিরাময়ে বড় বাধা মর্জিমাফিক ওষুধ খাওয়া

ডায়েরিয়া নিয়ে চিকিত্‌সকের কাছে যেতেই অ্যান্টিবায়োটিক দিলেন তিনি। ৮টি ক্যাপসুলের কোর্স। কিন্তু চারটি খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে যেতেই মাঝপথে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলেন রোগী। আবার ডায়েরিয়া শুরু হতেই রোগী বা তাঁর বাড়ির লোক আর ডাক্তারের কাছে না-গিয়ে নিজেরাই ওষুধের দোকান থেকে বহুল প্রচলিত কোনও অ্যান্টিবায়োটিক কিনে এনে কয়েকটি খেয়ে নিলেন। সে ক্ষেত্রেও নিয়ম মেনে ওষুধ খাওয়া হল না। অর্থাত্‌ অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ হল না।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৪ ০১:২৬
Share: Save:

ডায়েরিয়া নিয়ে চিকিত্‌সকের কাছে যেতেই অ্যান্টিবায়োটিক দিলেন তিনি। ৮টি ক্যাপসুলের কোর্স। কিন্তু চারটি খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে যেতেই মাঝপথে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলেন রোগী।

আবার ডায়েরিয়া শুরু হতেই রোগী বা তাঁর বাড়ির লোক আর ডাক্তারের কাছে না-গিয়ে নিজেরাই ওষুধের দোকান থেকে বহুল প্রচলিত কোনও অ্যান্টিবায়োটিক কিনে এনে কয়েকটি খেয়ে নিলেন। সে ক্ষেত্রেও নিয়ম মেনে ওষুধ খাওয়া হল না। অর্থাত্‌ অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ হল না।

অপ্রয়োজনে মুড়িমুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এবং কখনও তার ভুল ব্যবহারে সেরে উঠছে না ডায়েরিয়া। কারণ এই রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়াগুলির দেহে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি হতে শুরু করেছে। ফলে ওই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে আর ওই ব্যাক্টেরিয়া নির্মূল করা যাচ্ছে না। কয়েক বছর ধরে এ নিয়ে হুঁশিয়ারি দিচ্ছিলেন চিকিত্‌সক-গবেষকেরা। কয়েক মাস আগে সতর্কতা জারি করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও।

সেপ্টেম্বরে আমেরিকার একটি চিকিত্‌সা-জার্নালে (অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্ট্স অ্যান্ড কেমোথেরাপি) কলকাতার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজেস’ (নাইসেড)-এর কয়েক জন বিজ্ঞানীর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বেলেঘাটার বি সি রায় শিশু হাসপাতালের দেড়শোর বেশি শিশুর উপর একটি সমীক্ষা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, শিশুদের দেহে ডায়েরিয়া সৃষ্টিকারী একটি অন্যতম ব্যাক্টেরিয়া ‘ক্যামপাইলোব্যাক্টর জেজুনি’-র মধ্যে বহুল প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক ‘অ্যাজিথ্রোমাইসিন’-এর বিরুদ্ধে মারাত্মক ধরনের প্রতিরোধ-ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। অর্থাত্‌, অ্যাজিথ্রোমাইসিন দিয়ে আর ওই ব্যাক্টেরিয়াকে মারা যাচ্ছে না।

অন্যতম গবেষক আশিস মুখোপাধ্যায় জানান, দু’বছর ধরে ওই হাসপাতালে ডায়েরিয়া নিয়ে আসা শিশুদের উপর সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। তাদের মল থেকে ডায়েরিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়াগুলি পৃথক করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, সেগুলির মধ্যে ওই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে।

নাইসেড-এর বিজ্ঞানীদের মতে, পশ্চিমবঙ্গে শিশুদের ডায়েরিয়ার ৯% এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ডায়েরিয়ার ৪%-এর কারণ হল ‘ক্যামপাইলোব্যাক্টর জেজুনি’ ব্যাক্টেরিয়া। বিশেষত জন্মের পর থেকে ১১ মাস বয়সের মধ্যে এবং ২ থেকে ৫ বছরের শিশুদের ডায়েরিয়ার জন্য এই ব্যাক্টেরিয়া অনেকাংশে দায়ী। ফলে বহুলপ্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে এ হেন ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যে প্রতিরোধ তৈরি হওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে জানিয়েছেন চিকিত্‌সকেরা। তড়িঘড়ি তাই কেন্দ্রীয় গবেষণা কেন্দ্র নাইসেড বিষয়টি রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে জানিয়েছে।

নাইসেড-এর ডায়েরিয়া বিশেষজ্ঞ মিহির ভট্টাচার্য এবং টি রামমূর্তির কথায়, “কোনও একটি ব্যাক্টেরিয়ার জিনে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে এ রকম প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হলে একই গোত্রের অন্য ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যেও সেই প্রতিরোধ ক্ষমতা পরিবাহিত হতে পারে। সমস্যাটা সেখানেই। একের পর এক ব্যাক্টেরিয়া তখন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে মরবে না। রোগের মোকাবিলা করাই দায় হয়ে উঠবে।”

গ্যাসট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিত্‌ চৌধুরী, গোপালকৃষ্ণ ঢালিদের মতো অনেকেরই অভিযোগ, ‘অ্যান্টিবায়োটিক প্রোটোকল’ অমান্য করে অনেক চিকিত্‌সক চটজলদি রোগ সারিয়ে নাম পেতে ডায়েরিয়ার চিকিত্‌সায় ওআরএসের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তার ডোজ ঠিক থাকছে না। রোগীরাও ঠিকঠাক নিয়ম মেনে খাচ্ছেন না। অভিজিত্‌বাবু বা গোপালকৃষ্ণবাবুর কথায়, “অ্যান্টিবায়োটিকের অবৈজ্ঞানিক প্রয়োগে ক্রমশ অন্য ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যেও প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে। কমদামি, প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকগুলি এই ভাবে ব্যাক্টেরিয়ায় উপর কাজ না করলে সাধারণ রোগেও কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা খরচ করে দামি অ্যান্টি বায়োটিক দিতে হবে। তাতে রোগীর যেমন ক্ষতি হবে, তেমনই চিকিত্‌সাও জটিল হবে।”

স্বাস্থ্য দফতর বিষয়টি নিয়ে কী ভাবছে জানতে চাওয়া হলে স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “মাস চারেক আগে ‘ইন্টিগ্রেটেড ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’ সেল-এর চিকিত্‌সকদের তত্ত্বাবধানে অ্যান্টিবায়োটিকে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির উপর একটি সমীক্ষা শুরু করেছে স্বাস্থ্য দফতরও। প্রত্যেক মেডিক্যাল কলেজকে বলা হয়েছে, তাদের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ যেন নিয়মিত এ ব্যাপারে তথ্য পাঠায়। কিন্তু তার ভিত্তিতে কোনও নিয়ম বা ব্যবহারবিধি তৈরি করতে এখনও বেশ কিছুটা সময় লাগবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

antibiotics diarrhea parijat bandyopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE