পরীক্ষার পরে ৫৬৭টি ওষুধের মধ্যে খারাপ নমুনা মিলেছে মাত্র ৭টিতে। আর এই রিপোর্টকে হাতিয়ার করেই সরকারি হাসপাতালের ন্যায্যমূল্যের দোকানে বিক্রি হওয়া ওষুধের মানের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করে দিতে চাইছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর।
আড়াই বছর আগে রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে (পিপিপি মডেল) ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান চালু হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষকে কম দামে ওষুধ বিক্রি করা। কতটা কম? সরকারের দাবি, এখন ন্যায্যমূল্যের ৯৮টি দোকানে গড়ে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ‘ছাড়’ পাওয়া যায়। এখানেই প্রশ্ন তুলেছেন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক এবং বেসরকারি ওষুধ বিক্রেতাদের একটি বড় অংশ। তাঁদের মত, এত বেশি ছাড় দিয়ে কোনও ভাল মানের ওষুধ দেওয়া সম্ভব নয়। ন্যায্যমূল্যের দোকান থেকে অবিশ্বাস্য ছাড় দিয়ে যা বিক্রি করা হচ্ছে, তা আসলে আটা-ময়দার গোলা। এতে রোগীর ভাল হচ্ছে না।
নানা মহল থেকে বিভিন্ন সময়ে এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠায় ওষুধের মান খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য দফতর। তারা ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫৬৭টি নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য পাঠায় সরকারের ড্রাগ ল্যাবরেটরি এবং ভিন রাজ্যের আরও সাতটি বেসরকারি এনএবিএল (ন্যাশনাল অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড ফর টেস্টিং অ্যান্ড ক্যালিব্রেশন ল্যাবরেটরিজ)-স্বীকৃত পরীক্ষাগারে। যাবতীয় পরীক্ষায় মাত্র সাতটি ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে বলে দাবি সরকারের। এক কর্তার কথায়, “ওই সাতটি ওষুধের মান খারাপ মানে প্যাকেজিং-এ গোলমাল, ওষুধ গুঁড়ো হয়ে যাওয়া কিংবা ওষুধে জল ঢুকে নরম হয়ে গিয়েছে।” এই নমুনাগুলি দার্জিলিং জেলা হাসপাতাল, বারুইপুর ও পুরুলিয়া মহকুমা হাসপাতাল, হাওড়া জেলা হাসপাতাল ও শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। ওষুধগুলি যে ব্যাচের ছিল, ইতিমধ্যে সেই ব্যাচের সব ওষুধ রাজ্যের সব হাসপাতাল থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে, দাবি ওই কর্তার।
অভিযোগকারীরা অবশ্য সরকারি রিপোর্টকে গুরুত্ব দিতেই নারাজ। এসএসকেএমের মেডিসিনের এক অধ্যাপক বলেছেন, “ফলের কথা জানি না। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ওই ওষুধ খেয়ে রোগ সারবে না।” ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগের এক চিকিৎসকের কড়া প্রতিক্রিয়া, “গরিব রোগীদের ঠকিয়ে কম দামে ওষুধ দিয়ে সরকার বাহবা নিচ্ছে।” কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের এক অধ্যাপকের অভিযোগ, “সরকারের যে ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে, সেখানকার যন্ত্রপাতিও মান্ধাতা আমলের। দক্ষ টেকনিশিয়ানেরও অভাব। তাই এই রিপোর্ট নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।”
স্বাস্থ্যকর্তারা বলছেন, নমুনা পরীক্ষার পরে চিকিৎসক ও বেসরকারি বিক্রেতাদের অভিযোগ আর ধোপে টেঁকে না। স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে-র সাফ কথা, “যাঁরা ন্যায্যমূল্যের দোকানের ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সরকারি ডাক্তার। অভিজ্ঞতা এবং চিকিৎসা-সংক্রান্ত জ্ঞানের মাধ্যমে কোনও ডাক্তারবাবুর এটা মনে হতে পারে। কিন্তু সেটা মুখে বললে চলবে না, লিখিত চাই। কোনও চিকিৎসকই তা করেননি।” কিন্তু ন্যায্যমূল্যের দোকানের ওষুধের মান নিয়ে রোগীদের অভিজ্ঞতা কেমন? জবাবে স্বাস্থ্য দফতর ও বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, মান খারাপ বলে রোগীর তরফে অভিযোগ আসেনি। এসএসকেএম, ন্যাশনাল, বাঙুর, আরজিকর-সহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর পরিজনেরা বরং লিখিত ভাবে বার বার এই অভিযোগ করেছেন, ন্যায্যমূল্যের দোকান থেকে ওষুধ কিনতে তাঁদের নানা ভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
তা হলে চিকিৎসকেরা মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কেন? স্বাস্থ্য দফতরের বক্তব্য, ‘ব্র্যান্ডেড’ ওষুধ লিখে দিলে ভাল কমিশন পান ডাক্তাররা। পাশাপাশি, ন্যায্যমূল্যের দোকানের ওষুধ ভাল বিক্রি হওয়ায় মুনাফা কমছে বেসরকারি ওষুধ বিক্রেতাদের। তাই দু’পক্ষ একযোগে মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। কিন্তু পরীক্ষার পরে অনায়াসেই বলা যায়, তাঁদের অভিযোগ ঠিক নয়। প্রশ্ন উঠছে, বিতর্ক এড়াতে কেন কেন্দ্রীয় সরকারি কোনও বড় ল্যাবরেটরি থেকে ওষুধের নমুনা পরীক্ষা করা হল না? কলকাতাতেই তো কেন্দ্র পরিচালিত একটি ড্রাগ ল্যাবরেটরি রয়েছে। স্বাস্থ্যসচিবের ব্যাখ্যা, “কোনও ওষুধের মান নিয়ে ফৌজদারি মামলা চললে তখন নমুনা পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় সরকারের ল্যাবরেটরিতে। অন্যথায় নয়। স্বাস্থ্য দফতর কেন মাত্র ৫৬৭টি নমুনা পরীক্ষা করল? মলয়বাবুর উত্তর, “এটা প্রথম ধাপ। দফায় দফায় নমুনা পরীক্ষা করা হবে।”
কিন্তু ন্যায্যমূল্যের দোকান এত কম দামে ওষুধ দিচ্ছে কী করে?
স্বাস্থ্যকর্তাদের ব্যাখ্যা, ন্যায্যমূল্যের দোকান মূলত নামী সংস্থার ‘জেনেরিক’ ও ‘ব্র্যান্ডেড জেনেরিক’ ওষুধ বিক্রি করে। জেনেরিক, মানে যে ওষুধের উপরে শুধু ওষুধের রাসায়নিক গঠন লেখা থাকে। আর ব্র্যান্ডেড জেনেরিক মানে, নামী সংস্থাগুলি তাদের কিছু ওষুধ নিজেদের কারখানায় উৎপাদন না করে সরকার স্বীকৃত অপেক্ষাকৃত অনামী সংস্থার কারখানায় অন্য ব্র্যান্ড নামে উৎপাদন করে। দাম কম হওয়ার কারণ: l এই ধরনের ওষুধ উৎপাদকের থেকে সরাসরি ন্যায্যমূল্যের দোকানে আসে। মাঝে ডিস্ট্রিবিউটার এবং পাইকারি ব্যবসায়ী থাকে না বলে কমিশনের টাকা বেঁচে যায়। l এই সব ওষুধের কোনও বিজ্ঞাপন দেয় না উৎপাদনকারী সংস্থা। এতেও খরচ বাঁচে। l এই ওষুধের পরিচিতির জন্য মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ লাগে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy