সময়ে ‘ঠিক চিকিৎসা’ না হওয়ায় কেটে বাদ দিতে হয়েছিল কিশোরীর একটি হাত। দুই ডাক্তারের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে প্রায় দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের দাবি করেছিল ওই কিশোরীর পরিবার। শেষ পর্যন্ত মামলা চলাকালীনই ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে দিলেন অভিযুক্ত ডাক্তারেরা, সম্পর্কে যাঁরা বাবা-ছেলে।
২০১২-র ৫ মার্চ বিকেলে স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার পথে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে বাঁ হাতে চোট পেয়েছিল নদিয়ার হাঁসখালির মামজোয়ান শ্যামাচরণ বিদ্যাপীঠের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রিয়া হালদার। তাকে কৃষ্ণনগরের অর্থোপেডিক চিকিৎসক অভিজিৎ ঘোষের কাছে নিয়ে যান বাড়ির লোকেরা। রিয়ার মা আরতি হালদার বলেন, ‘‘চিকিৎসক বলেছিলেন, ‘হাত সেট হয়ে গিয়েছে। তাই আর অস্ত্রোপচার করতে হবে না’। প্লাস্টার না করেই বাড়ি পাঠিয়ে দেন তিনি। সাত দিন পরে আবার আসতে বলেন। কিন্তু যন্ত্রণা এতটুকু কমেনি।” ওই কিশোরীর হাতের অবস্থা যখন খুবই খারাপ, অভিজিৎবাবু অন্য একটি কাজে বাইরে চলে যান। চিকিৎসার দায়িত্ব দিয়ে যান তাঁর বাবা আর এক অর্থোপেডিক চিকিৎসক নির্মলকান্তি ঘোষকে। নির্মলবাবু অবশ্য কয়েকদিন চিকিৎসা করার পরে জানিয়ে দেন, অবস্থা ভাল নয়। কলকাতার সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। রিয়াকে তখন কলকাতার এসএসকেএম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করে তার পরিবার। পরীক্ষা করে সেখানে চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, হাতে পচন ধরেছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক। দ্রুত হাত কেটে বাদ দিতে হবে। রিয়াকে তার পরিবার চেন্নাইয়ের একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসকরা রিয়ার বাঁ হাত কনুই থেকে কেটে বাদ দিয়ে দেন। আরতিদেবীর আক্ষেপ, “চিকিৎসক ছেলে আর বাবার চরম গাফিলতিতেই আমার মেয়ের জীবনে এত বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল। যা কোনও দিন, কোনও ভাবে পূরণ করা সম্ভব নয়।’’
পরে রিয়ার পরিবার ওই দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে হাঁসখালি থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করার পাশাপাশি ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে ক্ষতিপূরণের মামলা করে। ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের সভাপতি প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও দুই সদস্য রীতা রায় চৌধুরী মালাকার এবং শ্যামল কুমার ঘোষের বেঞ্চে মামলা চলছিল এতদিন। রিয়ার আইনজীবী শুভাশিস রায় বলেন, ‘‘আমরা প্রায় দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলাম। চিকিৎসকেরা তার বিরোধিতা করে আইনি লড়াই করছিলেন। কিন্তু মামলা চলাকালীন শুনানির আগে ওই চিকিৎসকেরা আমাদের দাবি মতো দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। সেই মতো সম্প্রতি তাঁরা বিচারকের সামনেই চেকের মাধ্যমে টাকাটা দিয়েছেন।”
অন্যতম অভিযুক্ত চিকিৎসক নির্মলকান্তি ঘোষের বক্তব্য, ‘‘চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের যা বলার তা লিখিত ভাবে সংশ্লিষ্ট সকলকেই জানিয়েছি। তবে এটাও ঠিক, যে কারণেই হোক মেয়েটির চরম ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। যেটা বাঞ্ছনীয় নয়। তাই আমরা মামলা দীর্ঘায়িত না করে দাবি মতো টাকাটা দিয়ে দিলাম।’’
চিকিৎসকদের সর্বভারতীয় সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর রাজ্য সম্পাদক শান্তনু সেন অবশ্য বলছেন, “চিকিৎসা মহান পেশা। ডাক্তারেরা ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জনকে বাঁচান। এক জনের ক্ষেত্রে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ উঠলে তা বিচার করার জন্য মেডিক্যাল কাউন্সিল আছে। সে জন্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে যাওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। তাতে আলু-পটলের সঙ্গে চিকিৎসাকে গুলিয়ে ফেলা হয়।”
রিয়ার বাবা রবীন্দ্রনাথ হালদার দর্জির কাজ করেন। ‘বিচার’ চেয়ে কোথায় যাওয়া উচিত ছিল, আর কোথায় নয়জানা নেই তাঁর। তিনি বলেন, “লোকের কাছে চেয়ে-চিন্তে এতদিন মেয়ের চিকিৎসা করিয়েছি। প্রচুর টাকা দেনা হয়ে গিয়েছে। ভেবেছিলাম, মেয়েকে একটা কৃত্রিম হাত লাগিয়ে দেব। কিন্তু তা আর হয়ে উঠবে না’’
দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘‘আমার যে ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, টাকা দিয়ে তা পূরণ করা সম্ভব নয়। ওই চিকিৎসকেরা চরম শাস্তি পেলেই খুশি হতাম।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy