এক রোগিণীকে নগ্ন করে ঘরবন্দি করে রাখার ঘটনায় সাসপেন্ড হলেন পাভলভ মানসিক হাসপাতালের সুপার, ডেপুটি নার্সিং সুপার এবং বেড ইনচার্জ। গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্য দফতরের এক প্রতিনিধিদল ওই হাসপাতাল পরিদর্শনে যায়। তাদেরই দেওয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে সোমবার ওই তিন পদাধিকারীকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত জানায় স্বাস্থ্য দফতর। ১৪ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকায় এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পরেই বিষয়টি নিয়ে টনক নড়ে প্রশাসনের।
অন্য রোগিণীদের বিরক্ত করার অভিযোগে এক মাস ধরে নগ্ন অবস্থায় একটি ঘরে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল আঁখি নামের ওই রোগিণীকে। দিনে দু’বার সেই ঘরে শুধু খাবারটুকু পৌঁছে দেওয়া হত। বেরোতে না পারায় ওই ঘরেই আঁখিকে মলমূত্র ত্যাগ করতে হত। ঘটনাটি খবরের কাগজে বেরোনোর পরে স্বাস্থ্য দফতর, প্রতিবন্ধী কমিশন এবং রাজ্য মহিলা কমিশনের হস্তক্ষেপে আঁখির বন্দিদশা ঘোচে। পরে স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “মানসিক রোগীদের বন্ধ করে রাখার ভাবনাটা গোটা পৃথিবী জুড়েই এখন নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।” তবু কেন এ রকম করা হল, তার কারণ দর্শাতে বলা হয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।
আঁখির পাশাপাশি বিভিন্ন ওয়ার্ডের রোগীদের সঙ্গে কথা বলে কর্মীদের দুর্ব্যবহার, আধপেটা খেতে পাওয়ার মতো বিবিধ বিষয়ে অভিযোগ পান পরিদর্শকেরা। নিজেদের রিপোর্টে এ সব কথাও উল্লেখ করেছেন স্বাস্থ্য দফতরের ওই প্রতিনিধিরা।
স্বাস্থ্য সচিব মলয় দে জানান, মানসিক হাসপাতালগুলির অব্যবস্থা দূর করতে উদ্যোগী হয়েছেন তাঁরা। শুধু পাভলভ নয়, অন্যান্য মানসিক হাসপাতালগুলির পরিস্থিতিও ধাপে ধাপে খতিয়ে দেখা হবে। স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, এর আগে ছারপোকার কামড়ে রোগীদের অতিষ্ঠ হওয়ার ঘটনাও তাঁদের ভাবিয়েছিল। ছারপোকার ওষুধ ছড়ানো ঘরে এক রোগীকে বন্ধ করে রাখার ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পরেই পাভলভ সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হন তাঁরা। সেই সময়েই আঁখির খবরটি প্রকাশিত হয়।
রাজ্য মহিলা কমিশনের একটি রিপোর্টও অস্বস্তিতে ফেলেছে স্বাস্থ্য দফতরকে। কমিশন সূত্রের খবর, তাদের প্রতিনিধিরা পাভলভে গিয়ে দেখেছেন, মহিলা ওয়ার্ডের রক্ষী মত্ত অবস্থায় ডিউটিতে হাজির। রোগিণীদের থেকে জেনেছেন, রক্ষীর তরফে অস্বাভাবিক আচরণ নতুন ঘটনা নয়। এর পরেই রোগিণীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। কমিশনের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, নিয়মিত জল থাকে না মহিলা ওয়ার্ডের শৌচাগারে। ফলে বেশির ভাগ দিনই স্নানের সুযোগ থাকে না রোগিণীদের। তাই প্রায় সবার গায়েই খোসপাঁচড়া।
খাবারের নমুনা পরীক্ষা করেও চিন্তিত পরিদর্শকেরা। তাঁরা জানান, রোগীদের খাবারের মান ভয়াবহ। কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, পাভলভ পরিদর্শন করে তাঁরা হতাশ। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী নিজে মানসিক স্বাস্থ্যের হাল ফেরাতে যথেষ্ট সচেষ্ট। তার পরেও এই অবস্থা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কমিশনের তরফে এ বার থেকে নিয়মিত হাসপাতাল পরিদর্শনের ব্যবস্থা হবে।”
মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের তরফে সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, “সুপারকে বেশির ভাগ সময়েই হাসপাতালে পাওয়া যায় না। ডেপুটি নার্সিং সুপার নানা ভাবে রোগিণীদের ভয় দেখান, মানসিক অত্যাচার করেন। এর বহু প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। মানসিক হাসপাতালের হাল ফেরাতে সরকারকে সব রকম সাহায্যে আমরা প্রস্তুত।”
যে সব রোগী সুস্থ হয়ে গিয়েছেন, তাঁদের বাড়ি ফেরানোর ব্যাপারেও হাসপাতালের তরফে ন্যূনতম উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। কমিশনের সদস্যেরা জানান, পরিদর্শনে গিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ দু’জনের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেছেন। এক জন ইংরেজিতে স্নাতক এবং অপর জন মাধ্যমিক পাশ। হাসপাতাল তাঁদের বাড়ি পাঠাতে উদ্যোগী হলে এত দিনে জীবনের মূলস্রোতে ফিরে যেতেন তাঁরা।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, রোগিণীদের অন্তর্বাস কেনার জন্য ৫০ হাজার টাকারও বেশি খরচ দেখিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অভিযোগ, কোনও রোগিণীই অন্তর্বাস পাননি। লজ্জা নিবারণের পোশাকটুকুও বহু রোগিণী দিনের পর দিন পান না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy