Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সাহায্য ঘোষণা কেন্দ্রের

প্রসূতি ও শিশু মৃত্যুতে অতি সঙ্গিন রাজ্যের চার জেলা

প্রসূতি ও শিশু মৃত্যুর ক্ষেত্রে দেশের ১৮৪টি জেলাকে পিছিয়ে পড়া জেলা হিসেবে চিহ্নিত করল কেন্দ্রীয় সরকার। জেলাগুলির কোনও কোনওটিতে ওই মৃত্যু রোখার পরিকাঠামো নেই, কোনওটিতে আবার সব থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ তার নাগাল পান না।

সোমা মুখোপাধ্যায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৫ ০১:৫৭
Share: Save:

প্রসূতি ও শিশু মৃত্যুর ক্ষেত্রে দেশের ১৮৪টি জেলাকে পিছিয়ে পড়া জেলা হিসেবে চিহ্নিত করল কেন্দ্রীয় সরকার। জেলাগুলির কোনও কোনওটিতে ওই মৃত্যু রোখার পরিকাঠামো নেই, কোনওটিতে আবার সব থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ তার নাগাল পান না। এই জেলাগুলি যাতে কোনও ভাবেই গোটা দেশের অস্বস্তির কারণ না হয়ে ওঠে সেই কারণেই তাদের সব রকম সাহায্য করবে কেন্দ্র। বৃহস্পতিবার দিল্লিতে এক আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সম্মেলনে এই ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর কথায়: ‘‘এ ক্ষেত্রে কোনও মতপার্থক্য, রাজনৈতিক রং বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।’’

পিছিয়ে পড়া জেলার তালিকায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের চারটি জেলা। শুধু পিছিয়ে পড়া নয়, এই জেলাগুলিকে বলা হয়েছে, পিছিয়ে পড়ার মধ্যে পিছিয়ে পড়া। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের কর্তারা জানিয়েছেন, ওই চারটি জেলা হল উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অধিকর্তা সি কে মিশ্র জানিয়েছেন, প্রত্যেক জেলার জন্য এক জন করে ডেভেলপার নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি এবং তাঁর টিম সংশ্লিষ্ট জেলার খামতির দিকগুলি বুঝে নিয়ে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।

প্রসূতি ও শিশুমৃত্যু রুখতে ‘কল টু অ্যাকশন সামিট ২০১৫’ শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার। দু’দিনের এই সম্মেলনে বিশ্বের ২৪টি দেশের প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দাবি, এই প্রথম আমেরিকার বাইরে কোনও দেশে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল।

ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ‘আচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন মোদী। জানিয়েছিলেন, আমেরিকায় ‘ওবামা কেয়ারে’র মতো ভারতেও ‘মোদী কেয়ার’ চালু করতে চান তিনি। তাঁর সরকারের প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনের আমলে সেই কাজ কিছুটা শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরে তা ধামাচাপা পড়ে যায়। এ দিন মোদী বলেন, ‘‘সরকারের অন্যতম লক্ষ্য এখন প্রসূতি ও শিশু মৃত্যুর হার কমানো।’’ পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘প্রসূতি মৃত্যুর হার ১৯৯০-এ ছিল প্রতি লাখে ৫৪০। এখন সেটা ১৬৭। শিশুমৃত্যু প্রতি লাখে ১৯৯০-এ ছিল ১২৬। এখন তা কমে ৪৯। কিন্তু গোটা বিশ্বের নিরিখে এই হার আরও অনেক কম হওয়ার কথা। তাই আত্মতুষ্টির জায়গা তো নেই-ই, বরং আত্মসমালোচনার জায়গা রয়েছে প্রত্যেকটি রাজ্যের সামনেই।’’

এই আত্মসমালোচনার জায়গার সূত্র ধরেই ফের উঠেছে ওই ১৮৪টি জেলার প্রসঙ্গ। ফের সামনে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের নামও। কেন্দ্রের এই ঘোষণার পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অগ্রগতির ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাবতীয় দাবির পাশাপাশি এই পিছিয়ে পড়া তকমা কি সম্পূর্ণ বৈপরীত্যের আভাস দিচ্ছে না? পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরে রাজ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে প্রসবের হার বেড়েছে, সিক নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ) বেড়েছে। প্রসূতিকে হাসপাতালে পৌঁছনোর জন্য নিশ্চয় যান-এর ব্যবস্থা হয়েছে। তার পরেও প্রসূতি ও শিশুমৃত্যু রোধের ক্ষেত্রে কেন উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাচ্ছে না রাজ্য?

জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন সূত্রের খবর, রাজ্যের ওই চারটি জেলার ক্ষেত্রে লেবার রুমের অপরিচ্ছন্নতা, বার্থ অ্যাসপেক্সিয়া (জন্মের সময়ে শিশুর অক্সিজেনের অভাব) রুখতে প্রশিক্ষিত কর্মী এবং সরঞ্জামের অভাব, প্রতিষেধক টিকা সরবরাহে ঘাটতি এবং বাড়ি থেকে হাসপাতাল পৌঁছনোর সময়ে পথের দুর্গমতাই মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বস্তুত লেবার রুমের অপরিচ্ছন্নতা এ রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে বরাবরই একটা বড় সমস্যা। চারপাশে ছড়িয়ে থাকে আবর্জনা। যে ট্রলিতে প্রসূতিকে শোওয়ানো হয়। সেই ট্রলিতে তাঁর আগের জনের রক্ত লেগে থাকে। বার্থ অ্যাসপেক্সিয়া ঠেকাতে ন্যূনতম সরঞ্জাম বা প্রশিক্ষিত কর্মীর ব্যবস্থা থাকে না। তার উপর যাতায়াতের অব্যবস্থা তো রয়েছেই। নিশ্চয় যানের ব্যবস্থা কাগজে-কলমে থাকলেও বহু ক্ষেত্রে প্রয়োজনের সময়ে পাওয়া যায় না। আবার কখনও পাওয়া গেলেও চালক তার জন্য বাড়তি অর্থ দাবি করেন।

রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘মালদায় এমন অনেক গ্রাম রয়েছে যেখান থেকে হাসপাতালে পৌঁছতে নদী পেরোতে হয়। বাড়ি থেকে ফেরিঘাটে পৌঁছতে কোনও যানবাহন নেই। সে ক্ষেত্রে প্রসূতিকে খাটিয়ায় শুইয়ে কয়েক জন খাটিয়া বয়ে নিয়ে যান। রাস্তার ওই ঝাঁকুনিতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মারা যান বহু প্রসূতি।’’

প্রধানমন্ত্রীর কথার সূত্র ধরে এ দিন কলকাতায় রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, এই সমস্যাগুলি দূর করতে আমরাও চেষ্টা চালাচ্ছি। এক দিনে সব হওয়ার কথা নয়। লেবার রুমের অপরিচ্ছন্নতা একটা বড় সমস্যা, তা আমরাও জানি। সেই কারণেই ৩১ সদস্যের লেবার রুম মেন্টর গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে বেশ কিছু দিন আগেই। প্রত্যেকের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করা আছে। তাঁরা প্রত্যেক হাসপাতালের লেবার রুমগুলি ঘুরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

এ দিনের অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জগৎপ্রকাশ নাড্ডা বলেন, ‘‘বড় কাজগুলি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ছোট ছোট কাজের ক্ষেত্রে এখনও হেরে যাচ্ছি আমরা। দেশ থেকে পোলিও নির্মূল করা গিয়েছে। কিন্তু ডায়েরিয়া বা নিউমোনিয়ায় মৃত্যু আটকানো যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিষেধক দিয়ে আটকানো সম্ভব এমন মৃত্যুর হার কমছে না। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এই মৃত্যু শূন্যয় নামিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর আমরা।’’

প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘‘এই প্রকল্পের নাম ইন্দ্রধনুষ। টিকাকরণ প্রক্রিয়া ১০০ শতাংশ হয়ে যাবে এই প্রক্রিয়া সফল হলেই। তবে শুধু স্বাস্থ্য দফতরের একার চেষ্টায় এটা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ, নারী ও শিশুকল্যাণ সব দফতর এক
যোগে কাজ করলে তবেই লক্ষ্যপূরণ সম্ভব।’’ সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলিতে পোলিও নির্মূল করার জন্য ভারত সব রকম সাহায্য করবে বলে জানান মোদী। পাশাপাশি তাদের পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিনও সরবরাহ করা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE