Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বেড়াল থেকে জুতো, সংক্রমণই সঙ্গী অগ্নিদগ্ধের

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র কাজ না করায় জানালা খোলা। এক শয্যার সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে অন্যটি। জুতো পরেই ওয়ার্ডে অবাধে যাতায়াত করছেন রোগীর পরিজনেরা। রোগীর বিছানাতেও বসছেন যখন-তখন। প্রতি মুহূর্তে সংক্রমণের ভয় নিয়ে এভাবেই চলছে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট।

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মেঝেতে পড়ে রোগী। —নিজস্ব চিত্র।

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মেঝেতে পড়ে রোগী। —নিজস্ব চিত্র।

সৌমেন দত্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৫ ০১:২৮
Share: Save:

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র কাজ না করায় জানালা খোলা। এক শয্যার সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে অন্যটি। জুতো পরেই ওয়ার্ডে অবাধে যাতায়াত করছেন রোগীর পরিজনেরা। রোগীর বিছানাতেও বসছেন যখন-তখন। প্রতি মুহূর্তে সংক্রমণের ভয় নিয়ে এভাবেই চলছে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট।

এমনিতেই কাটোয়া, কালনার কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তার উপর বর্ধমান মেডিক্যালের ৩০ শয্যার এই ওয়ার্ডেও প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো পাচ্ছেন না রোগীরা। ফলে এক দিকে ওয়ার্ডের মেঝেতেই পড়ে থাকছেন গ্যাসের সিলিন্ডার ফেটে আহত তরুণী। অন্য দিকে বিছানার নীচে বেড়াল নিয়ে আতঙ্কে রাত কাটাতে হচ্ছে রোগীদের। এ ছাড়া বার্ন ইউনিট থাকলে, সাধারণত স্কিন গ্রাফটিং, প্লাস্টিক সার্জারির ব্যবস্থা থাকে সেখানে। আলাদা আইটিইউ-ও থাকে। কিন্তু বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এ সবের কোনও বালাই নেই। ফলে রোগীর অবস্থা খারাপ হলে কলকাতার কোনও সরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা ছাড়া উপায় থাকে না। আর সে সময় না থাকলে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ছাড়া কার্যত কোনও উপায় থাকে না।

বর্ধমান জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তাও বলেন, “পোড়ার চিকিৎসা তিন ধাপে হয়। প্রথমত ‘শক’ কাটানো। দ্বিতীয়ত, সংক্রমণ ঠেকানো। তৃতীয়ত, রেনাল ফেলিওর আটকানো। পরের ধাপে প্লাস্টিক সার্জারির প্রয়োজন। জেলা স্তরেও প্লাস্টিক সার্জারির পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি, সেখানে মহকুমাস্তরে দূর অস্ত।’’

হাসপাতালে গিয়েও দেখা যায়, জরুরি বিভাগের চার তলায় রয়েছে বার্ন ইউনিটটি। তবে সেখানে শয্যা খালি থাকলেও জরুরি বিভাগের পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ড থেকে রোগী বার্ন ইউনিটে সব সময় পাঠানো হয় না বলে অভিযোগ। ওয়ার্ড ঘুরেও দেখা যায়, জেলার নানা প্রান্তের বেশ কয়েকজন অগ্নিদগ্ধ মানুষ সাধারণ রোগীদের সঙ্গে রয়েছেন। মহিলা ওয়ার্ডে আবার গ্যাসের সিলেন্ডার ফেটে শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে যাওয়া এক তরুণী মাটিতেই পড়ে রয়েছেন। খণ্ডঘোষের বোঁয়াইচন্ডী এলাকার বাসিন্দা, ওই তরুণীর পরিজন সোনামনি কাজির অভিযোগ, “দেখতেই তো পাচ্ছেন কী অবস্থা! তার উপর চারিদিকে বেড়ালের উৎপাত। রোগীকে দেখব না, বেড়াল সামলাব বুঝতেই পারছি না।”

কাগজে-কলমে কাটোয়া, কালনা-সহ জেলার অন্য মহকুমা হাসপাতালে এবং হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পোড়া রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা বলছে, মহকুমা হাসপাতালগুলি থেকে ৫০ শতাংশের বেশি অগ্নিদগ্ধ রোগীকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি পুলিশের ঝামেলা এড়াতে রোগীর পরিজনদের হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেয় সচরাচর। কিন্তু বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটেও শয্যার সংখ্যা সীমিত। ফলে অনেক সময় বার্ন ইউনিটে ভর্তির সুযোগ পান না রোগীরা। আবার শয্যা ফাঁকা থাকলেও হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সেরা বার্ন ইউনিটের কথা রোগীর পরিজনেদের জানান না বলেও অভিযোগ। যেমন হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি হাটশিমুল গ্রামের সুজিত ঘড়ুই জানান, বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন, কিন্তু সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা নার্সরা বার্ন ইউনিটের কথা জানাননি তাঁকে। ফলে দগ্ধ অবস্থায় সাধারণ ওয়ার্ডেই থাকতে হচ্ছে তাঁকে। মুশকিল বাড়ছে আরও বহু গুণ। বর্ধমান তো বটেই পাশের বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এমনকী ঝাড়খণ্ডের একটা বড় অংশের বাসিন্দারাও এই সমস্যায় ভোগেন বলে অভিযোগ।

অগ্নিদগ্ধের চিকিৎসার খরচ নিয়েও নাকাল হন পরিবারের লোকেরা। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থেকেও হাজার হাজার টাকার ওষুধ কিনে দিতে হয় বলে তাঁদের অভিযোগ। চিকিৎসকদের একাংশেরও দাবি, সরকারি হাসপাতালে সরবরাহকারী বা ন্যায্য মূল্যের দোকান থেকে সরবারহ করা অ্যান্টিবায়োটিকের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকে। সে জন্য বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে বলা হয়। যদিও চিকিৎসকদের এই দাবিকে মানতে নারাজ বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাঁদের যুক্তি, এটা একটা চক্রের মতো কাজ করছে। বিষয়টি অনৈতিক জেনেও বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে রোগীদের বাধ্য করা হচ্ছে। এ নিয়ে রোগী কল্যাণ সমিতিতেও বারেবারে আলোচনা হয়েছে।

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাসে ৭৫ থেকে ১০০ জন অগ্নিদগ্ধ রোগী এই হাসপাতালে আসেন। কিন্তু বার্ন ইউনিটের শয্যা সংখ্যা ৩০। ফলে বহু রোগীকেই কয়েকদিন জরুরি বিভাগে রেখে সার্জিক্যাল বিভাগে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও সাধারণত স্কিন গ্রাফটিংয়ের সুযোগ মেলে না। ফলে রোগীদের অবস্থারও উন্নতি হয় না। যদিও বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, বার্ন ইউনিটটিকে পূর্ণাঙ্গ ভাবে গড়ে তোলার জন্য তাঁরা চেষ্টা করছেন। শয্যাসংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি কয়েকটি শয্যা নিয়ে একটি বার্ন আইটিইউ গড়ে তোলারও চেষ্টা চলছে। সেখানে দুটি ভেন্টিলেটর থাকবে, প্লাস্টিক সার্জারির ব্যবস্থা, স্কিন গ্রাফটিংও করা যাবে বলে তাঁদের আশ্বাস। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার উৎপল দাঁ বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসার জন্য একটি প্রকল্প নিয়েছে। সেখানে আমাদের প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। ৬ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকায় বার্ন ইউনিট পূর্ণাঙ্গ ভাবে গড়ে তোলা হবে।’’ প্রথম পর্যায়ে ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা মিলতে চলেছে বলেও তাঁর দাবি। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তারও আশ্বাস, প্রাথমিক ভাবে চিকিৎসা যাতে মহকুমা স্তরেও গড়ে ওঠে তার জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE