Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
লগ্নিসংস্থা থেকে অনাদায়ী প্রায় ১০ কোটি টাকা

বিষ্ণুপুরে নার্সিংহোমের দখল ব্যাঙ্কের

সংস্থার ঝাঁপ বন্ধ গত বছর থেকে। বেপাত্তা কর্ণধারেরা। মাথায় হাত গ্রাহক ও আমানতকারীদের। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের সেই প্রতারক অর্থলগ্নি সংস্থা নিউল্যান্ড-এর বন্ধ থাকা নার্সিংহোমের ‘দখল’ নিল ব্যাঙ্ক।

বিষ্ণুপুরের নিউল্যান্ড হাসপাতালে (ইনসেটে) দখলের নোটিস সাঁটাচ্ছেন ব্যাঙ্কের আধিকারিক। মোতায়েন পুলিশ। ছবি: শুভ্র মিত্র।

বিষ্ণুপুরের নিউল্যান্ড হাসপাতালে (ইনসেটে) দখলের নোটিস সাঁটাচ্ছেন ব্যাঙ্কের আধিকারিক। মোতায়েন পুলিশ। ছবি: শুভ্র মিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৫ ০১:৩৪
Share: Save:

সংস্থার ঝাঁপ বন্ধ গত বছর থেকে। বেপাত্তা কর্ণধারেরা। মাথায় হাত গ্রাহক ও আমানতকারীদের। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের সেই প্রতারক অর্থলগ্নি সংস্থা নিউল্যান্ড-এর বন্ধ থাকা নার্সিংহোমের ‘দখল’ নিল ব্যাঙ্ক।

ব্যাঙ্ক অফ বরোদার বিষ্ণুপুর শাখা থেকে প্রচুর টাকা ধার নিয়েছিল ওই সংস্থা। কিন্তু, টাকা আর ফেরত পায়নি ব্যাঙ্ক। সে জন্যই বুধবার বিষ্ণুপুর শহরে ওই সংস্থার নিউল্যান্ড হসপিটালের দখল নেয়। কোনও দিক থেকে বাধা যাতে না আসে, সে জন্য এ দিন প্রচুর পুলিশ নিয়ে প্রথমেই ঘিরে ফেলা হয় নার্সিংহোম চত্বর। পরে মূল গেটের তালা ভেঙে শুরু হয় ‘অ্যাসেসমেন্ট’ বা সম্পত্তির মূল্যায়ন। একই সঙ্গে গেটে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ব্যাঙ্ক অফ বরোদার ‘অ্যাসেট রিকভারি ম্যানেজমেন্ট ব্রাঞ্চ’-র দখল নোটিস।

এই বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার এ কে মণ্ডল বলেন, “বছর কয়েক আগে এই হাসপাতালের জন্য ৯ কোটি ৯৯ লক্ষ ৬০ হাজার ৯১১ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন সংস্থার ৬ জন কর্মকর্তা— দীপঙ্কর দে, গোপাল হাজরা, অভীক হাজরা, কার্তিক চরণ, কৌশিক রায় ও পিঙ্কু কুমার দাস। সেই ঋণ শোধ করতে ওই সংস্থা ব্যর্থ হওয়ায় আমরা নোটিস টাঙিয়ে হাসপাতালের দখল নিলাম।’’ এর জন্য কোনও দিক থেকেই বাধা আসেনি বলে জানিয়ে তিনি আরও বলেন “বছর কয়েক ধরে এই ৬ জনই বেপাত্তা। ফলে তাঁদের অনুপস্থিতিতে প্রশাসনকে জানিয়ে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে তালা ভেঙে অ্যাসেসমেন্টের কাজ করা হয়েছে। তবে এর জন্য কোনও বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। গড়বেতা, সারেঙ্গা ও বাঁকাদহ এলাকায় এক সময়ে বসবাসকারী এই ৬ জনের সঙ্গে আমরা অনেক বার চেষ্টা করে যোগযোগ করতে পারিনি।’’

এই ঋণ শোধ না করার দায়ে এর আগে জুন মাসে বাঁকুড়া শহরে সংস্থার আর একটি নার্সিংহোমেরও (যার পোশাকি নাম লিটল হার্ট চিলড্রেন হসপিটালস প্রাইভেট লিমিটেড) দখল নিয়েছিল এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের রাজারহাট শাখা। বাঁকুড়ার কেন্দুয়াডিহিতে এই নার্সিহোমটি এক সময়ে বাঁকুড়ার প্রথম শ্রেণির নার্সিংহোম হিসেবে পরিচিত ছিল। এ দিন বিষ্ণুপুরের নিউল্যান্ড হসপিটালের সম্পত্তিও ব্যাঙ্ক অধিগ্রহণ করার পর এই সংস্থার এজেন্ট ও আমানতকারীরা তাঁদের টাকা ফেরতের দাবি তুলেছেন। সংস্থায় সিনিয়র এজেন্ট হিসেবে কাজ বিষ্ণুপুর শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা এক যুবকের ক্ষোভ, “ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ আইনের বলে টাকার বদলে সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে নিলেন। কিন্তু আমরা সাধারণ এজেন্টরা কিছুই পেলাম না। সংস্থার কর্তারাও ধরা পড়ল না। আমার হাত ধরে কয়েকশো মানুষ তাঁদের টাকা লগ্নি করেছিলেন এই সংস্থায়। সরকার কি পারে না টাকা ফিরিয়ে দিতে কোনও পদক্ষেপ করতে?’’ একই ক্ষোভ ঝরে পড়ছে বিষ্ণুপুরের গোপেশ্বরপল্লির বাসিন্দা, এই সংস্থার এক আমানতকারীর মুখেও। তিনি বলেন, “প্রতি মাসে এক হাজার টাকা রেকারিং করেছিলাম নিউল্যান্ডে। সংস্থার কর্তারা বাড়িতে এসে মোটা অঙ্কের লাভের আশ্বাস দিয়েছিল। দশ মাস টেনেছি রেকারিং। তার পর এক দিন দুম করে সংস্থা বন্ধ হয়ে গেল।’’ তাঁর আক্ষেপ, “সরকার সারদার বহু ক্ষুদ্র আমানতকারীর টাকা ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের কথা কেউ ভাবল না।’’

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৯ সালে বিষ্ণুপুরে ‘নিউল্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ নামে বেসরকারি ওই লগ্নি সংস্থা চালু করেন বাঁকাদহ গ্রামের সাহাপাড়ার বাসিন্দা দীপঙ্কর দে। বিষ্ণুপুরেই ছিল সংস্থার প্রধান অফিস। তার আগে তিনি অন্য একটি অর্থলগ্নি সংস্থায় কাজ করতেন। কিন্তু ওই সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিবাদের জেরে সংস্থার এজেন্টদের একাংশকে নিজের দিকে টেনে নিউল্যান্ড নামের নতুন সংস্থাটি খোলেন। উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গের পাশাপাশি ওড়িশা, বিহার, সম, ত্রিপুরার মতো রাজ্যে ৯০টিরও বেশি শাখা অফিস ছিল এই সংস্থার। সাধারণ মানুষকে চড়া সুদে টাকা ফেরত দেওয়ার টোপ দিয়ে রেকারিং, ফিক্সড ডিপোজিট-সহ নানা আমানতে টাকা তুলত এই সংস্থা। সেই টাকা বিভিন্ন ব্যবসায় খাটাতেন দীপঙ্করবাবু।

সংস্থা সূত্রে জানা যাচ্ছে, টাকা তোলার ওই কারবার করে ক্রমেই ফুলেফেঁপে উঠেছিলেন দীপঙ্করবাবু। শুধু বাঁকুড়া জেলাতেই তিনটি নার্সিংহোম কিনেছিলেন তিনি। জমি কেনাবেচার ব্যবসাতেও টাকা ঢালতেন। উল্লেখ্য, রাজ্যে পরিবর্তনের পর দু’বছর ফুলে ফেঁপে উঠেছিল সংস্থার ব্যবসা। ২০১৩ সালে সারদা-কেলেঙ্কারির পরে একের পর এক লগ্নি সংস্থা ঝাঁপ বন্ধ করে। সেই তালিকায় ছিল নিউল্যান্ডও। আমানতকারীরা টাকা ফেরত চেয়ে চাপ দেওয়ায় সংস্থার বহু এজেন্ট এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। গা ঢাকা দেন দীপঙ্করবাবু-সহ সংস্থার কর্তারা। তিনটি চালু নার্সিংহোমও বন্ধ করে দেন তিনি। দীপঙ্করবাবুর সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এর আগে একাধিকবার সাহাপাড়ায় তাঁর বাড়িতে গেলে সেখানে দীর্ঘদিন তিনি থাকেন না বলে জানান পরিবারের সদস্যেরা। তাঁর মোবাইলও বন্ধ। ২০১৪ সালের ২৩ অগস্ট বিষ্ণুপুর থানায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ দায়ের হয়। গত বছরই হাওড়ার বাগনান থেকে এই সংস্থার চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার সৌরভ দত্তকে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার করেছিল কোলাঘাট থানার পুলিশ। তিনি এখন জামিনে মুক্ত বলে পুলিশ সূত্রের খবর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE