Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

রক্তের অভাব মেটাতে দান করছেন ডাক্তার-নার্সরাই

রাজ্য জুড়ে রক্তের জন্য হাহাকার চলছে। পরিস্থিতি এমনই যে, তা সামাল দিতে এগিয়ে আসতে হচ্ছে ডাক্তারদেরও। শুক্রবার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের ডাক্তার-নার্স নিজেরাই রক্ত দিয়ে রোগীদের প্রাণ বাঁচাতে উদ্যোগী হলেন। তাঁদের এগিয়ে আসতে দেখে চুপচাপ বসে থাকতে পারেননি রোগীদের আত্মীয়রাও। তাঁদের মধ্যেও অনেকে এ দিন রক্ত দিয়েছেন। যদিও স্বাস্থ্য কর্তাদের দাবি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক। রক্তের কোনও আকাল নেই।

চলছে রক্তদান শিবির। শুক্রবার।  —নিজস্ব চিত্র

চলছে রক্তদান শিবির। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৪ ০১:৫৮
Share: Save:

রাজ্য জুড়ে রক্তের জন্য হাহাকার চলছে। পরিস্থিতি এমনই যে, তা সামাল দিতে এগিয়ে আসতে হচ্ছে ডাক্তারদেরও। শুক্রবার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের ডাক্তার-নার্স নিজেরাই রক্ত দিয়ে রোগীদের প্রাণ বাঁচাতে উদ্যোগী হলেন। তাঁদের এগিয়ে আসতে দেখে চুপচাপ বসে থাকতে পারেননি রোগীদের আত্মীয়রাও। তাঁদের মধ্যেও অনেকে এ দিন রক্ত দিয়েছেন। যদিও স্বাস্থ্য কর্তাদের দাবি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক। রক্তের কোনও আকাল নেই।

এ দিন সকালে এনআরএস-এর হেমাটোলজি বিভাগের চেহারাটা ছিল আর পাঁচটা দিনের তুলনায় বেশ অন্য রকম। ডাক্তার-নার্সদের অধিকাংশই সময়ের আগে হাজির হয়েছিলেন। কাজের ফাঁকে সেমিনার রুমে ছুটছিলেন তাঁরা। কারণ, সেখানেই ওই রক্তদান শিবিরের ব্যবস্থা হয়েছিল। বিভাগের ডাক্তারেরা জানালেন, ওই হাসপাতাল যেহেতু রাজ্যে থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসার দু’টি নোডাল সেন্টারের মধ্যে একটি, তাই প্রতি দিন ১০ থেকে ১৫ জন থ্যালাসেমিয়া রোগী এখানে রক্ত নিতে আসেন। রক্তের আকালের জন্য প্রতি দিনই একাধিক রোগীকে তাঁরা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। রক্ত পাচ্ছে না হিমোফিলিয়া, এমনকী রক্তের ক্যানসারের রোগীরাও। চিকিৎসক মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য বলেন, “এত রোগীকে নিয়মিত ফিরিয়ে দিতে দিতে আমরা ক্রমশ অসহায় বোধ করছিলাম। মনে হয়েছিল নিজেদেরই কিছু একটা করা দরকার। সেই ভাবনা থেকেই এ দিনের রক্তদান শিবিরের আয়োজন।”

ডাক্তার-নার্সদের এ ভাবে এগিয়ে আসতে দেখে উদ্বুদ্ধ হন রোগীদের আত্মীয়েরাও। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত এক শিশুর বাবা বলেন, “এর আগে তিন দিন ফিরে গিয়েছি। হাসপাতালের ব্লাডব্যাঙ্কে রক্ত নেই। বেসরকারি ব্লাডব্যাঙ্কে চড়া দামে রক্ত কেনার ক্ষমতা নেই। আজ ডাক্তারবাবুদের উদ্যোগ দেখে মনে হল শুধু অভিযোগ না করে আমাদেরও এগিয়ে আসা দরকার।” হেমাটোলজি বিভাগের এই উদ্যোগ দেখে অন্য কয়েকটি বিভাগও শীঘ্রই এই ধরনের শিবির আয়োজন করতে চলেছে বলে এনআরএস সূত্রের খবর।

যদিও রাজ্যে রক্তের আকালের কথা মানতে রাজি নন স্বাস্থ্য কর্তারা। স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ সচিব ওঙ্কার সিংহ মনা বলেন, “রক্তের অভাব নেই। বরং এত বেশি রক্ত মজুত যে, আমরা কিছু ক্যাম্প বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছি।”

তাঁর এই বক্তব্য অবশ্য অবাক করেছে চিকিৎসক এবং রক্তদান আন্দোলনে যুক্ত সমাজকর্মীদের। সরকারি চিকিৎসকদের একটি বড় অংশের অভিযোগ, আগে রক্তদান শিবির থেকে সংগৃহীত রক্ত সরকারি ব্লাডব্যাঙ্কেই দেওয়া হত। কিন্তু ইদানীং বিভিন্ন সংগঠন রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে সংগৃহীত রক্ত বেসরকারি ব্লাডব্যাঙ্কগুলিতে চড়া দামে বিক্রি করছে। ফলে সরকারি ব্লাডব্যাঙ্কে রক্ত জমা হচ্ছে না। রক্তদান আন্দোলনের কর্মী দীপঙ্কর মিত্রের কথায়, “ওষুধের লাগামছাড়া দামের কারণে সাধারণ মানুষের কাছে যাতে চিকিৎসা অধরা না হয়ে ওঠে, সে জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান চালু করেছেন। কিন্তু জীবনদায়ী রক্তই তো এখন বেসরকারি হাতে চলে গিয়েছে। এটা ঠেকানোর জন্য তিনি কী করছেন?”

পশ্চিমবঙ্গে ১৯৮০ নাগাদ রক্তদান আন্দোলন সংগঠিত চেহারা নেয়। মূলত বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনগুলি এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সমাজকর্মীদের মতে, ২০০৯ সাল থেকে বামপন্থী সংগঠনগুলির সভ্য সংখ্যা কমতে শুরু করে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অস্থির হয়ে ওঠে। এর জেরে কিছুটা কমতে শুরু করে রক্তদান শিবিরের সংখ্যা। রক্তদান আন্দোলনের কর্মীদের মতে, আগে পুজোর সময়ে শিবিরের সংখ্যা কিছুটা কমলেও পুজোর পরে বাড়তি শিবির আয়োজন করে ঘাটতি মিটিয়ে দেওয়া হত। ইদানীং তা হচ্ছে না। আর শিবির যেটুকু হচ্ছে, তা থেকে সংগৃহিত রক্তের বড় অংশই বেসরকারি ব্লাডব্যাঙ্কে চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ।

ভলান্টারি ব্লাড ডোনার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অপূর্ব ঘোষের মতে, কোনও বছর অক্টোবর মাসে রক্তের এমন আকাল হয় না। তিনি বলেন, ‘‘গরমের সময়ে ক্যাম্প কম হয়। গরম একটু কমতে শুরু করলেই ক্যাম্পের সংখ্যা বাড়ে। এখন ক্যাম্প থেকে সংগৃহীত রক্তের বড় অংশই চলে যাচ্ছে বেসরকারি ব্লাডব্যাঙ্কগুলিতে। তাই সাধারণ গরিব মানুষ রক্তের জন্য হাহাকার করছেন। সরকারি ব্লাডব্যাঙ্কগুলির পরিকাঠামো যথাযথ নেই বলে সমস্যা আরও বাড়ছে।”

ওঙ্কার সিংহ মিনার দাবি, “পরিকাঠামোর অভাবের অভিযোগ সত্যি নয়। প্রচুর ক্যাম্প হচ্ছে। আমাদের কর্মীরা সেই সব ক্যাম্প থেকে রক্ত সংগ্রহ করে আনছেন। রক্তের উপাদান পৃথকীকরণের যন্ত্রও বসানো হয়েছে কয়েকটি জায়গায়। বাড়তি ক্যাম্প হচ্ছে বলে আমরা অতিরিক্ত ব্লাডব্যাগও সরবরাহ করেছি।”

তা হলে রোগীর পরিজনেরা এক সরকারি ব্লাডব্যাঙ্ক থেকে অন্য ব্লাডব্যাঙ্কে এমন হন্যে হয়ে ঘুরছেন কেন? সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE