Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সস্তার ওষুধে ক্যানসার জয়, আশায় বিজ্ঞানীরা

খুব পরিচিত আর সস্তা এই ওষুধটির সঙ্গে ক্যানসারের সম্পর্ক বহু দিনের। চিকিৎসক মহলে অনেকেই জানেন যে ওষুধটির সাহায্যে কিছু বিশেষ ক্যানসারের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এর আগে কোলন, প্রস্টেট, গ্যাস্ট্রোইন্টেসটিনাল অথবা ফুসফুসের ক্যানসার আটকাতে এর ব্যবহার শোনা গিয়েছে। কিন্তু স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রেও যে অ্যাসপিরিন কার্যকর হতে পারে, সেই পথ দেখিয়েছে আমেরিকা প্রবাসী বাঙালি গবেষকদল।

অন্বেষা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৫ ০২:৩৮
Share: Save:

খুব পরিচিত আর সস্তা এই ওষুধটির সঙ্গে ক্যানসারের সম্পর্ক বহু দিনের। চিকিৎসক মহলে অনেকেই জানেন যে ওষুধটির সাহায্যে কিছু বিশেষ ক্যানসারের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এর আগে কোলন, প্রস্টেট, গ্যাস্ট্রোইন্টেসটিনাল অথবা ফুসফুসের ক্যানসার আটকাতে এর ব্যবহার শোনা গিয়েছে। কিন্তু স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রেও যে অ্যাসপিরিন কার্যকর হতে পারে, সেই পথ দেখিয়েছে আমেরিকা প্রবাসী বাঙালি গবেষকদল।

কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি অধ্যাপক-গবেষক সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দলের আরও পাঁচ বাঙালি গবেষকের এই কাজ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নেচার গ্রুপের পত্রিকা ‘ল্যাবরেটরি ইনভেস্টিগেশন’-এ। যার মোদ্দা কথা, পরিমিত পরিমাণে রোজ অ্যাসপিরিন দিয়ে স্তন ক্যানসারের বাড়বাড়ন্ত ঠেকানো যেতে পারে। তবে মানুষের উপরে নয়, প্রাথমিক ভাবে ইঁদুরের উপরে পরীক্ষা করে

এই গবেষণা এগিয়েছে। গবেষণাগারে স্তন ক্যানসার আক্রান্ত কোষ পরিস্ফুটনের (incubate) পরে সেগুলির উপরেও অ্যাসপিরিন দিয়ে এই পরীক্ষা করা হয়েছে।

তাতে দেখা গিয়েছে, অ্যাসপিরিন প্রয়োগের ফলে সেই সব কোষের মৃত্যুর হার লক্ষণীয় ভাবে বেড়ে গিয়েছে। আর যেগুলি ধ্বংস হয়নি, সেগুলিও আর বৃদ্ধি ঘটাতে পারছে না। কোষ-পরীক্ষার পাশাপাশি বেশ কিছু ইঁদুরের (যাদের শরীরে বেশি মাত্রায় টিউমার রয়েছে) উপরেও সুশান্তবাবুরা এই পরীক্ষা করেছেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও পাঁচ বাঙালি গবেষক— সন্দীপ্ত সরকার, স্নিগ্ধা বন্দ্যোপাধ্যায়, অম্লান দাস, অর্চনা দে এবং গার্গী মাইতি। টানা দু’সপ্তাহ ওই ইঁদুরগুলিকে রোজ মাত্র ৭৫ মিলিগ্রাম অ্যাসপিরিন দিয়েছিলেন ওঁরা। দেখা গেল ওই ইঁদুরগুলির টিউমার ৪৭ শতাংশ কমে গিয়েছে।

শুধু বাড়বাড়ন্ত ঠেকানো নয়, অ্যাসপিরিন যে স্তন ক্যানসার আটকাতেও পারে তা দেখার জন্য ক্যানসারে আক্রান্ত নয় এমন কয়েকটি ইঁদুরকে ১০ দিন শুধু অল্প পরিমাণে অ্যাসপিরিন দেওয়া হয়। তার পরে তাদের ক্যানসারে আক্রান্ত কোষের সংস্পর্শে আনা হয়। দু’সপ্তাহ পরে দেখা যায় তাদের শরীরে ক্যানসার অনেক কম মাত্রায় ছড়িয়েছে। সুশান্তবাবু বলছেন, অ্যাসপিরিন দেওয়ার ফলে ক্যানসারের ওই স্টেম সেল বা রেসিডুয়াল সেলগুলি আর বাড়তে পারেনি।

রেসিডুয়াল সেল কী করে?

সুশান্তবাবু জানাচ্ছেন, সাধারণত ক্যানসারের স্টেম সেল প্রতিকূলতার মধ্যেও বেঁচে থাকে। সেগুলি ওষুধের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। শরীরে অনুকূল অবস্থা তৈরি হলেই ফের সক্রিয় হয়ে টিউমার তৈরি করতে পারে। সুশান্তবাবুরা গবেষণা করে দেখেছেন, স্তন ক্যানসারে অ্যাসপিরিন এই রেসিডুয়াল সেলকে ধ্বংস করতে পারে। ওই সেলগুলির চরিত্রও পাল্টে দেয়, যাতে তারা আর টিউমার তৈরি করতে প্রায় পারেই না।

তাঁর মতে, দু’ভাবে অ্যাসপিরিন দেওয়া সম্ভব। এক, কেমোথেরাপির পরে। ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলি আর যাতে বাড়তে না পারে।

দুই, আক্রান্ত হওয়ার আগেই ক্যানসারকে আটকানো। যদিও চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই ওষুধের প্রয়োগ শুরু হতে এখনও দেরি। তার আগে ক্লিনিকাল ট্রায়াল (গবেষণাগারে মানবদেহের উপর পরীক্ষা) করা বাকি। সেই সঙ্গে সুশান্তবাবুর সতর্কতা, অ্যাসপিরিন অনেক পুরনো ওষুধ। প্রেসক্রিপশন ছাড়াও কেনা যায়। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে এটা ব্যবহার করবেন না।

মানুষের উপরে এখনও পরীক্ষা করা হয়নি বলেই থেকে যাচ্ছে অনেক প্রশ্ন। চিকিৎসকরা বলেন হাঁপানি, আলসার, রক্তাল্পতা, ডায়াবেটিস, লিভার বা কিডনির সমস্যা থাকলে এই ওষুধ দেওয়া যায় না। মাথা ব্যথা, জ্বর বা রক্ত তরল করার জন্য চিকিৎসকরা এর কথা বলেন। তা ছাড়া ওষুধটির অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। কানে শোনায় অসুবিধে, চোখ-ঠোঁট-গলা ফুলে যাওয়া, রক্তবমি বা চামড়াতেও প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

রক্ত সঞ্চালন ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা থাকায় গত তিন বছর ধরে সুশান্তবাবু নিজেও রোজ অ্যাসপিরিন (৮১ মিলিগ্রাম) খাচ্ছেন। কিন্তু কোনও অসুবিধায় পড়েননি বলেই তাঁর দাবি। তবে অনেকের জন্য ওষুধটা উপযোগী নয়, মানছেন তিনি।

এখানকার ডাক্তাররা কী বলছেন? ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ভাল প্রয়াস। তবে এখনও অনেক পথ পেরনো বাকি। অ্যাসপিরিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথাও ভাবতে হবে। বাণিজ্যিক ভাবে এর প্রয়োগ শুরু হলে তবে বোঝা যাবে, মানুষের উপরে কেমন প্রভাব পড়ছে।’’ কিন্তু ভারতের মতো দেশে ক্যানসার চিকিৎসায় এই সস্তা ওষুধটি যে খুবই উপযোগী তা নিয়ে সন্দেহ নেই, সেটাও বলেছেন গৌতমবাবু।

সহমত ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়। বললেন, ‘‘ভাল ইঙ্গিত। তবে অ্যাসপিরিনের প্রভাব ক্যানসার আক্রান্ত মানুষের দেহে কী রকম হবে, তা জানতে আরও সময় লাগবে।’’

চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার অবশ্য বললেন, ‘‘শরীরের কোনও ফোলা অংশের চিকিৎসায় অল্প মাত্রার অ্যাসপিরিন আমরা দিই। এ বার স্তনের টিউমারেও সেটা যদি কাজ করে, তা হলে তো সুসংবাদ।’’

স্তন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ তাপ্তি সেন বিষয়টি নিয়ে একটু সন্দিহান। বললেন, ‘‘একটা ওষুধ ক্যানসার সারিয়ে দেবে, এত সহজে এখনই এটা বলতে পারছি না।’’

অ্যাসপিরিনের নেতিবাচক দিকটি জেনেও সুশান্তবাবু বললেন, ‘‘ঝুঁকি আছে ঠিকই। কিন্তু সেটা ক্যানসারের চেয়ে বড় ঝুঁকি তো নয়!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE