স্বাস্থ্যকর্তাদের ছুটি। রোগের বা রোগীর তো নয়!
শুক্র থেকে সোমবার পর্যন্ত বন্ধ ছিল স্বাস্থ্য ভবন। টানা চার দিন ওই সরকারি ছুটির জেরে কোনও মেডিক্যাল কলেজে এক জনও দরিদ্র রোগীর পেসমেকারের অর্ডারে সই হয়নি। সই হয়নি এসএসকেএমে নিখরচায় এমআরআই করানোর ছাড়পত্রেও। ওই দু’টি ক্ষেত্রেই অনুমতি দেওয়ার অধিকারী স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা। কিন্তু তাঁরা সকলেই ছুটিতে থাকায় মুমূর্ষু হৃদ্রোগীরা হাসপাতালে পড়ে থেকেছেন। তাঁদের জন্য বিপিএল পেসমেকারের ব্যবস্থা করা যায়নি। জরুরি ভিত্তিতে রোগ নির্ণয়ের জন্য করা যায়নি এমআরআই-ও। মঙ্গলবার এমনই এক হৃদ্রোগীর পরিবারের তরফে স্বাস্থ্য ভবনে লিখিত অভিযোগ গিয়েছে। স্বাস্থ্যের মতো জরুরি পরিষেবায় কেন ছুটির দিনে এই ধরনের নির্দেশিকায় স্বাক্ষর করার মতো এক জন পদাধিকারীরও ডিউটি থাকবে না, সেই প্রশ্ন তুলেছে ওই রোগীর পরিবার।
বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের কর্তারাও প্রশ্ন তুলেছেন, স্বাস্থ্য ভবনের নির্দেশ মেনে তাঁরা যদি ছুটির দিনেও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের জন্য অফিস খোলা রাখতে পারেন, তা হলে স্বাস্থ্য ভবন কেন তা করতে পারবে না? কেন এই ধরনের জরুরি পরিষেবার জন্য পালা এক জনেরও ডিউটি রাখা হবে না?
স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ভবিষ্যতেও স্বাস্থ্য ভবন খোলা রাখার কোনও পরিকল্পনা তাঁদের নেই। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “স্বাস্থ্য ভবন কেন ছুটির দিনে খোলা থাকবে? ওই সব অনুমতি তো হাসপাতালের সুপারেরাই দিয়ে দিতে পারেন। পরে দফতর খুললে তাঁরা অর্ডার পাশ করিয়ে নেবেন। এ নিয়ে এত শোরগোলের তো কিছু নেই।”
হাসপাতালের কর্তারা কিন্তু এক বাক্যে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার ওই দাবি ঠিক নয়। অন্য অনেক ক্ষেত্রে সুপারেরা তাৎক্ষণিক কাজ চালানোর জন্য নির্দেশ দিতেই পারেন। কিন্তু বিপিএল পেসমেকার কিংবা দরিদ্র রোগীদের নিখরচায় এমআরআই-এর ছাড়পত্র দেওয়ার এক্তিয়ার তাঁদের দেওয়া হয়নি।
ছুটির দিনে সরকারি হাসপাতালের প্রশাসনিক বিভাগ খোলা রাখার জন্য বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে স্বাস্থ্য ভবনের নির্দেশনামা রয়েছে। সেই নির্দেশ মেনেই হাসপাতালগুলির প্রশাসনিক বিভাগে ছুটির দিনে পালা করে কয়েক জনের ডিউটি থাকে। এসএসকেএমের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, “আমাদের ডিউটি চার্ট করা থাকে। ডেপুটি সুপার বা সহকারি সুপার পদমর্যাদার কেউ না কেউ ছুটির দিনেও থাকেন। ফলে আচমকা রোগীর কোনও সমস্যা হলে তাঁরা প্রশাসনিক দফতরে যোগাযোগ করতে পারেন।” একই বক্তব্য ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের সুপার পীতবরণ চক্রবর্তীরও। তিনি বলেন, “প্রশাসনিক বিভাগ কোনও সময়েই বন্ধ থাকে না। বহু ক্ষেত্রেই আমি নিজে থাকি। এ ছাড়া, সহকারি সুপার বা ডেপুটি সুপারও থাকেন।” এনআরএসের সুপার শেখ আলি আমাম বলেন, “সমস্ত ছুটির দিনেই এখানে প্রশাসনিক বিভাগে কেউ না কেউ থাকেন। ইন্টার্নদের কর্মবিরতি চলছিল বলে আমি নিজেও চার দিন হাসপাতালে এসেছি।”
প্রশ্ন হল, তা হলে কেন স্বাস্থ্য ভবনে কেউ থাকবেন না? সুশান্তবাবুর বক্তব্য, সেটা কোনও ভাবেই জরুরি নয়। যদিও এসএসকেএমের কার্ডিওলজি বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, “রোগীর পেসমেকারের প্রয়োজন হলে খুব দ্রুতই তা বসিয়ে দিতে হয়। কিন্তু ছুটির দিনগুলিতে আমরা নিরুপায়। বহুক্ষেত্রেই অস্থায়ী পেসমেকার বসিয়ে ফেলে রাখা ছাড়া উপায় থাকে না। চিকিৎসক হিসেবে আমরা বুঝতে পারি, সেটা কোনও ভাবেই ঠিক সিদ্ধান্ত নয়। যে কোনও সময়ে রোগীর অবস্থার অবনতি হয়ে কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।”
একই বক্তব্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, ন্যাশনাল, নীলরতন সরকার, আরজিকরের ডাক্তারদের একটি বড় অংশের। এসএসকেএমে নিখরচায় এমআরআই করানোর জন্য স্বাস্থ্য ভবন থেকে অনুমতি আনতে হয়। এক স্নায়ু চিকিৎসকের কথায়, “মুমূর্ষু রোগীর দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা শুরুর জন্য এমআরআই প্রয়োজন পড়েছে। কিন্তু তাঁরা তা করাতে পারেননি। কারণ, এ ক্ষেত্রে আমরা শুধু প্রেসক্রিপশনে লিখে দিতে পারি। কিন্তু আসল ছাড়পত্র তো আসে স্বাস্থ্য ভবন থেকে। সেখানে তো তালা ঝুলছিল।”
রবিবার ছুটির দিনে সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার থাকেন না বলে অভিযোগ ওঠে প্রায়শই। সেই অভিযোগ যে মিথ্যা নয়, হাসপাতালে ভর্তি যে কোনও রোগীর সঙ্গে কথা বললেই তা স্পষ্ট হয়। একাধিক বার স্বাস্থ্য ভবন থেকে বিভিন্ন হাসপাতালের কর্তাদের এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। রবিবার যাঁদের ডিউটি থাকে, তাঁরা অনুপস্থিত থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ারও কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বার ডাক্তারেরা স্বাস্থ্যকর্তাদের উদ্দেশে বলছেন, ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy