Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
কাউন্সিলের নির্দেশ মানছে না রাজ্য শাখা

শাস্তি এড়িয়ে প্র্যাক্টিস ৮ ডাক্তারের

মেডিক্যাল শিক্ষা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজকর্মের কেন্দ্রীয় সংস্থা তাঁদের শাস্তি দিয়েছে। শাস্তি মানে একেবারে রেজিস্ট্রেশন বাতিলের নির্দেশ। তা সত্ত্বেও বহাল তবিয়তে রোগী দেখে চলেছেন আট জন চিকিৎসক। এবং তাঁরা ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’ বা এমসিআইয়ের ওই নির্দেশ উপেক্ষা করার সুযোগ পাচ্ছেন কাউন্সিলের পশ্চিমবঙ্গ শাখারই ‘সৌজন্যে’!

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১২
Share: Save:

মেডিক্যাল শিক্ষা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজকর্মের কেন্দ্রীয় সংস্থা তাঁদের শাস্তি দিয়েছে। শাস্তি মানে একেবারে রেজিস্ট্রেশন বাতিলের নির্দেশ। তা সত্ত্বেও বহাল তবিয়তে রোগী দেখে চলেছেন আট জন চিকিৎসক। এবং তাঁরা ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’ বা এমসিআইয়ের ওই নির্দেশ উপেক্ষা করার সুযোগ পাচ্ছেন কাউন্সিলের পশ্চিমবঙ্গ শাখারই ‘সৌজন্যে’!

আসলে কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের নির্দেশ মানছে না রাজ্য শাখা। প্রশ্নের মুখে পড়ছে দু’পক্ষই। প্রথম প্রশ্ন, মূল সংস্থার নির্দেশ উপেক্ষা করার স্পর্ধা রাজ্য শাখার হয় কী করে? দ্বিতীয় প্রশ্ন অবধারিত ভাবেই উঠছে, রাজ্য শাখাকে নির্দেশ মানাতে বাধ্য করাতে না-পারলে কেন্দ্রীয় সংস্থা আছে কেন?

চিকিৎসায় গাফিলতির জন্য দোষী সাব্যস্ত করে গত অগস্টে বাংলার তিন জন এবং জানুয়ারিতে পাঁচ ডাক্তারের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিল এমসিআই। কিন্তু রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল সেই নির্দেশ রূপায়ণই করেনি। চিকিৎসায় গাফিলতির জেরে চার রোগীর মৃত্যুর প্রেক্ষিতেই ওই আট চিকিৎসককে শাস্তি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল এমসিআই। রাজ্য কাউন্সিল তা না-মানায় সুবিচার চেয়ে এমসিআইয়ের সভানেত্রী জয়শ্রী বেন মেহতাকে চিঠি দিয়েছে মৃতদের পরিবার। রাজ্য কাউন্সিল জানিয়ে দিয়েছে, তারা এমসিআইয়ের নির্দেশ মানতে বাধ্য নয়। এমসিআই রাজ্য কাউন্সিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না কেন, সেই প্রশ্ন উঠছে এমসিআইয়ের অন্দরেই। জয়শ্রীদেবী বলছেন, ‘‘ওই সব রোগীর পরিবারের চিঠি পেয়েছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

বিমান সাহারায় নামে কলকাতার এক বাসিন্দার স্ত্রী সোমা পিত্তথলির পাথর এবং জরায়ুর সিস্টের অস্ত্রোপচারের জন্য বাগুইআটির একটি হাসপাতালে ভর্তি হন ২০১২ সালের অক্টোবরে। অস্ত্রোপচারের পরে তাঁর মৃত্যু হয়। রাজ্য কাউন্সিলে ছ’মাসের মধ্যে বিচার না-পেয়ে বিমানবাবু এমসিআইয়ের দ্বারস্থ হন। গত ২৩ জানুয়ারি এই ঘটনায় তিন চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন দুই থেকে পাঁচ বছরের জন্য বাতিল করার নির্দেশ দেয় এমসিআই। একই ভাবে অতসী দাস নামে কল্যাণীর এক রোগিণীর মৃত্যুতে এক চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন ছ’মাসের জন্য বাতিল হয়। মালদহের এক মহিলার মৃত্যুর ঘটনায় এক চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন এক বছরের জন্য এবং অন্য একটি ঘটনায় তিন ডাক্তারের ছ’মাসের জন্য রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে এমসিআই। শাস্তির তোয়াক্কা না-করে ওই আট জন চিকিৎসকই রোগী দেখে যাচ্ছেন।

মৃত চার রোগীর পরিবারের তরফে শ্যামল বসু, বিমান সাহারায়, সুবীর রায় ও রাধামাধব দাস রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের ব্যবহারে ব্যথিত। তাঁদের এক জন বলেন, ‘‘এমসিআই অভিযুক্ত চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের নির্দেশ দেওয়ার পরে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু রাজ্য কাউন্সিলের সাহস দেখে আমরা অবাক হয়ে যাচ্ছি!’’ রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের একটি সূত্রের খবর, শাস্তির প্রক্রিয়া পিছিয়ে দেওয়ার জন্য ফের ওই চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। কিন্তু তদন্ত চলাকালীন অভিযুক্ত চিকিৎসকেরা কী ভাবে রোগী দেখছেন, সেই প্রশ্নের জবাব দেয়নি এমসিআইয়ের রাজ্য শাখা। তারা এমসিআইয়ের নির্দেশ না-মানায় মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে বলে মনে করছেন কলকাতার চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ।

অভিযুক্ত চিকিৎসকদের সকলে একই সুরে কথা বলেছেন। তাঁদের কথায়, ‘‘বিষয়টি নিয়ে তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। অর্থাৎ এটি বিচারাধীন। তাই কোনও মন্তব্য করব না।’’

কেন্দ্রীয় এমসিআই নিষ্ক্রিয় কেন?

‘‘আমাদের নির্দেশ বাস্তবায়িত করা হল না কেন, সেই ব্যাপারে রাজ্য শাখাকে আমরা কারণ দর্শাতে বলব। রাজ্য শাখার জবাব পেলে তা পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে,’’ বললেন এমসিআইয়ের এথিক্স বা নীতি বিষয়ক কমিটির সদস্য, তৃণমূল বিধায়ক সুদীপ্ত রায়। আর কেন্দ্রীয় এমসিআইয়ের গ্রিভান্স কমিটির চেয়ারম্যান অজয়কুমারের অভিযোগ, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের মেডিক্যাল কাউন্সিল উদ্ধত। অন্য সকলেই কথা শোনে, কিন্তু ওরা শোনে না।’’

শুধু তারাই কেন্দ্রীয় সংস্থার নির্দেশ মানার গরজ দেখায় না, এই অভিযোগ মানতে রাজি নয় বাংলার কাউন্সিল। সেখানকার এক কর্তা বলেন, ‘‘কোনও রাজ্য কাউন্সিলই এমসিআইয়ের নির্দেশ মানে না।’’ দৃষ্টান্ত হিসেবে এমসিআইয়ের প্রাক্তন সভাপতি কেতন দেশাইয়ের কথা জানান তিনি। কেতনের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের নির্দেশ মানেনি গুজরাত। সেই সময় গুজরাত মেডিক্যাল কাউন্সিল জানিয়ে দিয়েছিল, এমসিআইয়ের নির্দেশ মানতে তারা বাধ্য নয়। কেতনের রেজিস্ট্রেশন ছিল গুজরাত থেকে। তিনি গুজরাতে দিব্যি প্র্যাক্টিস চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের ওই কর্তা।

কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ও রাজ্য শাখার এই চাপান-উতোরের মধ্যে রোগী এবং তাঁদের পরিবার অসহায় বোধ করছেন। তাঁদের প্রশ্ন, চিকিৎসায় গাফিলতি প্রমাণ ও শাস্তি ঘোষণার পরেও যদি কোনও প্রতিকার না-হয়, তাঁরা যাবেন কোথায়? রোগী এবং তাঁদের আত্মীয়দের অধিকার নিয়ে লড়াই করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘পিপলস ফর বেটার ট্রিটমেন্ট’ বা পিবিটি-র চেয়ারম্যান, প্রবাসী চিকিৎসক কুণাল সাহার বক্তব্য, ‘‘এমসিআই যে একটি নখদন্তহীন প্রতিষ্ঠান, তা ফের প্রমাণিত হল। আসলে এমসিআই এবং রাজ্য কাউন্সিলগুলি চিকিৎসকদের নিয়েই তৈরি। তাই তারা চিকিৎসকদের স্বার্থই রক্ষা করে।’’ কুণালবাবুর প্রশ্ন, দোষী চিকিৎসকদের শাস্তি দেওয়াই যদি এমসিআইয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য হয়, তা হলে তারা রাজ্য শাখার বিরুদ্ধে আদালতে যাচ্ছে না কেন? এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন। এমন চলতে থাকলে তো চিকিৎসায় গাফিলতির ঘটনায় আদৌ বিচার মিলবে কি না সেই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, মন্তব্য করেছেন ওই চিকিৎসক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE