Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
অভিযোগ নীলরতনে

নিখরচার ক্যানসার চিকিৎসায় বাধা চিকিৎসকেরাই

দু’টাকার পরিবর্তে ছ’হাজার। গরিব ক্যানসার রোগীদের বিভ্রান্ত করে এমনই বাড়তি টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের একাংশের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, দু’টাকার আউটডোর টিকিট করালেই যে পরিষেবা বিনা পয়সায় পাওয়ার কথা, সেই পরিষেবার জন্যই অসংখ্য গরিব রোগীকে হাসপাতালের পে-ক্লিনিকে পাঠিয়ে খরচ করানো হচ্ছে ছ’হাজার টাকা।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৫ ০০:২৯
Share: Save:

দু’টাকার পরিবর্তে ছ’হাজার।

গরিব ক্যানসার রোগীদের বিভ্রান্ত করে এমনই বাড়তি টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের একাংশের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, দু’টাকার আউটডোর টিকিট করালেই যে পরিষেবা বিনা পয়সায় পাওয়ার কথা, সেই পরিষেবার জন্যই অসংখ্য গরিব রোগীকে হাসপাতালের পে-ক্লিনিকে পাঠিয়ে খরচ করানো হচ্ছে ছ’হাজার টাকা। তাঁদের বলা হচ্ছে, পে-ক্লিনিকে না গেলে পরিষেবাই পাওয়া যাবে না। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে স্বাস্থ্য ভবনে জমা পড়া ওই একগুচ্ছ অভিযোগের প্রতিলিপি পাঠানো হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও।

রোগীদের পে-ক্লিনিকে পাঠিয়ে চিকিৎসকদের কী লাভ? স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, পে-ক্লিনিকের উপার্জিত অর্থ থেকে রোগী-পিছু একটা বড় অংশ পান সংশ্লিষ্ট ডাক্তার। বাকি টাকা ভাগ হয় হাসপাতালের সুপার, অ্যাকাউন্টস অফিসার, রেডিওথেরাপির টেকনিশিয়ান প্রমুখের মধ্যে। আর একটি ভাগ জমা পড়ে সরকারি কোষাগারে। রোগীদের অভিযোগ, ওই প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ বাড়াতে রোগীদের পে-ক্লিনিকে পাঠানো হচ্ছে। আউটডোর থেকেই সরাসরি পে-ক্লিনিকে গিয়ে রেডিয়েশন-এর তারিখ বুক করতে বলা হচ্ছে। যাঁদের ওই টাকা খরচের সামর্থ্য নেই, তাঁদের বড় অংশই চিকিৎসা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ।

দেশ জুড়ে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে ক্যানসার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হুঁশিয়ারি অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে প্রতি পরিবারে অন্তত এক জন করে ক্যানসার রোগীর হদিস মিলবে। এই রোগের সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আর্থিক সামর্থ্য যাতে কোনও বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সে জন্য সরকারি হাসপাতালে ক্যানসারের চিকিৎসা নিখরচায় করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু চিকিৎসকদের একাংশের এই আচরণ সেই নির্দেশকে কার্যত অগ্রাহ্য করছে বলেই অভিযোগ। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘ক্যানসাররে চিকিৎসা ফ্রি করার সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রীর। তাই এই দুর্নীতির অভিযোগ আমরা সরাসরি ওঁকেই জানাতে চাই। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

এ রাজ্যে ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রে একমাত্র কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং এনআরএসের ক্যানসার বিভাগেই পে-ক্লিনিকের ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। কারণ এই দুই হাসপাতালেই রোগীর ভিড় সব চেয়ে বেশি। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য ছিল, যাঁদের সামর্থ্য রয়েছে, তাঁদের মধ্যে কিছু রোগী যদি চান, তা হলে তাঁরা ১০০ টাকার টিকিট কেটে পে-ক্লিনিকে দেখিয়ে রেডিওথেরাপির ছ’হাজার টাকার প্যাকেজ নিতে পারেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও যাতে দুর্নীতি বাসা না বাঁধে, সেই জন্যই সরকারি নিয়ম রয়েছে, এক দিনে ওই পে-ক্লিনিকগুলিতে ২৫ জনের বেশি রোগীর নাম নথিভুক্ত করা যাবে না। কিন্তু সেই ২৫ জনের সীমারেখাও কোনও কোনও সময়ে মানা হয় না বলে অভিযোগ। সরকারি নিয়ম ভেঙে প্রতি দিন যথেচ্ছ রোগী দেখা চলে ওই পে-ক্লিনিকে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, রেডিয়েশনের যন্ত্রের অত্যধিক ব্যবহারের কারণে যন্ত্র দ্রুত কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে। খারাপ হচ্ছে পরিষেবার মানও।

শুধু তা-ই নয়, হাসপাতালের নথি থেকে জানা গিয়েছে, ১৫ দিনের বেশিরেডিয়েশনের জন্য যেমন ছ’হাজার টাকা খরচ, তেমন ১৫ দিনের কম রেডিয়েশেন হলে খরচ দাঁড়ায় তিন হাজার টাকা। এনআরএসে তিন-চার দিন, এমনকী এক দিন রেডিয়েশনের জন্যও তিন হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে।

রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল অবশ্য দাবি করেছেন, এমন কোনও অভিযোগের কথা তাঁর জানা নেই। তিনি বলেন, ‘‘পে-ক্লিনিকে সাধারণ মানুষ নিজেরাই ভিড় করছেন। আমরা কাউকে যেতে বলছি না।’’ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং যেখানে নিখরচায় ক্যানসার চিকিৎসার উপরে এত জোর দিয়েছেন, সেখানে পে-ক্লিনিকে এত ভিড় কি অন্য কোনও বার্তা দিচ্ছে না? তাঁর জবাব, ‘‘এতে আমরা কী করতে পারি? সবটাই মানুষের ইচ্ছা। আমরা রাত ১১টা পর্যন্ত যন্ত্র চালু রেখেও ভিড় সামলাতে পারছি না।’’

কেন রোগীরা যাচ্ছেন পে-ক্লিনিকে? পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে আসা খাদ্যনালীর ক্যানসারে আক্রান্ত এক দিনমজুরের ছেলে বলেন, ‘‘আউটডোরের ডাক্তারবাবু বললেন, পে-ক্লিনিকে গেলে পরের সপ্তাহ থেকে রেডিয়েশন শুরু হবে। তা না হলে ডেট পেতে ছ’মাস লাগবে। এই অবস্থায় আমরা কী করব? চোখের সামনে তো বাবাকে মারা যেতে দেখতে পারব না। তাই কষ্ট করে টাকা জোগাড় করেছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE