আর্সেনিক দূষিত অঞ্চলে বসবাস হলে এমনিতেই স্বাস্থ্যহানির প্রভূত আশঙ্কা। তার উপরে যদি কালাজ্বরে ধরে?
তা হলে সাবধান। কারণ, পানীয় জলের সঙ্গে শরীরে অতিরিক্ত মাত্রার আর্সেনিক ঢুকে থাকলে কালাজ্বরের সর্বাধিক প্রচলিত ওষুধ সোডিয়াম স্টিবোগ্লুকোনেট (এসএসজি) কাজ করবে না বলে দাবি করছেন এক দল গবেষক।
আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এ ওঁদের গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। নিজেদের পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে গবেষণাপত্রের রচয়িতারা দাবি তুলেছেন, আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় কালাজ্বরের রোগীদের উপরে এসএসজি যাতে কোনও ভাবেই প্রয়োগ না হয়, প্রশাসন তা নিশ্চিত করুক।
১৯৯০ থেকে ২০০৬ এই ষোলো বছরে বিহারের আটটি জেলায় কালাজ্বর দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। প্রাণ কেড়েছিল বিস্তর। পরে জানা যায়, আক্রান্তদের নিয়ম মেনে এসএসজি দেওয়া সত্ত্বেও মৃত্যুর স্রোত রোখা যায়নি। অনেকে সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেও রোগ পুরোপুরি নিরাময় না-হওয়ায় কালাজ্বরের বাহক হিসেবেই থেকে গিয়েছেন।
ম্যালেরিয়া জীবাণুর জিনের গঠন বদলে যাওয়ায় (মিউটেশন) একটা সময়ে প্রচলিত ওষুধ নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল। বিহারের পরিস্থিতি দেখে স্বাস্থ্য-কর্তারা ভেবেছিলেন, কালাজ্বরের জীবাণু ‘লিশমানিয়া ডোনোভানি’র ক্ষেত্রেও তেমনই কিছু ঘটেছে। এসএসজি-র বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তারা হয়তো নিজেদের জিনই বদলে ফেলেছে।
এবং এ হেন ভাবনার প্রেক্ষাপটেই এসএসজি নিষিদ্ধ করে কালাজ্বরের নতুন দু’টি ওষুধ বাজারে ছেড়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সেই ইস্তক এসএসজি এ দেশে সরকারি ভাবে নিষিদ্ধই রয়েছে। কিন্তু বিহারের কালাজ্বরে সেটি কেন কাজ করল না, তা অজানা থেকে গিয়েছে। কারণ, কালাজ্বর-জীবাণুর জিনগত পরিবর্তনের গবেষণালব্ধ কোনও প্রমাণ এখনও মেলেনি।
ধাঁধা সমাধানের একটা দিশা এ বার দিয়েছে স্কটল্যান্ড, বেলজিয়াম, স্পেন ও ভারতের সাতটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ ওই গবেষণা, যাতে আর্সেনিক দূষণ ও কালাজ্বরের মধ্যে সম্পর্ক-সূত্র মিলেছে। প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে রয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। তার ‘স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ’-এর বিজ্ঞানী দীপঙ্কর চক্রবর্তী গবেষণাপত্রটির অন্যতম লেখক। তিনি জানিয়েছেন, বিহারে অন্তত দশটি এমন জেলাকে তাঁরা চিহ্নিত করেছেন, যেগুলোয় ভূগর্ভস্থ পানীয় জলে বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিকের পাশাপাশি পরিবেশে কালাজ্বরের জীবাণু বয়ে বেড়ানো স্ত্রী স্যান্ড ফ্লাইয়ের সংখ্যাও প্রচুর। আর ওই সব তল্লাটেই এসএসজি ব্যর্থ হওয়ায় কালাজ্বরে বহু লোকের মৃত্যু হয়েছিল।
আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় কালাজ্বরের জীবাণু কেন এসএসজি-প্রতিরোধী হয়ে উঠল?
উত্তর খুঁজতে প্রথমে ইঁদুরের উপরে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন গবেষকেরা। দেখা যায়, শরীরে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক প্রবেশ করালে তা লিভার ও প্লিহায় সঞ্চিত হচ্ছে। পরে সেই ইঁদুরের শরীরে কালাজ্বরের জীবাণু ঢোকালে জীবাণুর কোষে গিয়েও সঞ্চিত হচ্ছে আর্সেনিক। পরবর্তী
ধাপে কালাজ্বর-আক্রান্ত ইঁদুরগুলোকে এসএসজি দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা হয়। দেখা যায়, ওষুধ কাজ করছে না। কেন?
গবেষকদের ব্যাখ্যা: এসএসজি-র রাসায়নিক গঠনের অন্যতম মূল উপাদান হল অ্যান্টিমনি, যার রায়ায়নিক গঠন আবার অনেকটা আর্সেনিকের সঙ্গে মিলে যায়। দুটোই তিন ও পাঁচ যোজ্যতার (ভ্যালেন্সি) মৌল। তাই কালাজ্বর-জীবাণুর কোষে যদি একই যোজ্যতার আর্সেনিক আগাম ঢুকে বসে থাকে, তা হলে অ্যান্টিমনিযুক্ত এসএসজি আর জীবাণু-কোষে প্রবেশ করতে পারে না। ওষুধ নিষ্ফল হয়ে যায়।
পরবর্তী পর্যায়ের কাজের জন্য গবেষকেরা বেছে নিয়েছিলেন বিহারের সমস্তিপুর জেলার এক গ্রামকে। মহিউদ্দিননগর নামে গ্রামটিতে ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে কালাজ্বর ব্যাপক ভাবে ছড়িয়েছিল। গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তথ্যানুসারে আক্রান্তদের তালিকা তৈরি হয়। যাঁরা এসএসজি খেয়েছিলেন, তাঁদের দিয়ে সমীক্ষা শুরু হয় ২০১২-য়। এবং গবেষকদের দাবি: আক্রান্তদের থেকে পাওয়া তথ্যাদি বিশ্লেষণ করেও এসএসজি’র নিষ্ক্রিয়তার সঙ্গে পানীয় জলের আর্সেনিক-দূষণের দৃঢ় সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে।
আর্সেনিক দূষণের এই নতুন বিপদ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে হুঁশিয়ার করেছেন গবেষকেরা। তাঁদের আশঙ্কা, বিস্তারিত সমীক্ষা চালালে বিহারের আরও কয়েকটি জেলা তো বটেই, বাংলাদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন আর্সেনিকগ্রস্ত এলাকার যেখানে যেখানে কালাজ্বরের প্রকোপ (যেমন উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ), সেখানেও একই ছবি মিলবে। সরকারি ভাবে কালাজ্বরের চিকিৎসায় এসএসজি ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেলেও গ্রামাঞ্চলের কোথাও কোথাও তার চল রয়েছে। কিন্তু সেখানে আর্সেনিকের দূষণ থাকলে এর পরিণতি যে ভয়াবহ হতে পারে, দীপঙ্করবাবুদের গবেষণায় সে ইঙ্গিত স্পষ্ট।
এখন কালাজ্বরের চিকিৎসায় এসএসজি-র পরিবর্তে অন্য যে দু’টি ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে অবশ্য অ্যান্টিমনি নেই। ফলে আর্সেনিকপ্রবণ অঞ্চলে তা প্রয়োগ করতে কোনও সমস্যা নেই বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy