Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

একা আয়া ‘রক্ষা’ করে হাজার রোগীর গড়

শৌচাগারে যেতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন ৭৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। এর জেরেই মৃত্যু হয় তাঁর। মাস কয়েক আগে এসএসকেএম হাসপাতালের ঘটনা। একা একা শৌচাগারে যেতে গিয়েই ঘটেছিল এই বিপত্তি। কারণ ওই বৃদ্ধকে দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন যে মহিলা, তিনি তখন ব্যস্ত ছিলেন অন্য আরও পাঁচ রোগীকে নিয়ে।

সৌভিক চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৫ ০০:৩৮
Share: Save:

শৌচাগারে যেতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন ৭৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। এর জেরেই মৃত্যু হয় তাঁর। মাস কয়েক আগে এসএসকেএম হাসপাতালের ঘটনা। একা একা শৌচাগারে যেতে গিয়েই ঘটেছিল এই বিপত্তি। কারণ ওই বৃদ্ধকে দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন যে মহিলা, তিনি তখন ব্যস্ত ছিলেন অন্য আরও পাঁচ রোগীকে নিয়ে।

মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগ। জল খাবেন বলে ছটফট করছেন শিয়ালদহের বাসিন্দা প্রকাশ পাল। সদ্য অস্ত্রোপচার হওয়ায় এখনও একা একা হাঁটতে পারেন না। অথচ তাঁকে দেখভাল করার জন্য যে মহিলা সকালেই দেড়শো টাকা নিয়েছেন, তাঁর কোনও পাত্তা নেই। আধ ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষার পরে তুলনামূলক সুস্থ এক রোগী জল দিলেন প্রকাশবাবুকে।

এই দুই মহিলারই পরিচয় হাসপাতালের ‘স্পেশ্যাল অ্যাটেন্ড্যান্ট’। চলতি কথায় আয়া। রোগীকে স্নান করানো, খাওয়ানো, জামাকাপড় কাচা, রোগীকে পরিষ্কার রাখার মতো নানা কাজ— এক কথায় রোগীকে দেখভাল করেন এঁরা। বিনিময়ে সরাসরি টাকা নেন রোগীর কাছ থেকে। শহরের যে কোনও সরকারি হাসপাতালেই এঁদের দেখা মিলবে। অভিযোগ, এঁদের জুলুমেই দীর্ঘদিন ধরে অস্থির রোগী ও তার পরিজনেরা। বারেবারেই অভিযোগ উঠেছে আয়াদের গাফিলতিতে সমস্যায় পড়ছেন রোগীরা। কখনও বা প্রাণসংশয়ও ঘটেছে রোগীদের।

স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, বাম জমানাতেই আয়া নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তার বদলে এখন রোগীর সঙ্গে এক জন করে বাড়ির লোক থাকতে পারেন। তা সত্ত্বেও আজও ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে রমরম করে চলছে আয়া-রাজ। রোগীকে আয়াপিছু দিতে হয় একশো থেকে দেড়শো টাকা। কিন্তু টাকা নিয়েও যে আয়ারা রোগীর যথাযথ পরিচর্যা করবেন, এমনটা নয়। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক এক জন আয়া কমপক্ষে চার-পাঁচ জন রোগীর দায়িত্ব নেন। কখনও কখনও সংখ্যাটা বেড়ে আট-নয়ে গিয়েও দাঁড়ায়। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই রোগীরা ন্যূনতম পরিষেবাটুকুও পান না আয়াদের কাছ থেকে। তার উপরে কোনও রোগী যদি কিছু বেশি টাকা দেন, তা হলে সবটা যত্ন তিনিই পান, এমনটাও অভিযোগ। বাকিদের কপালে তখন জোটে দুর্ব্যবহার।

প্রশ্ন উঠছে, সরকারি ভাবে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কী ভাবে হাসপাতালে আছেন আয়ারা?

হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীদের একাংশের মত, পরিকাঠামোর অভাবেই আয়াদের এই বাড়বাড়ন্ত। হাসপাতালের বেশির ভাগ ওয়ার্ডেই শয্যা ছাপিয়ে মেঝেতেও রোগীদের ভিড়। আর রোগী এবং নার্সের অনুপাত ইন্ডিয়ান নার্সিং কাউন্সিলের নির্ধারিত অনুপাতের (আইএনসি অনুসারে নার্স ও রোগীর অনুপাত হওয়া উচিত প্রতি পাঁচ রোগী পিছু এক জন নার্স) চেয়ে অনেক কম। সে কারণেই রোগীদের পরিচর্যা করার জন্য বাইরের লোকের সাহায্য নিতে হচ্ছে। এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘যদি আয়াদের স্বীকৃতি দিয়ে একটি নির্দিষ্ট নিয়মের আওতায় আনা যায়, তা হলে অনেক সমস্যা এড়ানো যাবে।’’ আর জি কর হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডের এক সিস্টার ইন-চার্জ বলেন, ‘‘জানি আয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু কী করব? রোগীদের দেখাশোনা করার লোক নেই। যাই করুক, ওরাই ভরসা। সুপারকে বলুন পাঁচ জন নার্স দিতে, এখনই ওদের বার করে দিচ্ছি।’’

কর্মী এবং চিকিৎসকদের অপর অংশ অবশ্য বলছে, শুধু নার্সের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না। সমস্যার বীজ আরও গভীরে। দীর্ঘদিন ধরেই হাসপাতালে আয়া জোগান দেওয়া নিয়ে গড়ে উঠেছে অসাধু চক্র। এতে যুক্ত আছেন হাসপাতালের কিছু চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। মদত আছে এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের। গড়ে উঠেছে ইউনিয়নও। সূত্রের খবর, হাসপাতালে আয়া নিযুক্ত হয় এই ইউনিয়নের মাধ্যমেই। কর্মরত অবস্থায় যদি কোনও আয়া মারা যান বা কাজ ছেড়ে দেন, সেই খালি জায়গায় নতুন লোক নেওয়ার জন্য মোটা টাকা হাঁকে ইউনিয়ন। আয়ারাও মেনে নিচ্ছেন এই কথা। তাঁরা জানাচ্ছেন, টাকা তো নেওয়া হয়ই, তা ছাড়াও অনেক সময়ে চলে আসেন স্থানীয় কাউন্সিলর বা বিধায়কের মনোনীত প্রার্থী। আর এই খুঁটির জোরেই চলে যাবতীয় জুলুম।

সব জেনেও চুপ কেন কর্তৃপক্ষ?

স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমি শুনেছি, কোথাও কোথাও এমনটা হচ্ছে। যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, কড়া ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’’ কিন্তু ব্যবস্থা নেবে কে? হাসপাতালগুলির কর্তারা তো হাসপাতালে আয়ার অস্তিত্ব মানতে নারাজ। আর জি করের সুপার প্রবীর মুখোপাধ্যায়, মেডিক্যাল কলেজের সুপার শিখা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এনআরএসের সুপার আলি আমাম, সকলেই কথা বলছেন এক সুরে। তাঁরা বলছেন, হাসপাতালে কোথাও কোনও আয়া নেই। আর থাকবেই বা কী করে? আয়া তো নিষিদ্ধ। যাঁরা আছেন, তাঁরা সকলেই রোগীর বাড়ির লোক।

যদিও এ দিন এক সরকারি হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে ঘোরাঘুরি করছিলেন সবুজ পাড় সাদা শাড়ি পরা কয়েক জন মহিলা। ‘‘আপনারা কি রোগীর বাড়ির লোক?’’ জিজ্ঞাসা করতেই তাঁরা জবাব দিলেন, ‘‘আমরা আয়া। বাড়ির লোক কি ইউনিফর্ম পরে?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Aya hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE