কোনওটার মেয়াদ ফুরিয়েছিল দু’বছর আগেই। কোনওটার এক বছর আগে। কোনওটার আবার ‘এক্সপায়ারি ডেট’ ছ’মাস আগেই উতরে গিয়েছিল।
কয়েক লক্ষ টাকার এমন সব তামাদি কিট দিয়েই টানা এক বছর ধরে অন্তত ছ’শো রোগীর শরীরে ক্যানসারের প্রকৃতি ও রোগের ব্যাপকতা পরীক্ষার অভিযোগ উঠেছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। মেয়াদউত্তীর্ণ কিট ব্যবহার করলে পরীক্ষার ফল ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে ওই কিটে যাঁদের ক্যানসার পরীক্ষা হয়েছে, তাঁদের পরবর্তীকালে ওই পরীক্ষার ভিত্তিতে সম্পূর্ণ ভুল চিকিৎসা হয়েছে বলেও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
সরকারি তদন্তে এর সত্যতাও প্রমাণিত হয়েছে। গত জুন মাসে তদন্ত শুরু হয়েছিল। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সেই রিপোর্ট জমা পড়েছে। বহর ও গুরুত্বের নিরিখে যাকে রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে একটি বড় মাপের ‘কেলেঙ্কারি’ হিসেবে অভিহিত করছেন অনেকে।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, এই কিটগুলিকে ‘ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি মার্কার’ বলা হয়। হয়তো রোগীকে পরীক্ষা করে চিকিৎসকের মনে হচ্ছে ক্যানসার হয়েছে, কিন্তু বায়োপসিতে ধরা পড়ছে না। অথবা বায়োপসি নিশ্চিত ভাবে ক্যানসার বোঝাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে এই ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি পরীক্ষার প্রয়োজন হয়।
প্রস্টেট ক্যানসার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা চিকিৎসক অমিত ঘোষ, ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অনুপ মজুমদার, সুকৃত বসু, গৌতম মুখোপাধ্যায়রা ব্যাখ্যা করে বলেন, অনেক সময় ক্যানসারের ফলে একেবারে নতুন ধরনের কোষ তৈরি হয়। তখন সেই কোষের উৎপত্তি বুঝতে ‘ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি মার্কার’ দরকার হয়। অথবা, দু’টি অঙ্গের সংযোগস্থলে কোনও টিউমারে ক্যানসার কোষ মিললে তখন ক্যানসারটি ঠিক কোথাকার বুঝতে ওই পরীক্ষা দরকার।
অমিত ঘোষের কথায়, ‘‘এই পরীক্ষার উপরে ভিত্তি করে সার্জারি হবে, না রেডিওথেরাপি হবে সেটা ঠিক হয়। কেমোথেরাপি দরকার হলে সেটা কতটা, কত সময় ধরে দেওয়া হবে, কোন ওষুধ ব্যবহার হবে— অর্থাৎ পুরো চিকিৎসা প্রক্রিয়াটা নির্ধারিত হয়। মেয়াদউত্তীর্ণ কিটে সেটা পরীক্ষা হয়েছে মানে ধরা যেতেই পারে, রোগীদের চিকিৎসাটাই ভুল হয়েছে।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘যে কোনও রোগীদের ক্ষেত্রেই সেটা বিপজ্জনক আর ক্যানসার রোগীদের ক্ষেত্রে এর অর্থ, তাঁদের আরও বেশি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দেওয়া।’’
চিকিৎসক অনুপ মজুমদার আবার বলেন, ‘‘রোগীর ক্যানসার কতটা ছড়িয়েছে, তার ধরন কী রকম, তার জন্য কোন ওষুধ কতটা দিতে হবে, তা ঠিক করা হয় ‘ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি মার্কার’-এর মাধ্যমে। বিশ্বাসই করা যাচ্ছে না যে সেই পরীক্ষায় মেয়াদউত্তীর্ণ কিট ব্যবহার করা হয়েছে!’’ প্রবীণ প্যাথলজিস্ট সুবীর দত্তের পর্যবেক্ষণ, ‘‘এটি সম্পূর্ণ মেডিক্যাল এথিক্সের পরিপন্থী একটি ঘটনা। একমাত্র অসৎ লোকেরা এটা করে থাকে, কারণ এটা করলে কিছুতেই চিকিৎসা ঠিক হতে পারে না।’’ এই রকম গর্হিত ঘটনা ঘটল, তদন্তে তা প্রমাণিতও হল, তার পরেও কেন স্বাস্থ্য দফতর নিশ্চুপ? কেন দোষী চিকিৎসকদের ন্যূনতম শাস্তিও দেওয়া হল না? ৬০০-র বেশি রোগীর ‘ভুল’ চিকিৎসার আশঙ্কার দায় কেন স্বাস্থ্য দফতর নেবে না? এই সব প্রশ্নে স্বাস্থ্য দফতরের তরফে কোনও প্রশ্নেরই নির্দিষ্ট জবাব মেলেনি। ‘‘আমাদের যা করণীয়, ঠিক করব। আপনাদের যা লেখার, লিখে দিন।’’— বলেছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। আর স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘‘আমি এ ব্যাপারে কিছু শুনিনি।’’ ব্যাপারটা এখানেই কার্যত ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে।
কিট-কাণ্ডের তদন্ত কমিটিতে ছিলেন এসএসকেএমের ফার্মাকোলজির চিকিৎসক অমলকান্তি দাস, কমিউনিটি মেডিসিনের মলয় মুন্ডেল ও প্যাথলজি’র উত্তরা চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের মুখেও কুলুপ। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, প্রভাবশালী কিছু রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রীর চাপেই এ ব্যাপারে কোনও ব্যবস্থার পথে হাঁটতে পারছেন না স্বাস্থ্য কর্তারা।
স্বাস্থ্য দফতরের তদন্ত-রিপোর্টে লেখা হয়েছে, ‘এটা প্রমাণিত যে, মেয়াদ-উত্তীর্ণ কিট ব্যবহার হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকও তা মেনে নিয়েছেন। তবে উনি কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে এটি করেননি। দামি কিটগুলি মেয়াদউত্তীর্ণ হয়ে নষ্ট হচ্ছিল, তাই ব্যবহার করেছেন। তা ছাড়া উনি বেশ কিছু রিপোর্ট, তথ্য, জার্নাল ইত্যাদি পেশ করে দাবি করেছেন, এতে কোনও ক্ষতি হয় না।’
প্রশ্ন হল, ৩০-৩৫ হাজার টাকা দামের এক-একটা কিট কেন সময়মতো ব্যবহার হল না? মেয়াদউত্তীর্ণ হওয়ার পর কেন তা ফেলে না দিয়ে রোগীদের ক্যানসার পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যবহার হবে এবং তার জন্য রোগীদের থেকে দেড় হাজার টাকা করে নেওয়া হবে, তারও উত্তর দিতে পারেননি স্বাস্থ্যকর্তারা।
স্বাস্থ্যভবন ও মেডিক্যাল কলেজ সূত্রের খবর: ২০১১-১২ অর্থবর্ষে মেডিক্যালের অঙ্কোপ্যাথলজি বিভাগ ক্যানসার পরীক্ষার অত্যন্ত দামি ১৭টি কিট কিনেছিল। অভিযোগ: কেনার আগে ভেবে দেখা হয়নি, হাসপাতালে তার প্রয়োজন কতটা। পড়ে থেকে থেকে শেষমেশ ছ’টি কিটের মেয়াদ পেরিয়ে যায়। সেগুলো তখন পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্যাথলজি বিভাগে। সেখানে তা দিয়েই ২০১৩ সালের বিভিন্ন সময়ে বহু রোগীর পরীক্ষা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মেডিক্যাল কলেজে প্যাথলজি’র বিভাগীয় প্রধান সর্বাণী চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘যা করেছি, কর্তৃপক্ষকে জানিয়েই করেছি। আর একটা কথাও বলব না।’’ মেডিক্যালের অধ্যক্ষ তপনকুমার লাহিড়ীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘নো কমেন্টস।’’ উল্লেখ্য, এই সর্বাণীদেবী গত মে মাসে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে বদলি হলেও এখনও সেখানে যাননি। এ ব্যাপারে তপনবাবুর উত্তর, ‘‘সরকারি অর্ডার থাকলেও যখন আমরা মনে করব তখন ওঁকে উত্তরবঙ্গে পাঠানো হবে।’’
প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কিট নিয়ে অনিয়ম আগেও হয়েছে। যেমন, ২০০৬-এ ফাঁস হয়েছিল মনোজাইম কিট কেলেঙ্কারি। সে বছর স্বাস্থ্য দফতরের অধীন ‘এড্স নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা’-কে প্রায় এক লক্ষ কিট সরবরাহ করে মনোজাইম ইন্ডিয়া নামে এক বেসরকারি কোম্পানি, যেগুলোর মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছিল ২০০৫-এ। শোরগোল হওয়ায় সরকার মনোজাইম কিট নিষিদ্ধ করে। সংস্থার মালিক কিছু দিন জেলে কাটিয়ে জামিন পান। মামলাটি এখনও চলছে।
প্রশ্ন উঠেছে, ওই ঘটনায় যদি তদানীন্তন রাজ্য সরকার ফৌজদারি মামলা করতে পারে, এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য দফতর কেন পুলিশের কাছে গেল না?
স্বাস্থ্যভবন সূত্রের ইঙ্গিত, ‘‘যে ভাবে রাজনৈতিক চাপ আসছে তাতে তদন্তটাই হত না। এটুকুও হয়েছে মেডিক্যালের প্যাথলজি’র কিছু ডাক্তার সরব হওয়ায়। এখানেই হয়তো বিষয়টায় ইতি পড়বে। যে বিপুল পরিমাণ রোগীর চিকিৎসার ক্ষতি হল তার বিচার আর হবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy