ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের পাশাপাশি এ বার পুজোর মুখে রাজ্যে আবার হানা দিয়েছে সোয়াইন ফ্লু।
প্রায় দেড় বছর পরে সোয়াইন ফ্লু-র ফিরে আসার কথা স্বীকার করেছে স্বাস্থ্য দফতর। গত কুড়ি দিনে কলকাতার বাইপাসের ধারে এক বেসরকারি হাসপাতালে এমন তিন জন রোগী ভর্তি হয়েছেন, যাঁদের দেহে সোয়াইন ফ্লুয়ের ভাইরাস এইচ-ওয়ান-এন-ওয়ান (H1N1) মিলেছে।
তাঁদের এক জন ঝাড়খণ্ডের ধানবাদের বাসিন্দা হলেও বাকি দু’জনের মধ্যে এক জন হাওড়ার সালকিয়া ও অন্য জন বর্ধমানের আসানসোল শহরের বাসিন্দা। তবে ধানবাদের বাসিন্দা, ৫৮ বছরের সেই রোগী মারা গিয়েছেন ২০ সেপ্টেম্বর। বাকি দু’জনের শারীরিক অবস্থাও সঙ্কটজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
কিন্তু দু’জন সোয়াইন ফ্লু আক্রান্ত রোগীর খবর পাওয়ার পরেও রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর কোনও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। শুরু করেনি কোনও সচেতনতা অভিযানও। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়েছে। এমনকী যে দুই জেলার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, সেই বর্ধমান এবং হাওড়া জেলার স্বাস্থ্যকর্তাদেরও মঙ্গলবার পর্যন্ত স্বাস্থ্য দফতর থেকে কিছু জানানো হয়নি। অথচ ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ওই বেসরকারি হাসপাতালের কর্তারা স্বাস্থ্যভবনে রোগ সম্পর্কে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু খোদ স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী জানিয়েছেন, এত গুরুতর বিষয় সম্পর্কে ছোঁয়াচে রোগের বিভাগের কর্তারা তাঁকেই অবহিত করেননি।
মঙ্গলবার সংবাদপত্রের তরফে খোঁজ শুরু হলে স্বাস্থ্য অধিকর্তা এ ব্যাপারে জানতে পারেন। তাঁর কথায়, “আমি সংশ্লিষ্ট অফিসারদের কাছে জবাবদিহি চেয়েছি। সেই সঙ্গে জেলাগুলিকে অবিলম্বে সতর্ক করতে বলেছি।” সোয়াইন ফ্লুয়ের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যভবনের ‘ইন্টিগ্রেটেড ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’ সেলের কর্তারা যে রকম ঢিলেঢালা মনোভাব দেখিয়েছেন, তাতে তাঁদেরও কেন শাস্তি হবে না, উঠছে সেই প্রশ্নও।
সোয়াইন ফ্লুয়ের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মাধ্যমে ফুসফুস-শ্বাসনালি আক্রান্ত হয়। ধীরে ধীরে অন্য অঙ্গে রোগ ছড়ায়। লক্ষণ সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই প্রবল জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, ক্লান্তি। ২০০৯ সালে প্রথম ভাইরাসের চরিত্র পাল্টে শুয়োর থেকে মানুষে রোগ ছড়ায়। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এটি ছড়াতে পারে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ২০০৯ সালে রাজ্যে প্রথমে ৬৩ জন এতে আক্রান্ত হন। মারা যান ৫ জন। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে সোয়াইন ফ্লুয়ে রাজ্যে ৪০ জনের বেশি মানুষ আক্রান্ত হন। মারা যান ৩ জন।
সেই সময় বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতালে বিশেষ ‘কোয়ারেন্টাইন ওয়ার্ড’ খোলা হয়েছিল। আই ডি এবং সব মেডিক্যাল কলেজে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসা রোগীদের পরীক্ষার জন্য আলাদা আউটডোরও চালু হয়েছিল। এমনকী, যে সব স্বাস্থ্যকর্মী এই রোগীদের চিকিৎসায় নিযুক্ত ছিলেন, তাঁদেরও ওষুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা হয়েছিল।
স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে, সোয়াইন ফ্লুয়ের খবর জানার পরে পাঁচ দিন কেটে গেলেও কেন আই ডি হাসপাতালে নতুন করে কোয়ারেন্টাইন ওয়ার্ড তৈরির তোড়জোড় হল না? রাজ্যের ভাঁড়ারে এই মুহূর্তে সোয়াইন ফ্লুয়ের ওষুধ বাড়ন্ত। কেন তা কেনার ব্যবস্থা হল না? কেন অন্তত হাওড়া ও আসানসোলের হাসপাতালগুলিতে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসা রোগীদের সোয়াইন ফ্লু পরীক্ষার ব্যবস্থা হল না? কেন রোগীদের বাড়ি গিয়ে আক্রান্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে এখনও খোঁজ নেননি স্বাস্থ্যকর্তারা?
স্বাস্থ্য দফতরের ছোঁয়াচে রোগ বিভাগের নোডাল অফিসার দীপঙ্কর মাজির বক্তব্য, “খবর পাওয়ার পরে যা ব্যবস্থা নেওয়ার নিচ্ছি। যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের বাড়ির লোকের উপরে নজর রাখা হচ্ছে। সোয়াইন ফ্লু এখন আর বড় আকার নেওয়ার ভয় নেই। যা হওয়ার দু’বছর আগে হয়ে গিয়েছে। এখন হলে বিক্ষিপ্ত ভাবে হবে। ভয়ের কিছু নেই।” কিন্তু ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাইরাস তার চরিত্র পরিবর্তন করে নতুন কোনও চরিত্র পেল কি না, বা চরিত্র পরিবর্তিত হলে তার থেকে নতুন কোনও ভয় তৈরি হল কি না, সে সব আগে দেখতে হবে স্বাস্থ্যকর্তাদের। তার কিছুই এখনও হয়নি।
যে হাসপাতালে এখন দুই আক্রান্ত রয়েছেন, সেখানকার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, হাসপাতালের মধ্যেই কোয়ারেন্টাইন ইউনিট তৈরি করে তাঁদের রাখা হয়েছে। হাওড়ার আক্রান্তের বয়স ৭০ আর আসানসোলের ৬৪। হাওড়ার রোগী ভর্তি হন ১৮ সেপ্টেম্বর। ২০ সেপ্টেম্বর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টারিক ডিজিজেস’ (নাইসেড)-এ রক্ত ও থুতু পরীক্ষায় H1N1 পাওয়া যায়। রোগী প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে এখন ভেন্টিলেশনে আছেন। আর আসানসোলের রোগী ভর্তি হন ১ সেপ্টেম্বর। নাইসেড-এ পরীক্ষায় তাঁর দেহে ভাইরাস মেলে ১৮ সেপ্টেম্বর। তাঁরও শ্বাসকষ্ট রয়েছে। ডায়ালিসিস চলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy