Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সমীক্ষা

মনোরোগ বাড়ছে নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে

কলকাতার খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে মানসিক রোগের প্রকোপ বাড়ছে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৫ ০০:৩৪
Share: Save:

কলকাতার খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে মানসিক রোগের প্রকোপ বাড়ছে।

প্রধানত স্কিৎজোফ্রেনিয়া, অবসাদ, ফোবিয়া, প্যানিক ডিজর্ডার, সাইকোসিস, সাইকোসোমাটিক ডিজর্ডার-এ আক্রান্তদের একটা বড় অংশ আর্থ-সামাজিক কারণে চিকিৎসা পরিষেবার সুবিধা নিতে পারছেন না, রোগ বেড়ে যাওয়ায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছেন শহরের রাস্তাঘাটে।

সম্প্রতি কলকাতা পুরসভা এবং আশ্রয়হীন মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরেদের নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার যৌথ সমীক্ষায় এই তথ্য সামনে এসেছে।

কেন আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষের বিভিন্ন ধরনের মনোরোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ছে? মনোচিকিৎসক এবং মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, এর কারণ মূলত দারিদ্র, অনিশ্চয়তা, অজ্ঞতা, অশিক্ষা, কুপরিবেশের মধ্যে প্রথিত। কলকাতা পুরসভা ২০১২ সালের জুলাই মাসে ‘ঈশ্বর সংকল্প’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে মউ (মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং) সই করে কলকাতার দু’টি ওয়ার্ডের পুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাইলট প্রকল্প হিসেবে মানসিক রোগের চিকিৎসা পরিষেবা শুরু করেছিল। যে দুই ওয়ার্ডের পুর ক্লিনিককে বাছা হয়েছিল, সেই দু’টিতে মূলত নিম্ন আয়ের মানুষ ও বস্তিবাসী মানুষের বাস- ৭৮ নম্বর ওয়ার্ড (একবালপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা) এবং ৮২ নম্বর ওয়ার্ড (চেতলা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা)। গত মাসে এই দুই ক্লিনিকের যে সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা শ্রেণির মধ্যে ব্যাপক হারে মানসিক রোগ ছড়ানোর বিষয়টি স্পষ্ট ভাবে বোঝা গিয়েছে।

‘ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রি’-র প্রধান প্রদীপ সাহা-র ব্যাখ্যায়, অভিভাবকদের অযত্ন, ক্রমাগত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, খাবার, টাকাপয়সা, শিক্ষা, নিরাপত্তার অভাবে জর্জরিত থাকেন। অনেকেই পারিবারিক হিংসার শিকার হন। সেখান থেকেই মানসিক সমস্যার সূত্রপাত। চিকিৎসক জয়রঞ্জন রামের মন্তব্য, ‘‘এঁদের চারপাশে অসামাজিক কাজকর্ম বেশি হয়, কাজের সংস্থান ও পরিবার প্রতিপালন নিয়ে এঁরা অসম্ভব মানসিক চাপে থাকেন। তার থেকে রোগ বাড়ে। দারিদ্রের কারণে মানসিক চাপ, তার থেকে মানসিক রোগ। আবার মানসিক রোগ হয়েছে বলেই কর্মক্ষমতা হ্রাস এবং দারিদ্র বৃদ্ধি— এটা একটা দুষ্ট চক্রের মতো।’’

মানসিক অসুস্থতা মনের রোগ নাকি মাথার রোগ? কোন ডাক্তার কোথায় দেখাতে হবে? কী ভাবে ওষুধ খেতে হবে? এই ধারণাগুলিই এই শ্রেণির মানুষের অধিকাংশের মধ্যে থাকে না বলে মনে করছেন কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা তপনকুমার মুখোপাধ্যায়। রোগীর পরিবারের সদস্যরা নিজেরাই জীবনযুদ্ধে এতটা জর্জরিত যে রোগীকে সঙ্গে করে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, কাজের দৈনিক ভাতা লোকসান করে ঠায় আউটডোরে বসে থাকা, বাড়িতে রোগীকে চোখে-চোখে রাখা, ধৈর্য ধরে নিয়ম করে টানা ওষুধ খাওয়ানোর মতো লোক থাকে না। উচ্চবিত্ত মানুষদের সেটা থাকে। রোগ দেখা দেওয়ার পরে প্রথম চিকিৎসকের কাছে যেতে বা চিকিৎসা শুরু করতেই অনেক নিম্নবিত্ত পরিবার এত দেরি করে যে, রোগীর অবস্থার অবনতি হয় এবং পরে ওষুধ দিয়েও তাঁকে পুরো সুস্থ করা যায় না।

মনোবিদ মোহিত রণদীপ, অমিত চক্রবর্তীদের ব্যাখ্যায়, মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদের ৮০ শতাংশই নিম্নবিত্ত গোষ্ঠীর মানুষ। বিশেষ করে এঁদের বাড়ির মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্য অত্যন্ত অবহেলিত। এঁদের মনের অবসাদ, চাপের কথা খুলে বলার জায়গাও নেই, নেই বাইরের জগৎ সম্পর্কে পরিচিতি। এঁদের চিকিৎসার জন্য পুর স্বাস্থ্য ক্লিনিকের মতো নাগালের মধ্যে ‘কমিউনিটি হেলথ সেন্টার’-এর গুরুত্ব অপরিসীম।

২০১২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডের পুর স্বাস্থ্য ক্লিনিকে এলাকার ১০০৪ জন মানুষের মানসিক চিকিৎসা হয়েছে। এঁদের প্রত্যেকেরই আর্থ-সামাজিক অবস্থানের রেখচিত্র নীচের দিকে। অন্য দিকে, ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮২ নম্বর ওয়ার্ডের পুর স্বাস্থ্য ক্লিনিকে ৪৬৫ জনের মানসিক রোগের চিকিৎসা হয়েছে। দুই ওয়ার্ডের রোগীদের প্রায় ৪০ শতাংশের মাসিক আয় মাসে মোটে ২ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যে।

দারিদ্রের মধ্যেই যদি মানসিক রোগের শিকড় গাঁথা থাকে তবে সেই দারিদ্র থেকে মানুষকে উঠিয়ে আনতে সরকার কি প্রচেষ্টা নিচ্ছে? সমাজকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজা বলেন, ‘‘সামগ্রিক ভাবে সেই অর্থে আমাদের কোনও প্রকল্প নেই। তবে দরিদ্র মেয়েদের নিখরচায় বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে আর্থিক ভাবে সাবলম্বী করতে আমাদের একাধিক প্রকল্প চলছে।’’ এটা যথেষ্ট নয় মানছেন সকলেই। আপাতত তাই কলকাতার আরও ২০টি ওয়ার্ড স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মানসিক চিকিৎসা শুরু করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Psychological illness doctor kolokata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE