আস্ত একটা শহরকে যেন সমুদ্রের বুকে কেউ বসিয়ে দিয়েছে। আর সেখান থেকে ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে আমেরিকা!
আস্ত শহর ছাড়া আর কী! সামরিক পরিভাষায় নাম এয়ারক্র্যাফট সুপার ক্যারিয়ার। কিন্তু আসলে কার্ল ভিনসন একটা ছোট ভাসমান শহর। যেখানে মোটের উপরে পাওয়া যায় সেই সব জিনিসপত্র, সুবিধে ও পরিষেবা, যা আমেরিকার যে কোনও শহরে মিলবে। খাবার-দাবারের ধরন, কড়া কফির কটূ গন্ধ, শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, পরিচ্ছন্নতা, সংস্কৃতি, পেশাদার মনোভাব এবং অবশ্যই শত্রুকে খতম করার অঙ্গীকার— এখানে এ সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, মার্কিন মুলুকের কোনও জায়গায় পৌঁছে গেলাম না তো! বিশেষ করে যেখানে চার হাজার আটশো মানুষের বসবাস!
তফাতটা শুধু এই যে, কার্ল ভিনসন নামে শহরটা পারস্য উপসাগরের সুনীল জলরাশির ঢেউ কেটে গড়ে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার বেগে চলেছে। আর এই শহর থেকে এফ-এ এইটিন সি হর্নেট, এফ-এ এইটিন এফ সুপার হর্নেট কিংবা ইএ-এইটিন জি গ্রোলার-এর মতো মোটের উপরে রোজ ২৪-২৫টা বোমারু উড়ে কমপক্ষে পাঁচশো কিলোমিটার পথ উজিয়ে গিয়ে বোমা ফেলে আসছে ইরাক কিংবা সিরিয়ায় আইএস-এর কোনও ঘাঁটিতে।
কার্ল ভিনসন আসলে সাড়ে চার একরের চলমান এক মার্কিন মুলুক। এর প্রতিটি পরতে আমেরিকার শক্তি ও পরাক্রমের প্রবল প্রকাশ।
পারমাণবিক বিদ্যুতে চালিত (দু’টি পরমাণু চুল্লি আছে) এই বিমানবাহী জাহাজের ওজনই ৯৮ হাজার টন। অর্থাত্ ন’কোটি আশি লক্ষ কিলোগ্রাম। কার্ল ভিনসনে এক সঙ্গে থাকে ৬৩টি বিমান, যার মধ্যে ৪৪টি বোমারু। এদের ওড়া ও নামার জায়গা বা রানওয়ের নাম ফ্লাইট ডেক। হেড গিয়ার চাপিয়ে, গগলস পরে এবং অবশ্যই কানে ইয়ার প্লাগ গুঁজে ও তার উপরে ইয়ার প্রোটেক্টর চড়ালে তবেই সেখানে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। ষোলো তলা কার্ল ভিনসন-এর ফ্লাইট ডেক সাত তলায়। জাহাজের ১৩ থেকে ১৮— এই সাত তলা রয়েছে সমুদ্রের নীচে। ১২ তলায় রয়েছে পাঁচ-পাঁচটি ক্যান্টিন। তবে ক্যান্টিন না বলে পুরোদস্তুর পাঁচতারা রেস্তোরাঁ বলাই ভাল। লাঞ্চ ও ডিনারে প্রতি বারই ৫০ রকম পদ। স্যালাড বার থেকে বিফ স্টেক, তাজা হরেক রকম ফল থেকে চিজ কেক, বেক্ড ফিশ থেকে সিদ্ধ সব্জি— কী নেই! প্রতিটি টেবিলে সস-ই ১৫ রকমের। যে যত খুশি খাও। পদমর্যাদার ভিত্তিতে খাবারে ভেদ নেই। তবে ক্যাপ্টেন তথা কম্যান্ডিং অফিসার ব্যতিক্রম। তাঁর জন্য নিযুক্ত আলাদা রাঁধুনিকে দিয়ে তিনি নিজের মতো পদ রান্না করাতে পারেন।
কাকতালীয় ভাবে কার্ল ভিনসন-এর কম্যান্ডিং অফিসারের নামও কার্ল। ক্যাপ্টেন কার্ল টমাস। তিনি জানালেন, গত জুন মাস থেকে এ যাবত্ আইএস-এর বিরুদ্ধে ইরাক ও সিরিয়ায় চালানো বিমান হানার এক হাজারেরও হয়েছে এই এয়ারক্র্যাফট কেরিয়ার থেকে। আনন্দবাজার-সহ চারটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কফি ও কুকি সহযোগে আলাপচারিতার সময়ে ক্যাপ্টেন কার্ল বললেন, “বোমারু বিমানের পাইলটদের পাশাপাশি জাহাজের অফিসার, নাবিক ও টেকনিশিয়ানদের কৃতিত্ব না দিলে অন্যায় হবে। ওরাই কিন্তু কার্ল ভিনসনকে ধরে রেখেছে। আমেরিকার গর্ব যেমন কার্ল ভিনসন, তেমনই কার্ল ভিনসনের গর্ব ওরা।”
এখানে পৌঁছনোর আগের দিন দুপুরেই বাহরাইনে, সদর দফতরে বসে মার্কিন নৌবাহিনীর সেন্ট্রাল কম্যান্ড-এর ডেপুটি কমান্ডার রিয়ার অ্যাডমিরাল জেমস লোবলাইন বলছিলেন, “আপনারা আগামিকাল কার্ল ভিনসনে যাচ্ছেন। কী দেখবেন, ভাবতে পারবেন না। বিমান ও হেলিকপ্টারের ওঠানামা তো নয়, যেন অর্কেস্ট্রা। আর এই গোটা প্রক্রিয়ার দায়িত্বে যারা রয়েছে, তাদের বয়স ২০ থেকে ২৩ বছরের মধ্যে।”
সকাল সাড়ে ৯টায় বাহরাইন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর লাগোয়া মার্কিন নৌবাহিনীর বিমানঘাঁটি থেকে কড (কেরিয়ার অন বোর্ড ডেলিভারি) বিমানে রওনা হয়ে প্রায় ২২০ কিলোমিটার পথ উজিয়ে সওয়া ১১টা নাগাদ নামা গেল কার্ল ভিনসনে। একই সময়ে সেখানে চলছে বোমারুদের ওড়ানোর প্রস্তুতি। এতটাই দক্ষ ও প্রশিক্ষিত অফিসার ও কর্মীরা। আবার অন্য জাহাজ থেকে যখন টন টন রসদ নিয়ে দু’টি হেলিকপ্টার কার্ল ভিনসনে বার বার নামছে, তখনই একের পর এক উড়ছে বোমারুর দল।
জাহাজের এই সব তুখোড় অফিসার-কর্মীরা যাতে শারীরিক ভাবে নিজেদের সুস্থ-সবল ও চাঙ্গা রাখতে পারেন, সে জন্য রয়েছে ‘জিম’। তাতে ট্রেডমিল, সাইকেল-সহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। ছোটখাটো অপারেশন থিয়েটার, এক্স-রে, রক্ত পরীক্ষার গবেষণাগার, এমনকী রয়েছে দাঁতের চিকিত্সার আলাদা শাখা। সেখানেই দেখা হল দন্ত চিকিত্সক মহম্মদ কামিলের সঙ্গে, যাঁর জন্ম ইলাহাবাদে। ১৯৮৯-তে পড়াশোনার জন্য আমেরিকায় চলে আসেন এবং ১৬ বছর ধরে মার্কিন নৌবাহিনীর ডাক্তার হিসেবে কর্মরত। শুধু ডাক্তারখানা কেন, স্যালনও রয়েছে যুদ্ধবিমান বহনকারী এই জাহাজে।
ময়দানবের কাণ্ড ও দক্ষযজ্ঞের কথা জানা ছিল। কার্ল ভিনসনে এসে মনে হচ্ছে এটা ওই দুয়ের যোগফল। না, ঠিক হল না, তার চেয়ে কিছু বেশিই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy