Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বাগদেবীর আরাধনায় লন্ডন

শেষ হয়ে আসে সরস্বতী পূজো। যদিও খিচুড়ি-বাঁধাকপি-চাটনির কমতি ছিল না। তবু মিস করি পরের দিনের গোটাসেদ্ধকে বা বাঙালবাড়ির জোড়া ইলিশকে। কিংবা পাশের বয়েজ স্কুলের সেই নাম না জানা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা সাদা জামা নীল ফুলপ্যান্টের স্কুল ইউনিফর্ম পরা সেই ছোকরা ছেলেটিকে। লন্ডন থেকে লিখছেন সুচেতনা সরকার।

সুচেতনা সরকার
লন্ডন শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ১৭:৫০
Share: Save:

বিদ্যাদায়িনী আবার হৈ হৈ করে এসে পড়লেন টেমসের দক্ষিণ তীরে। পাটের দড়িকে সুন্দর গাঁথনি দিয়ে স্নিগ্ধ শ্যামবেণী বর্ণা বিদ্যামূর্তি বানিয়েছিল বুঝি কেউ। শান্তিনিকেতন মেলা থেকে ক্রয়ডনের বাঙালি ফুলবাবু এক বার কিনে এনেছিল স্যুটকেস বন্দি করে। ভিসা পাসপোর্টের চক্কর ছাড়াই একমাথা ঝাঁকড়া পাটের ঘন কালো চুল নিয়ে বিদ্যেবতী হাজির হলেন হিথরো বিমানবন্দরে। পরনে পাটেরই বেণী পাকানো শাড়ি, সেও যেন মূর্তির সঙ্গে একসঙ্গে গাঁথা। হাঁসের পিঠে চড়ে গটগট করে সোজা হট্টমূলার গাছে অর্থাৎ ক্রয়ডনের ওল্ড প্যালেস স্কুলে ক্রয়ডন বেঙ্গলি কানেকশনের কুচেকাঁচাদের পাশে।

এ বারে সেখানে থিম ‘আমাকে ভাবায় সুকুমার রায়’। সুমনের গানকে সেলাম দিয়ে হেডলাইনে কবি সুকুমার। ছেলেপুলেরা হেব্বি প্র্যাকটিস করেছে। স্কুল থেকে ফেরার পথে মায়েরা টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছে এর ওর বাড়ি রিহার্সালে। মায়েরা সবে চলে যাওয়া ক্রিসমাসের রেন ডিয়ারের মুখোশ দিয়ে কস্ট্যুম বানিয়েছে রামগরুড়ের ছানার। আউল মাস্কে প্যাঁচা আর প্যাঁচানির সাজে তিন থেকে পাঁচ বছরের খুদে মস্তানগুলো একদম ফাটিয়ে দিচ্ছে যাকে বলা যায়! কুমড়োপটাশের সাজে সাজা কচি পুঁচকেগুলো একদম হেসে কুটিপাটি। লন্ডনে জন্মানো, বড় হওয়া বং টিনএজাররা পরিষ্কার বাংলায় অনুষ্ঠান পরিচালনা করছে। স্বপনদোলা নাচিয়ে আসার জন্য পাগলা ভোলাকে ডাক দিয়েছে আর একদল ফুটফুটে বঙ্গকুচি। নিভৃতবাসিনীর আর আড়ালে থাকার উপায় নেই। ‘বসন্ত এসে গেছে’ সে কথা কি আর কারও অজানা?

ষাটের দশকে আসা প্রথম প্রজন্মের লন্ডনের বাঙালিবাবুরা এখনকার পোস্টমডার্ন বংদের থেকে অনেক বেশি বাঙালি ছিলেন। তাই বিভুঁইতে পা দিয়ে সরস্বতী, দুর্গা, কালী কোনও পুজোতেই পিছপা ছিলেন না তাঁরা। কিন্তু পরের প্রজন্মকে বিশেষ কিছু দিয়ে যেতে পারেননি তাঁরা। সেটা অবশ্য তাদের দোষ নয়। দোষ ঔপনিবেশিকতার। পঞ্জাবি গুজরাতি, মরাঠিরা ভাষা শিখল, গান শিখল, ধর্ম পালন শিখল, কিন্তু বংরা কেন জানি না বঞ্চিত হয়েই রইল। কিন্তু, লন্ডন শহর পেল আবার নতুন এক দল অভিবাসীর স্রোত। তত দিনে ভারত জগত্সভায় বেশ খানিকটা দখল নিয়েছে। একটা ছোট্ট গাঁয়ের আকার নিয়েছে দুনিয়াটা। লন্ডনে তাই বাঙালি এল নানা মত, নানা ভাষা, নানা পরিধানের বিভিন্ন জায়গা থেকে। কেউ এল বম্বে থেকে, কেউ বা মেঘালয়, ত্রিপুরা, অসম কিংবা দিল্লি থেকে। ভুপাল থেকে ভাবনগর, চেন্নাই থেকে চুঁচুড়া সব মিলেমিশে একাকার। তারা কিন্তু বাংলা শেখাতে ভয় পায় না ছেলেপুলেকে। তাদের ভাষার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের মাত্রা একেবারে আলাদা। তাই কুচোগুলো অনায়াসে শিখে নেয় তাদের ‘আ মরি বাংলা ভাষা’কে।


তখন অঞ্জলি দেওয়া চলছে।

তো সেই পাটেবোনা সরস্বতীকে নিয়ে ক্রয়ডনের বাঙালি কানেকশনের আদিখ্যেতার সীমা রইল না। এমনিতে গাঁদাফুলের অভাব নেই। কিন্তু রানি মেরিগোল্ড আসেন মে জুন মাসে— হাড়হিম করা শীতে গাঁদা তো দূর অস্ত, সে রকম ঘরোয়া কোনও ফুলই পাওয়া যায় না। তাই বউ-মেয়েরা কাগজের ফুল গাঁথতে বসল। সেই মালার পাশাপাশি নিজেদের গয়নার বাক্স খুলে মুক্তোর হারে ঢেকে দিল বিদ্যেধরীর শরীর। ঘটে আমশাখার বদলে ঝাউপাতা, আফ্রিকান নারকেলে স্বস্তিকাচিহ্ন এঁকে দিল লিপস্টিক দিয়ে। ব্যস! এ বারের থিম যখন সুকুমার রায় তখন কুচিপুচিরা যে হিজিবিজবিজ বা হুঁকোমুখো হ্যাংলা বা হাঁসজারু এঁকে নিয়ে আসবে তা নিয়ে সন্দেহ কি? বিদ্যেবতীর পাশে বোর্ডে পিন দিয়ে চিপকে দেওয়া হল হযবরল নানা রকম আবোলতাবোল।

এ বারে খাওয়া দাওয়া! এক মাস আগে থেকে বঙ্গপুঙ্গবেরা প্ল্যান করছে আনারকলি, লবঙ্গলতিকা, মনোমোহিনী— এরা অষ্টাদশ শতাব্দীর কোনও সুন্দরী নায়িকা নয়, টুটিং-এর পুজো সুইটসের বিভিন্ন মিষ্টির নাম। মিষ্টি ভাল হলে নাকি লোক মনে রাখে। তাই, মিষ্টির টানেই আবার পরের বছর তারা ফিরে আসবে এই পুজোতে। টুটিং হল আমাদের কাছে ভারতবর্ষ। হিরে থেকে জিরে, লাহৌরি কাবাব থেকে লখনউয়ের বিরিয়ানি বা বাংলাদেশি ভাপা ইলিশ কি নেই এখানে। এখানেই শেষ শয্যা নেন বিখ্যাত এক ভারতীয় শিল্পী। স্মরণীয় মকবুল ফিদা হুসেন। যখন দেবী সরস্বতী তাঁর হাতের তুলিতে মোহময়ী হয়ে ওঠেন— তাই নিয়ে হৈচৈ হয় বিস্তর, কিন্তু শান্তিনিকেতনের পাটেশ্বরীর স্কিনটাইট শাড়ির আউটফিট আমরা ঢেকে দিই নিজেদের গয়নার বাক্স থেকে নানা রকম গয়না দিয়ে। হাতে ফুল নিয়ে চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই এক ক্ষমাসুন্দর দেবীকে যার কাছে নিন্দা-স্তুতি কিছুই পৌঁছয় না। সেই হংসবাহনা দেবীকে দেখে কোনও কবির কামোত্তেজনা জেগে উঠতে পারে— সেই গভীর রাতে নদীর ঘন কালো জলে সৃষ্টি হয় এক অনন্ত কাব্যের। আবার আর এক কবি কালিদাস সুস্বরা এই দেবীকে কলমের কালিতে ভরে নিয়ে লিখে ফেলেন অমোঘ সাহিত্য। সৃষ্টিকর্তা বা কর্ত্রী যিনি আমাদের সত্ত্বায় ভরে দিয়েছেন ‘কনসাসনেস’ তিনি কখনও পোশাকের ধার ধারতে পারেন?

আমাদের ক্রয়ডনবিহারিণী অঞ্জলি নেন আম গ্লোবাল বাঙালির। স্যুভেনির বেণুবীণার পুনর্জন্ম হয় প্রতি বছর এই দিনে। অজস্র কাজের ফল এই স্যুভেনির। নানা রকম লোকাল ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ক্রয়ডনের মেয়র, এমপি সকলে শুভেচ্ছা বাণী পাঠান। রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজের লেখা খুব যত্নসহকারে ছাপানো হয় সেই স্মারকপত্রে।

সাউথ লন্ডন ছাপিয়ে লোক জন আসে। দু’জন বিখ্যাত বাঙালি শিল্পী এই ক্রয়ডনেরই বাসিন্দা। সিরিয়ালের প্রতিটা গান এখনকার গ্লোবাল বাঙালির মুখস্থ— তাই অনুরোধের পর অনুরোধ আসতে থাকে। নতুন অনুষঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত মানুষের চেতনায় আবার আগুন জ্বালে!

শেষ হয়ে আসে সরস্বতী পূজো। যদিও খিচুড়ি-বাঁধাকপি-চাটনির কমতি ছিল না। তবু মিস করি পরের দিনের গোটাসেদ্ধকে বা বাঙালবাড়ির জোড়া ইলিশকে। কিংবা পাশের বয়েজ স্কুলের সেই নাম না জানা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা সাদা জামা নীল ফুলপ্যান্টের স্কুল ইউনিফর্ম পরা সেই ছোকরা ছেলেটিকে। সরস্বতী পুজোর দিনেই একমাত্র তার ছুট ছিল ঝাড়ি করার।

শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছি সে দিনের সেই হারিয়ে যাওয়া দুই বিনুনির সহজ সরল মেয়েটাকে যে তখনও গ্লোবাল হয়নি— একদম ভেতো বাঙালিই ছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE