বিবিসি-তে যোগ দিতে চেয়েছিলেন ব্রিটেনের খ্যাতনামা মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদ এরিক হবসবম। চাকরির জন্য দরখাস্ত পাঠিয়েছিলেন কেমব্রিজ কর্তৃপক্ষের কাছেও। হয়নি কোনওটাই। দু’টি ক্ষেত্রেই বাগড়া দিয়েছিল ব্রিটেনের নিরাপত্তা বিষয়ক গুপ্তচর সংস্থা। অভিযোগ, সাবেক সোভিয়েত গুপ্তচরদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন তিনি।
‘জাতীয় স্বার্থে’ একই রকম কড়া নজরদারি চলেছিল আর এক নামজাদা ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার হিলের উপরেও। এমনই চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে এসেছে ইংল্যান্ডের জাতীয় মহাফেজখানার সৌজন্যে। শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে এত দিন গোপনে রাখা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি।
হবসবম ও হিল। ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন দু’জনেই। প্রকাশিত নথি অনুযায়ী বেশ কয়েক দশক ধরে তাঁদের যাবতীয় গতিবিধির উপর কড়া নজর রেখেছিল ব্রিটেনের গুপ্তচর সংস্থা এমআই ৫। দু’জনেরই ফোনে আড়ি পেতেছিল লন্ডন পুলিশের বিশেষ শাখা। তাঁদের টেলিফোনের যাবতীয় কথোপকথন রেকর্ডে রেখেছিল এমআই ৫। নজর রাখা হয়েছিল ব্রিটেনের তৎকালীন কমিউনিস্ট দলের একটা বড় অংশের সদস্যের উপরও।
সংস্থাটির দাবি, এঁদের গতিবিধি নখদর্পণে রাখতে ‘র্যাটক্যাচার’ নামে বিশেষ এজেন্ট নিয়োগ করা হয়েছিল সেই সময়। হবসবম ও হিলের যাবতীয় গতিবিধি সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য মিলত তার থেকেই।
১৯৪২-এ প্রথম এমআই ৫-এর নজরদারি আওতায় আসেন হবসবম। পরবর্তী কালে ইতিহাসবিদ হিসেবে জগৎজোড়া খ্যাতি পেলেও সেই সময় হবসবম-সহ তাঁর আরও ৩৮ সহকর্মীকে কট্টর মার্ক্সবাদী-র তকমা দিয়ে তাঁদের সম্পর্কে গোপনে তল্লাশি শুরু করে গুপ্তচর সংস্থাটি। ঠান্ডা যুদ্ধ শুরুর আগেই সোভিয়েতের গুপ্তচর হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হন ব্রিটিশ পদার্থবিদ অ্যালান নুন মে। তাঁর সঙ্গে হবসবম-সহ ব্রিটিশ কমিউনিস্ট দলের শীর্ষনেতাদের বেশ ভালই যোগাযোগ ছিল। এই সন্দেহের বশেই শুরু হয় কড়া নজরদারি।
কিন্তু কেন এই সন্দেহ? এ যাবৎ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার হয়ে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগ স্বীকার করে জেলে যান অ্যালান। ১৯৫২-তে ছাড়াও পান। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের দাবি সেই সময় তাঁকে এক রাতের জন্য নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন হবসবম। বস্তুত তার পর থেকেই এই ইতিহাসবিদের উপর নজরদারির মাত্রা বেড়ে যায়। তবে তাঁর কিংবা হিলের বিরুদ্ধে কখনওই দেশের বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পায়নি এমআই ৫। সন্দেহের জের টিকেছিল দীর্ঘদিন। জাতীয় মহাফেজখানার তরফে সম্প্রতি প্রকাশিত নথি অনুযায়ী, ১৯৪৫-এ বিবিসিতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন হবসবম। এমআই ৫ কর্তাদের নির্দেশেই সে বার চাকরিটা হয়নি তাঁর। একই কারণে বিদেশ দফতরে চাকরির জন্য দরখাস্ত পাঠিয়েও বিমুখ হতে হয় তাঁকে।
২০১২ সালে মারা যান হবসবম। একটা সময় দাবি করেছিলেন, এমআই ৫-এর ফাইল তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হোক। তিনি চাননি তাঁর আত্মজীবনীতে কোনও ভুলচুক থাক। শেষ পর্যন্ত ফাইল অবশ্য হাতে পাননি তিনি।
একই রকম ভোগান্তির শিকার হন ক্রিস্টোফার হিল-ও। ১৯৩৫-এ স্নাতকের ছাত্র থাকাকালীন রাশিয়া যান তিনি। ফিরে আসেন প্রায় এক বছর পর। বস্তুত তখন থেকেই তিনি এমআই ৫-এর নজরে। এমনকী ব্রিটেনে পা রাখার মুহূর্তে বিমানবন্দরে তাঁর ব্যাগপত্রেও তল্লাশি চালানো হয়। যদিও আপত্তিকর কিছুই মেলেনি।
১৯৫০-এর একটি রিপোর্টই বরং তাঁকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে। সেখানে বলা হয়, মার্ক্সবাদের প্রতি হিলের আনুগত্যই খারাপ প্রভাব ফেলে তাঁর দাম্পত্য জীবনে। তাঁর প্রথম পক্ষের স্ত্রী ইনেজ দাবি করেন, রাজনীতি করতে গিয়ে জলের মতো অর্থ ব্যয় করেন হিল। এমআই ৫-এর সন্দেহ তৈরি হয় এখান থেকেও।
৫৩-তে মেলে স্বস্তি। ‘অসামান্য ইতিহাসবিদ’ হিসেবেই তাঁকে স্বীকৃতি দেয় এমআই ৫। ৬১-তে হিলের পরমাণু অস্ত্র বিরোধিতা নিয়ে ফের ব্রিটিশ গোয়েন্দারা আপত্তি তোলে। যদিও তা টেকেনি।
যাবতীয় এই নজরদারি অবশ্য হিলের চাকরি বা শিক্ষা জীবনে তেমন কোনও প্রভাব ফেলেনি। হবসবম কিন্তু কেমব্রিজের অধ্যাপক হতে চেয়েও বিমুখ হন। বিবিসি-র চাকরিতে বাগড়া দেওয়া তো বটেই ৬২-তে হবসবমের একটি অনুষ্ঠানের প্রচার নিয়েও আপত্তি তোলে এমআই ৫।
আজীবন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট দলের সদস্য ছিলেন হবসবম। কিন্তু প্রকাশিত নথিতে দাবি করা হয়েছে, এক সময় দলের উপরতলার সঙ্গে বিরোধের কারণে তাঁকে নাকি বহিষ্কার করার কথাও ভাবা হয়েছিল। এবং এই তথ্য মিলেছিল হবসবমের ফোন রেকর্ড থেকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy