Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

স্কুলের বারান্দায় বন্ধুদের রক্তাক্ত লাশ

প্রাণপণে দৌড়চ্ছিল দুই বন্ধু। যে করেই হোক, স্কুলের পিছনের দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। না হলে মৃত্যু নিশ্চিত। হঠাৎই ছুটে এল বুলেট। পর পর দু’টো। তবে গায়ে লাগল না ইরফানের। কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল দু’বারই। মঙ্গলবার পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে জঙ্গি-তাণ্ডব থেকে স্রেফ বরাতজোরে বেঁচে ফিরল দুই ছাত্র ইরফান শাহ ও দানিয়েল। তবে তার পরেও কান্না থামছে না তাদের। পালানোর পথে তারা দেখে এসেছে স্কুলের বারান্দায় পড়ে থাকা বন্ধু, সহপাঠীদের রক্তাক্ত লাশ। কারও দেহে তিনটে, কারও শরীরে আবার চারটে গুলির দাগ।

সংবাদ সংস্থা
পেশোয়ার শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৪
Share: Save:

প্রাণপণে দৌড়চ্ছিল দুই বন্ধু। যে করেই হোক, স্কুলের পিছনের দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। না হলে মৃত্যু নিশ্চিত। হঠাৎই ছুটে এল বুলেট। পর পর দু’টো। তবে গায়ে লাগল না ইরফানের। কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল দু’বারই। মঙ্গলবার পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে জঙ্গি-তাণ্ডব থেকে স্রেফ বরাতজোরে বেঁচে ফিরল দুই ছাত্র ইরফান শাহ ও দানিয়েল। তবে তার পরেও কান্না থামছে না তাদের। পালানোর পথে তারা দেখে এসেছে স্কুলের বারান্দায় পড়ে থাকা বন্ধু, সহপাঠীদের রক্তাক্ত লাশ। কারও দেহে তিনটে, কারও শরীরে আবার চারটে গুলির দাগ।

ইরফান জানিয়েছে, সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ প্রথম গুলির শব্দ শুনতে পায় তারা। তার বয়ানে, “দিদিমণি বলেছিলেন, ও কিছু না। হয়তো সেনা মহড়া চলছে। ফলে চিন্তার কিছু নেই।” কিন্তু আওয়াজ বাড়তেই থাকে। আর সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে আর্তনাদ। ঠিক কী হয়েছে বুঝতে ক্লাসরুমের জানলা খুলে দেয় ইরফানেরই দুই সহপাঠী। মুহূর্তে বদলে যায় তাদের চোখমুখ। ফোঁপাতে শুরু করে দু’জন। “ক্লাসের সামনে তখন পড়ুয়াদের লাশ পড়ে”, কাঁপতে কাঁপতে বলে চলে ইরফান।

ওই দৃশ্য দেখে দরজা খুলে পালাতে গিয়েছিল তার দুই সহপাঠী। পারেনি। তালিবানের গুলি তাদের শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। ইরফানের চোখের সামনে লুটিয়ে পড়ে তারা। দিদিমণি অবশ্য তার মধ্যেই চিৎকার করে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন স্কুলের পিছনের ফটকের কথা। ইরফানের কথায়, “আমাদের ক্লাস থেকে ওই দরজার দূরত্ব প্রায় ২০০ মিটার। যে করে হোক সেখানে পৌঁছতে হবে ভেবে বন্ধু দানিয়েলের হাত ধরে দৌড় লাগাই। ...হঠাৎই বুঝতে পারি সাঁই সাঁই করে দু’টো বুলেট আমার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল”, বলতে বলতেই শিউরে ওঠে বছর দশেকের খুদে। তার পর? ইরফান জানিয়েছে, ফটক পেরোতেই তাদের কান্নার আওয়াজ শুনে বেরিয়ে আসেন এক প্রতিবেশী মহিলা। ঘরে নিয়ে যান দু’জনকে। কিছু ক্ষণ পর স্কুলের ভ্যানের সামনে পৌঁছয় ইরফান-দানিয়েল। তখনই ভ্যানের চালকের কাছ থেকে স্পষ্ট জানতে পারে, তাদের স্কুলে এ দিন নারকীয় হত্যালীলা চালিয়েছে তালিবান।

প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ জানাচ্ছেন, হামলার শুরুটা হয়েছিল আত্মঘাতী বিস্ফোরণ দিয়ে। ক্লাসরুমে নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছিল এক আত্মঘাতী জঙ্গি। তার সঙ্গেই ছিন্নভিন্ন হয় সেই ক্লাসের ৬০ জন পড়ুয়ার দেহ। তার পরই একের পর এক ক্লাসরুমে ঢুকে গুলি ছুড়তে শুরু করে তালিবান। কোথাও আবার এক শিক্ষিকাকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয় তারা। ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া পড়ুয়াদের অনেকেই সে দৃশ্য নিজের চোখে দেখেছিল। তবে তার বর্ণনা দেওয়ার জন্য বেঁচে নেই কেউ। তালিবানের গুলি তাদের ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।

অথচ শুরুর দিকে বিষয়টা ঠাওর করে উঠতে পারেনি ওই সেনা স্কুলেরই আর এক ছাত্র আবদুল্লা জামাল। আঘাত লাগলে কী ভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা করতে হবে, সে নিয়ে তখন তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন কিছু চিকিৎসক। হঠাৎই গুলির আওয়াজ। কী হয়েছে বোঝার আগেই গুলি লাগে আবদুল্লার পায়ে। তার বয়ানে, “দেখছিলাম আর্তনাদ করতে করতে সকলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। আমিও অসহ্য যন্ত্রণায় পড়ে যাই। পরে জানতে পারি, আমার পায়ে গুলি লেগেছে।” ঘটনার কিছু ক্ষণের মধ্যেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। “তখনই দেখি সব বাচ্চার শরীরে বুলেট লেগেছে। রক্তে ভাসছে সকলে” বলে চলে ওই কিশোর।

তবে কিছুই বাড়িয়ে বলেনি। অন্তত তেমনই জানাচ্ছেন কম্বাইন মিলিটারি হাসপাতাল ও লেডি রিডিং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাঁরা জানাচ্ছেন, আহতের সংখ্যা দেড়শো ছুঁইছুঁই। অনেকেরই অবস্থা আশঙ্কাজনক। বাইরে থেকে রক্তের জোগান দিয়েও কুলোনো যাচ্ছে না। এর জেরে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেই আশঙ্কা তাঁদের।

তবে এত কিছু বোঝার অবস্থায় নেই পরিজনেরা। হাসপাতালের এ ঘর থেকে সে ঘর স্রেফ কাছের মানুষজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। ঘটনার পর থেকে কারও ছেলে, কারও মেয়ে, কারও ভাগ্নি আবার কারও ভাইপোর খোঁজ মিলছিল না। হাসপাতালে তাই খোঁজ নিতে এসেছেন অনেকে। কারও কারও সন্ধান মিলেছেও। তবে তাদের বেশিরভাগই বেঁচে নেই। কান্নায় ভেঙে পড়েছেন পরিজনেরা। অবস্থা দেখে চোখ মোছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের কর্মী আখতার আলি। বলেন, “আমার চোদ্দো বছরের ভাইঝি আফাক স্কুলের ভিতর ছিল। এখনও জানি না ও জীবিত না মৃত। ...ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।” একই রকম উদ্বিগ্ন আর এক ছাত্রের মা হুমায়ুন খান। বললেন, “আমার ছেলের কথা কেউ বলতে পারছে না। হাসপাতালেও নেই। হয়তো জঙ্গিদের হাতে পণবন্দি হয়ে রয়েছে।” হাসপাতালে দাঁড়িয়ে যখন হুমায়ুন কথাগুলো বলছিলেন, তখনও জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে পাক সেনাবাহিনী। কারও কারও দাবি, এ দিনের তাণ্ডবে সব চেয়ে বেশি ক্ষতি তাদেরই। কারণ আহত-নিহত স্কুলপড়ুয়াদের বেশিরভাগই তাদের আত্মীয়-পরিজন।

হয়তো সে কারণেই চেয়েও আকাশ থেকে স্কুলে পুরোদস্তুর হামলা চালাতে পারেনি সেনাবাহিনী। শুধু স্কুল-ভবনের উপর দিয়ে টানা উড়ে গিয়েছে কপ্টারগুলো। হামলার আগে তাদের ভাবতে হয়েছে, ভিতরে জঙ্গিদের সঙ্গে রয়েছে তাদেরই আপনজন। লড়াইটা হয়তো এ বার তাই বেশ খানিকটা কঠিনই ছিল পাক সেনাবাহিনীর পক্ষে। ধৈর্য ধরে অভিযান চালায় তারা। বাইরের সেনা বেষ্টনী ভেঙে তখন ঢোকার চেষ্টা চালাচ্ছেন উত্তেজিত মা-বাবারা। তাঁদের আটকে রাখা দায়। কারণ তত ক্ষণে তাঁরা জেনে গিয়েছেন, প্রতিশোধ নিতেই এ বার হামলা চালিয়েছে তালিবান। ফলে সহজে রক্ষা নেই।

হলও তাই। রক্তের বন্যা বয়ে গেল সেনা স্কুলে। “ইউনিফর্ম পরে সকালে স্কুলে এসেছিল আমার ছেলেটা। আর বেরোল কফিনে করে।” মাথা চাপড়ে বিলাপ করে চলেন তাহির আলি। তাঁর বিলাপ ঢাকা পড়ে যায় সমবেত কান্নায়।


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE