দেহ আঁকড়ে ভেঙে পড়েছেন আত্মীয়েরা। রবিবার। ছবি: রয়টার্স
বর্ষবরণের রাতটা হইহই করে কাটাবেন বলে শ’খানেক লোক জড়ো হয়েছিলেন ইস্তানবুলের অভিজাত রেইনা নাইটক্লাবে। কিন্তু রাত ফুরনোর আগেই সান্তা ক্লজের পোশাক পরা বন্দুকবাজের হামলায় রক্তাক্ত হল তুরস্কের নতুন বছরের ভোর। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসা গুলি-বোমা কয়েক মিনিটেই কেড়ে নিল ৩৯টি প্রাণ। আহত অন্তত ৭০। রবিবার বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ টুইটারে জানান, নিহতদের মধ্যে দুই ভারতীয় রয়েছেন। তাঁরা হলেন, প্রাক্তন সাংসদ-পুত্র আবিস রিজভি ও গুজরাতের বাসিন্দা খুশি শাহ। নিহতদের মধ্যে আরও ১৬ জন বিদেশি পর্যটককে চিহ্নিত করা গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনও জঙ্গিগোষ্ঠী এই হামলার দায় স্বীকার করেনি। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী মনে করা হচ্ছে, এক জন আততায়ীই এই হামলা চালিয়েছে।
হামলায় নিহত আবিস রিজভি (৪৫)-র বাবা আখতার হাসান রিজভি শরদ পওয়ারের ঘনিষ্ঠ রাজনীতিক ছিলেন। এনসিপি-র হয়ে এক সময়ে রাজ্যসভার সদস্যও হয়েছিলেন জৌনপুরের এই ব্যবসায়ী। বাবার সংস্থা রিজভি বিল্ডার্সের সিইও ছিলেন আবিস। কয়েকটি চলচ্চিত্রও প্রযোজনা করেছেন তিনি। ‘রোর- দ্য টাইগার্স অব সুন্দরবন’ নামে একটি চলচ্চিত্রের শুটিং হয় পশ্চিমবঙ্গে। পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, বন্ধুদের সঙ্গে নববর্ষ উদযাপন করতে দিন কয়েক আগে তিনি ইস্তানবুল যান। সেখানকার রেইনা নাইটক্লাব ছিল তাঁর প্রিয়। শনিবার রাতে সেখানেই গুলিতে ঝাঁঝরা হলেন তিনি। তাঁর ছোট ভাই সাকিব ২০১০-এ একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। সুষমা টুইটেই জানিয়েছেন, আবিসের স্ত্রী ও পরিবারের কয়েক জন দেহ আনতে ইস্তানবুলে যেতে চান। তাঁদের ভিসার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে।
নিহতদের স্মৃতিতে গোলাপ ও মোমবাতি। রবিবার ইস্তানবুলে। ছবি: রয়টার্স
হামলায় নিহত গুজরাতের বাসিন্দা খুশি শাহের বিষয়ে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। বিদেশমন্ত্রী জানিয়েছেন, তাঁর বাবা আশোক শাহের সঙ্গে তিনি টেলিফোনে কথা বলেছেন। সোমবার সন্ধ্যায় দু’জনের দেহ ভারতে পৌঁছবে বলে আসা করছেন বিদেশ মন্ত্রকের অফিসারেরা।
ইস্তানবুলের বসফরাস সেতুর যে প্রান্ত ইউরোপ ছুঁয়েছে, ঠিক সেখানেই নদীর কোলে জনপ্রিয় নাইটক্লাব রেইনা। এলাকার নাম ওর্তাকয়। রাত-জাগা পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের ঠিকানা এই রেইনা। বছর শেষের রাতটা তাই একটু অন্য রকম কাটাতে আয়োজনে কোনও খামতি রাখেননি কর্তৃপক্ষ। রাত তখন ১টা ১৫। তখনও পার্টির হুল্লোড় চলছে। হঠাৎই গুলির শব্দ। ক্লাবের বাইরে পাহারায় থাকা নিরাপত্তারক্ষীকে গুলি করে হামলাকারী তত ক্ষণে চলে এসেছে ক্লাবের ভেতরে। এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান অনুযায়ী, তার পরনে ছিল সান্তা ক্লজের পোশাক।
আবিস রিজভি
বড়দিন-নববর্ষ উপলক্ষে ইস্তানবুল-সহ তুরস্কের বিভিন্ন জায়গায় সান্তা ক্লজের পোশাক পরা ১৭ হাজার পুলিশকর্মী মোতায়েন করা হয়েছিল। একই রকম লাল-সাদা পোশাক আর মুখোশে ঢাকা আততায়ীকে দেখে প্রথমে সন্দেহ জাগেনি। অনেকেই ভেবেছিলেন বাজি পুড়ছে হয়তো। মুহূর্তেই ভুল ভাঙল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে গুলি। লুটিয়ে পড়েন নিরীহ মানুষগুলো। টানা দশ মিনিট গুলি চলার পর কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা। তার পরেই ফের বোমা আর গুলির যৌথ হামলা। এখানে ওখানে চাপ-চাপ রক্ত। আলো ঝলমল রেইনার ছবিটা মুহূর্তে বদলে গেল।
শনিবারের সেই রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন তুরস্কের বাসিন্দা ইউনিস তুর্ক। বললেন, ‘‘পাশেই এক জনকে রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখে মাথা কাজ করছিল না। প্রাণ বাঁচাতে সোফার তলায় লুকোলাম। দেখলাম, আমার মতো অনেকেই বসফরাসের বরফ-ঠান্ডা জলে ঝাঁপ দিচ্ছে।’’
গত এক বছর ধরে তুরস্ক সরকার ঘরে-বাইরে কোণঠাসা। সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পাশাপাশি রয়েছে সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থীদের চাপ। তার উপর আইএস ও কুর্দিশ জঙ্গিদের একের পর এক হামলায় জর্জরিত এর্দোগান সরকার। আততায়ীর হামলার ধরনের সঙ্গে প্যারিসের বাতাক্লঁ হলের হামলার মিল খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy