Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

পরজীবীর বিরুদ্ধে জেহাদ! নোবেল তিন বিজ্ঞানীর

ওষুধ রয়েছে, কিন্তু কাজে আসছে না কিছুতেই। এ দিকে গোটা দুনিয়ায় লাখো মানুষ মরছে ম্যালেরিয়ার প্রকোপে। এমনই এক পরিস্থিতিতে ম্যালেরিয়া পরজীবী প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম নিধনে নয়া ওষুধের খোঁজ দিয়েছিলেন চিনের মহিলা বিজ্ঞানী ইউইউ তু।

ইউইউ তু, সাতোশি ওমুরা ও উইলিয়াম ক্যাম্পবেল

ইউইউ তু, সাতোশি ওমুরা ও উইলিয়াম ক্যাম্পবেল

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৪৮
Share: Save:

ওষুধ রয়েছে, কিন্তু কাজে আসছে না কিছুতেই। এ দিকে গোটা দুনিয়ায় লাখো মানুষ মরছে ম্যালেরিয়ার প্রকোপে। এমনই এক পরিস্থিতিতে ম্যালেরিয়া পরজীবী প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম নিধনে নয়া ওষুধের খোঁজ দিয়েছিলেন চিনের মহিলা বিজ্ঞানী ইউইউ তু।

আর্টেমেসিনিন। আর্টেমেসিয়া অ্যানুয়া নামের একটি গাছ থেকে তৈরি এই ওষুধ আবিষ্কারের জন্য এ বছর চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পেলেন তিনি। ইউইউয়ের সঙ্গেই নোবেল জিতেছেন আরও দু’জন। আইরিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম ক্যাম্পবেল এবং জাপানের সাতোশি ওমুরা। ‘অ্যাভারমেকটিন’ নামে একটি ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন তাঁরা। যা ‘রিভার ব্লাইন্ডনেস’ ও ‘লিম্ফাটিক ফাইলেরিয়াসিস’ প্রতিরোধে সক্ষম।

ম্যালেরিয়া এবং নোবেল জয়— এ বারই কিন্তু প্রথম নয়। ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কার করে ১৯০২ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল জিতেছিলেন রোনাল্ড রস। ব্রিটিশ এই বিজ্ঞানীর জন্ম ভারতেই। পরে পড়াশোনা করতে ইংল্যান্ডে চলে যান। ফিরেও আসেন এ দেশে। যোগ দেন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসে। ১৮৮৩ সাল নাগাদ প্রথম তিনি লক্ষ করেন জমা জলে মশার বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে রোগটির একটা যোগ আছে। গবেষণা শুরু করেন তার পরই। বড় ধাপ পেরোন ১৮৯৫ সালে। মশার পাকস্থলীতে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রত্যক্ষ করেন তিনি। গবেষণার বেশিটাই করেছিলেন কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। সেখানে তাঁর নামে রোনাল্ড রস ভবন রয়েছে।

জীবাণুর পাশাপাশি জীবাণুর প্রতিষেধকও আবিষ্কার হয়। কিন্তু এক সময় দেখা যায়, কুইনাইন, ক্লোরোকুইন-এর প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে গিয়েছে। ওষুধ থেকেও তা কাজে দিচ্ছে না। লক্ষ লক্ষ মানুষ মরছে ম্যালেরিয়ায়। এই সময়ই আর্টেমেসিয়া অ্যানুয়া গাছ থেকে তৈরি একটি আয়ুর্বেদিক ওষুধ আর্টেমেসিনিনের সন্ধান দেন ইউইউ। তিনি অবশ্য ওষধিটির খোঁজ পেয়েছিলেন ১৭০০ বছরের পুরনো একটি চিনা পুঁথি থেকে। সেখানে লেখা ছিল ওই গাছটির জ্বর ঠেকানোর বিরল ক্ষমতা রয়েছে। গবেষণা শুরু করেন ইউইউ। ফলও মেলে অব্যর্থ।

ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দীর কথায়, ‘‘ক্লোরোকুইনের তুলনায় আর্টেমেসিনিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম। তা ছাড়া খুব দ্রুত রোগীর দেহে কাজ শুরু করে। অনেক সময় ম্যালেরিয়ার পরজীবী রক্তজালিকার মধ্যে দিয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেয়। আর্টিমেসিনিন দ্রুত রক্তে মিশে গিয়ে ওই পরজীবীদের ধ্বংস করে। স্বাভাবিক করে রক্ত চলাচল।’’ এখন আর্টিমেসিনিনের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে গেলেও ওই ওষুধটিই ব্যবহার করা হয়। সে ক্ষেত্রে আর্টিমেসিনিনের সঙ্গে কিছু সহায়ক-ওষুধ প্রয়োগ করেন চিকিৎসকরা।

ম্যালেরিয়ার মতোই পরজীবী-জনিত রোগ ‘রিভার ব্লাইন্ডনেস’ ও ‘লিম্ফাটিক ফাইলেরিয়াসিস’। প্রথমটির জন্য দায়ী অঙ্কোসেরকা ভলভিউলাস নামে একটি পরজীবী, যার বাহক ব্ল্যাক ফ্লাই। সাধারণত ব্ল্যাক ফ্লাইয়ের কামড়ে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী লোকজনের এই রোগ হতে দেখা যায়। ত্বকে জ্বালা-প্রদাহ-গোটা বেরোতে থাকে। ধীরে ধীরে আসে অন্ধত্ব। সাধারণত সাব-সাহারান আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় এই রোগ হতে দেখা যায়। লিম্ফাটিক ফাইলেরিয়াসিস-এর জন্য দায়ী ফাইলেরিওয়ডিয়া প্রজাতির পরজীবী। মশার কামড়ে এই রোগ ছড়ায়। হাত-পা, শরীরের নিম্নাঙ্গ অস্বাভাবিক ভাবে ফুলে যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

এই দু’টি রোগেরই প্রতিষেধক অ্যাভারমেকটিন। টোকিও-র কিতাসাতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অশীতিপর বিজ্ঞানী ওমুরা আবিষ্কার করেছিলেন ওষুধটি। স্ট্রেপটোমাইসিস ব্যাকটিরিয়ার খোঁজে মাটির নমুনা সংগ্রহ করতে করতে একটি নতুন ধরনের ব্যাকটিরিয়া স্ট্রেপটোমাইসিস অ্যাভারমাইটিলিস-এর সন্ধান পান তিনি। অ্যাভারম্যাকটিনের উৎস এই ব্যাকটিরিয়াটি-ই।

১৯৮৭ সাল থেকে বিনামূল্যে গরিব মানুষের মধ্যে অ্যাভারমেকটিন বিতরণ করতে শুরু করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। ফলও মেলে। রোগদু’টি এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে।

পরজীবী বিশেষজ্ঞ ৮৫ বছরের ক্যাম্পবেলের কাজ ছিল মূলত গৃহপালিত পশুদের নিয়ে। পরজীবী বাহিত রোগ থেকে পোষ্যদের বাঁচাতে অ্যাভারমেকটিন নিয়ে কাজ করেন তিনি। ওষুধটির পরিশোধনও করেন। পরে যার নাম হয় ইভারমেকটিন।

‘‘ওমুরা-ক্যাম্পবেল, একটি নতুন ধরনের ওষুধ উপহার দিয়েছেন। যার ক্ষমতা অসাধারণ’’, বলেছে নোবেল কমিটি। আর ইউইউ? কমিটির কথায়, ‘‘প্রতিটি আবিষ্কারই আসলে এক যুগ পরিবর্তন।’’

নোবেল জয়ে উচ্ছ্বসিত তিন বিজ্ঞানীও। ওমুরা অবশ্য বলছেন, ‘‘আমার তো মনে হয়, এই সম্মান স্ট্রেপটোমাইসিস অ্যাভারমাইটিলিস-এর মতো অনুজীবীর প্রাপ্য।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE