Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Russian Revolution

লেনিনবাদী পার্টির হাতেই লেনিনগ্রাদের পতন

সামাজিক ভাবনাতেও তিনি অন্য রকম। সামন্তবাদী সমাজের প্রেমহীন দাম্পত্যের অবসান চান, কিন্তু একই সঙ্গে প্রেমহীন অবাধ যৌনতাও তিনি মানতে পারেন না। মদের স্বাদ নিয়ে অনায়াসে আলোচনা করেন চিঠিপত্রে।তিনি ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ। ওরফে লেনিন। লিখছেন মুকুল দাসসামাজিক ভাবনাতেও তিনি অন্য রকম। সামন্তবাদী সমাজের প্রেমহীন দাম্পত্যের অবসান চান, কিন্তু একই সঙ্গে প্রেমহীন অবাধ যৌনতাও তিনি মানতে পারেন না। মদের স্বাদ নিয়ে অনায়াসে আলোচনা করেন চিঠিপত্রে।তিনি ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ। ওরফে লেনিন। লিখছেন মুকুল দাস

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৭ ১৯:২২
Share: Save:

মহামতি লেনিন, ধূর্ত লেনিন থেকে শুরু করে গুড বাই লেনিন। গত শতাব্দীর শুরু থেকে শেষ, পৃথিবীর এ গোলার্ধ থেকে ও গোলার্ধ, ক্ষমতাশীল সমাজ আর ইন্টেলেকচুয়াল সোসাইটি থেকে ওয়ার্কিং ক্লাস, আর কোনও মানুষকে নিয়ে এত আলোচনা, এত সমালোচনা, এত পোস্টমর্টেম হয়নি। পলিটিক্যাল লিডার, পলিটিক্যাল ইন্টেলেকচুয়াল বা থিওরিটিশিয়ান হিসেবে আর কোনও ব্যক্তি তাঁর মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি বিংশ শতাব্দীতে।

ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ। ওরফে লেনিন। মেধাবী এবং উচ্চাকাঙ্খী। জেদি এবং আবেগী। বাগ্মী। শানিত যুক্তিতে ফালাফালা করে দিতে পারেন বিপক্ষকে। সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হতে ভয় পান না। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে দারুণ ছদ্মবেশ ধরতে পারেন। তাত্ত্বিক প্রকল্প গড়ায় ওস্তাদ। সে তত্ত্ব তাঁর সমসাময়িক, সমদেশিক প্রেক্ষাপটে তাঁর মতো করে প্রয়োগের উপযুক্ত। আবার একই সঙ্গে একটা বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গিও বটে।
সামাজিক ভাবনাতেও তিনি অন্য রকম। সামন্তবাদী সমাজের প্রেমহীন দাম্পত্যের অবসান চান, কিন্তু একই সঙ্গে প্রেমহীন অবাধ যৌনতাও তিনি মানতে পারেন না। মদের স্বাদ নিয়ে অনায়াসে আলোচনা করেন চিঠিপত্রে। কণাবিজ্ঞান নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন মার্কসবাদের সঙ্গে সমসাময়িক বিজ্ঞানের সমন্বয় স্থাপন করতে (যদিও তা বৈজ্ঞানিক মহলে খুব একটা উঁচুদরের লেখা বলে আদৌ স্বীকৃত নয়, অনেকের মতে লেনিন কণাবিজ্ঞানের প্রাথমিক বিষয়টা বোঝেননি)। রাশিয়ায় ক্ষমতা দখলের পর লেনিন যে বিবাহ আইন এনেছিলেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বৈপ্লবিক। এর মধ্যে ছিল- বিবাহ বিচ্ছেদে মেয়েদের সমান অধিকার দেওয়া, অবৈধ সন্তানের ধারণাকে বাতিল করা ইত্যাদি ইত্যাদি। হয়ত এত সব কারণেই লেনিনকে গত শতকের শ্রেষ্ঠ ইন্টেলেকচুয়াল বলেও মনে করেন অনেকে।

পুলিশের চোখে ধুলো দিতে ছদ্মবেশী লেনিন

এই লেনিন গত শতকের প্রথম সিকিতে এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, যার শতবর্ষ পালন হচ্ছে এ বছর। রুশ বিপ্লব। অক্টোবর বিপ্লব। পরবর্তীতে পরিবর্তিত ক্যালেন্ডার মতে নভেম্বর বিপ্লব। পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লব, বিদ্রোহ, ক্ষমতা দখল কম হয়নি। এ আসে। সে যায়। কিন্তু এর মেরুদণ্ডে যেন অন্য স্নায়ু প্রবাহিত। এ ক্ষমতা এমন এক দেশকে দেখতে চায়, দেখাতে চায়, যেখানে সব মানুষ পেট ভরে খেতে পাবে। সবাই মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে। প্রত্যেকে আবহাওয়া অনুযায়ী আরামদায়ক পোশাক পাবে। সব ছেলেমেয়ে ইস্কুলে যাবে। অর্থাত্ বেঁচে থাকার ন্যূনতম উপাদানগুলো, মানবিক ও মানসিক বিকাশের বেসিক উপাদানগুলো এই নতুন ‘ক্ষমতা’ সব্বাইকে দেবে। এ দেশ ব্যক্তিগত সম্পত্তি, পুঁজি-মুনাফার অর্থনীতিকে বাতিল করবে। এমনটা, একটা গোটা দেশে আগে কখনও হয়নি। বিশ্ব জুড়ে সোরগোল পড়ল।

 

কিন্তু লেনিনের নেতৃত্বে এই বিপ্লবের ঠিক কয়েক মাস আগে, ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে (বর্তমান ইংরেজি ক্যালেন্ডারে মার্চে) আর একটা বিপ্লব ঘটেছিল রাশিয়ায়। আর তাতেই উচ্ছেদ ঘটেছিল জারতন্ত্রের। এই বিপ্লবকে গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলা যায়, যা রাশিয়ায় সামন্ততান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল, বা ঘটানোর রাস্তা পরিষ্কার করেছিল। এই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন রাশিয়ার শ্রমিক, কৃষক আর সৈন্যরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণের জেরে যাঁরা তখন খাদ্যের আকালে চরম দুর্দশায় ধুঁকছেন।

কিন্তু লেনিনের নেতৃত্বে এই বিপ্লবের ঠিক কয়েক মাস আগে, ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে (বর্তমান ইংরেজি ক্যালেন্ডারে মার্চে) আর একটা বিপ্লব ঘটেছিল রাশিয়ায়। আর তাতেই উচ্ছেদ ঘটেছিল জারতন্ত্রের। এই বিপ্লবকে গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলা যায়, যা রাশিয়ায় সামন্ততান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল, বা ঘটানোর রাস্তা পরিষ্কার করেছিল। এই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন রাশিয়ার শ্রমিক, কৃষক আর সৈন্যরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণের জেরে যাঁরা তখন খাদ্যের আকালে চরম দুর্দশায় ধুঁকছেন।

একই সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার ঘটেছিল। ১৯০৫-এর পর রাশিয়া জুড়ে তৈরি হওয়া শ্রমিক, কৃষকদের সোভিয়েতগুলো, যেগুলো দীর্ঘ কয়েক বছর যাবত্ নিষ্ক্রিয়প্রায় অবস্থায় ছিল, সেগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত পুণরুজ্জীবন ঘটল আবার। রাশিয়ার ইতিহাসে এটাকেই দ্বৈত ক্ষমতা বলা হয়ে থাকে। শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা গেল লভ বা কেরেনেস্কিদের হাতে। আর নীচতলায় প্রবল ভাবে ক্ষমতাশালী রইল সোভিয়েতগুলো।

একই সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার ঘটেছিল। ১৯০৫-এর পর রাশিয়া জুড়ে তৈরি হওয়া শ্রমিক, কৃষকদের সোভিয়েতগুলো, যেগুলো দীর্ঘ কয়েক বছর যাবত্ নিষ্ক্রিয়প্রায় অবস্থায় ছিল, সেগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত পুণরুজ্জীবন ঘটল আবার। রাশিয়ার ইতিহাসে এটাকেই দ্বৈত ক্ষমতা বলা হয়ে থাকে। শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা গেল লভ বা কেরেনেস্কিদের হাতে। আর নীচতলায় প্রবল ভাবে ক্ষমতাশালী রইল সোভিয়েতগুলো।

ঘটনা হল, ফেব্রুয়ারি বিপ্লব বা সোভিয়েতগুলোর পুনরুজ্জীবন, এর কোনওটাতেই বলশেভিকদের তেমন কোনও ভূমিকা বা অবদান ছিল না। মেনশেভিকদেরও নয়। লেনিন নিজে তখন ইউরোপে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন নিয়ে তর্ক, বিতর্ক চালাচ্ছেন। এ সময়েই লিখেছেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ: পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’-এর মতো বহু আলোচিত বই। একই সঙ্গে নজর এবং যোগাযোগ রাখছেন রাশিয়ায়। সোভিয়েতগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত পুনরুত্থান দেখে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। কীসের যেন গন্ধ পেলেন। আর এপ্রিলেই ফিরে এলেন রাশিয়ায়।

কী করিতে হইবে

তার পরের কয়েক মাসের ইতিহাস যেন লেনিনের ব্যক্তিগত হাতে লেখা। বলশেভিক পার্টিকে ক্ষমতা দখলের জন্য তৈরি হতে বললেন। সঙ্গীদের অনেকেই এটাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে। ‘এপ্রিল থিসিস’ লিখে পার্টিতে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করলেন লেনিন। ‘বিপ্লবী পরিস্থিতি’র ব্যাখ্যা করলেন। দরকারে একাই এগিয়ে যাবেন বলে হুমকি দিলেন। কিন্তু তাও অধিকাংশ তাঁর মত মেনে নিতে চাননি। এর মধ্যে আবার তাঁকে দেশ ছাড়তে হল। ফিরলেন। এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা দখলের জন্য এককাট্টা করলেন অধিকাংশকে। এর পর সেই ‘দুনিয়া কাঁপানো ১০ দিন’। লেনিন, ব্যক্তি লেনিন, সেই সময়কে বা পরিস্থিতিকে দেখতে না পেলে এই বিপ্লব হত না। তাঁর প্রায় একার মত, প্রবল বিরোধিতা ভেঙে জিতেছিল। এবং পৃথিবার ইতিহাসে একটা নতুন ভাবনার রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল।

স্তালিন, লেনিন এবং কালিনিন

রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্র এত দিন মার্কসবাদীদের একটি উচ্ছেদযোগ্য কাঠামো ছিল, পরিস্থিতির বা সময়ের খেলায় সেই রাষ্ট্রই এ বার লেনিন বা রুশ কমিউনিস্টদের কাছে জানে প্রাণে আগলে রাখার একটা বিষয় হয়ে উঠতে যাচ্ছে। এঙ্গেলস লিখে গিয়েছিলেন, শ্রমিক শ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর সেই রাষ্ট্রের কাজ ফুরোবে। রাষ্ট্রের কাজ হবে তার ক্ষমতার মুঠোটা আলগা করে দেওয়া। কেতাবী ভাষায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। এই বক্তব্যের যুক্তিগ্রাহ্য কারণটাও খুব স্পষ্ট। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজি বা শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের বিরুদ্ধে যে লড়াই, তা যদি শেষ পর্যন্ত আবারও ক্ষমতার একটা কেন্দ্রই তৈরি করে ফেলে, তবে আর হলটা কী? কিন্তু মার্কস, এঙ্গেলসের ভাবনায় ছিল- বিপ্লবটা শুরু হবে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো থেকে। আর লেনিনের পার্টি যেখানে ক্ষমতা দখল করল, তা কোনও ভাবেই উন্নত পুঁজিবাদী দেশ নয়। মালিক এবং শ্রমিক- মূলত এই দুই সরল ভাগে বিভক্ত নয় সে দেশের জনসমষ্ঠি। তাই এক কথায় সমস্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে ফেললে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ ঘটাতে চাইলে, তা জনগণের একটা বড় অংশ বিশেষত কৃষকদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। গ্রামাঞ্চলে শুধু বড় বড় ভূস্বামীরাই নন, রুশ বিপ্লব আশঙ্কিত করে তুলল বড়, মাঝারি, এমনকী ছোট কৃষকদেরও।

পার্টি কংগ্রেসে শীর্ষ নেতারা

বিপ্লবের পর বলশেভিকদের স্লোগান ছিল, ‘সোভিয়েতের হাতে সমস্ত ক্ষমতা’। ‘পার্টির হাতে প্রধান ক্ষমতা’ নয় কিন্তু। এই স্লোগান বুনিয়াদি মার্কসবাদের নীচতলায় ক্ষমতা ছড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে মানানসই ছিল। কিন্তু বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একটা দেশে, বাইরের এবং ভিতরের বৈরিতা সহ্য করে টিকে থাকা এবং সেই সঙ্গে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বদলে নীচ তলায় সাধারণ মানুষের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা তুলে দেওয়া- শুনতে যত দারুণই হোক না কেন, বাস্তবে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।

এর মধ্যেই রাশিয়ায় শুরু হল গৃহযুদ্ধ। প্রায় পাঁচ বছর ব্যাপী গৃহযুদ্ধ সামলাতে লেনিনের পার্টিকে আরও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে হচ্ছিল। ক্ষমতা দখল করার থেকে, ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াইটা কম কঠিন ছিল না। এই কঠিন অবস্থায় মুঠো আলগা করার প্রশ্ন নেই। মুঠো শক্ত করতে হল। জোর বাড়ল শৃঙ্খলা বা রেজিমেন্টেশনে। আবার বিতর্ক শুরু হল পার্টিতে। প্রশ্ন উঠল, শ্রমিক শ্রেণির ভ্যানগার্ড বাহিনী নয়, শ্রমিক শ্রেণির হাতেই প্রকৃত ক্ষমতা তুলে দিতে না পারলে হবেটা কী? ক্রুপস্কায়াও ছিলেন এই দ্বিতীয় দলে। কিন্তু বাস্তববাদী লেনিন ‘গভীর বেদনাবোধ নিয়ে’ উপলব্ধি করলেন, রুশ শ্রমিক শ্রেণি এখনও শ্রেণিগত ভাবে ক্ষমতা অনুশীলনের উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাঁচাতে গেলে, বিপ্লবের রাষ্ট্রকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে, ‘অগ্রণী’ বাহিনীকেই আরও শক্তিশালী হতে হবে।

দ্য গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড, ‘অবিশ্বাস্য’ শিল্পায়নের ইতিহাস

এ সব চলতে চলতেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন লেনিন। বিপ্লবের ষষ্ঠ বার্ষিকী পালিত হওয়ার পর আর বেশি দিন বাঁচেননি। বেঁচে থাকলে আর সুস্থ থাকলে, ‘শ্রমিক শ্রেণির ভ্যানগার্ড’ পার্টি বনাম আপামর খেটে খাওয়া মানুষের ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে দূরদর্শী লেনিন নতুন করে ভাবতেন কি না, সে প্রশ্ন অবান্তর। বাস্তবে যা ঘটল তা হল, লেনিনের তৈরি পার্টি কাঠামো পরবর্তীতে বজ্রকঠিন কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করে দিল সোভিয়েত ইউনিয়নে।

এটা একটা দিক। আর একটা দিক হল, গোটা রাশিয়া জুড়ে একটা অনন্য জাগরণ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার, শিল্প, কৃষি, বিজ্ঞান, খেলাধূলা থেকে শুরু করে যে দিকেই তাকানো যায়- উন্নয়নের প্রায় অবিশ্বাস্য উদাহরণ। পৃথিবীর ইতিহাসে তার তুলনা নেই। এটা শুধু আমার দেশ নয়, এটা আমাদের দেশ। এ দেশ আমরা গড়ি এবং আমরাই চালাই- এই বোধ, এই সংঘবোধ এক জোয়ার আনল সর্বত্র।

নভেম্বর বিপ্লবের তেরো বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নে যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অনেক নিন্দা শুনে, অনেক সন্দেহ নিয়েই মস্কো পৌঁছেছিলেন। সে কথা ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লিখেওছেন তিনি। কিন্তু পৌঁছনোর পর থেকে তাঁর একের পর এক বিস্ময়ের পালা। খোলামনের মানুষ তিনি। নির্দ্বিধায় লিখেছেন, এমনটা আর কোথাও দেখেননি। লিখেছেন, নিজের ছোট্ট শ্রীনিকেতনে যা গড়ার চেষ্টা করছেন, একটা গোটা দেশ তা করছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন

সত্যিই তো তাই। একা রবীন্দ্রনাথ নন, সারা বিশ্বের বহু মানুষ তখন বিস্ময়ে তাকিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে। শিল্পোত্পাদনে বৃদ্ধির যে হার তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন দেখিয়েছে, সর্বকালে তার কাছাকাছি কোনও নজির নেই কোনও দেশে। শিক্ষায় তো ইউরোপ, আমেরিকা রীতিমতো শিক্ষাই নিয়েছে ওদের থেকে। ক্লাসরুমবন্দি, বিরক্তিকর লেখাপড়া ছেড়ে শিক্ষার প্রাঙ্গন ছড়িয়ে পড়ল বাইরে। মাঠে, ঘাটে, পাহাড়ে, নদীতে, বাতিল ট্রেনের কামরায় চলল ইতিহাস বা ভূগোলের জীবন্ত পাঠ। বিজ্ঞান ছোটদের শুকনো বই ছেড়ে বেরিয়ে এল মজাদার সব এক্সপেরিমেন্টে। ছোটদের কাছে খেলতে খেলতে পড়ার চেয়ে ভাল যে কিছু নেই, তা প্রথম শেখাল সোভিয়েত ইউনিয়ন।

একেবারে শেষ প্রান্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা লাগে সোভিয়েতের মাটিতে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেটাই ব্যুমেরাং হয়ে নাত্সি বাহিনীর ওয়াটারলু হয়ে দাঁড়ায়। আর বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গোটা পৃথিবীতে আধিপত্য ভাগ হয়ে যায় আমেরিকা, রাশিয়ার মধ্যে।

এখানেও সোভিয়েত ইউনিয়নের আর এক নতুন রূপের দেখা মিলল। পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশে রুশ সৈন্য ঢুকে পড়ল। শুরু হল বিপ্লব রফতানি। বিশ্ব রাজনীতিতে নিজ রাষ্ট্রের আধিপত্য বাড়াতে কোথাও অর্থনৈতিক, কোথাও সামরিক প্রভাব খাটাতে শুরু করল তারা। এটা বাইরের দিক। আর দেশের ভিতরে? নিরঙ্কুশ পার্টি নিয়ন্ত্রণ। পার্টি নেতাদের ক্ষমতা চরম জায়গায় পৌঁছল।

বহু মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, অর্থনীতিবিদ সেই সময় থেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেন। কীসের সমাজতন্ত্র? কীসের শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্ব? আসলে তো গোটা দেশটা নিয়ন্ত্রণ করছে একটা পার্টি, এবং আসলে পার্টির মাথায় নানা স্তরে বসে থাকা কিছু কিছু লোক। গণতন্ত্রের বহুদলীয় ব্যবস্থার মতো এখানে ক্ষমতাসীন দল বদলে ফেলারও অবকাশ নেই। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুঁজি বা অর্থনীতিকে, এবং তার সূত্রে গোটা রাষ্ট্রকেই, নিয়ন্ত্রণ করেন পুঁজিপতিরা- এটাই বলে মার্কসবাদ। সেই মার্সবাদীদের দেশেও তো আসলে অর্থনীতি, রাজনীতি সব নিয়ন্ত্রণ করছে কিছু লোকেই। উল্টে কথা বলার স্বাধীনতা অতি সঙ্কীর্ণ। রাষ্ট্রকে বা সরকারকে সমালোচনার অধিকারও নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাগিরি সন্দেহবাতিকগ্রস্ত রোগে আক্রান্তদের মতো দুর্বিষহ।

এ হেন দেশ টিকল না। ঠিক যে ভাবে ঝোড়ো হাওয়ার মতো এক দিন ক্ষমতা তুলে নিয়েছিল লেনিনের পার্টি, তা ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতো। এবং ভেঙে পড়ার পর দেখা গেল, গোটা দেশের আমজনতা ওই ব্যবস্থাটা সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল। দেখা গেল, শুধু খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের সংস্থান হয়ে গেলেই মানুষের সব পাওয়া হয় না। মানুষ যন্ত্র নয়। তার মন আছে। মনের খোরাক, চিন্তার ঔদার্যকে গলা টিপে রেখে খুব বেশি দিন মানুষকে শাসন করা যায় না।

এক দিন ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’য় উত্তরণ ঘটে একটা দেশের মানুষ পৃথিবীকে বিস্মিত করে দিয়েছিল। গোটা দেশটা ভেবেছিল, ধনী-দরিদ্র বা ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাহীন বৈষম্য ঘুচে নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে। এক সঙ্গে। সবাই মিলে। সেই আবেগেই না ঘটেছিল উন্নয়নের অত বড় উল্লম্ফন। সেই আবেগকেই ইন্ধন করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিনবাদী পার্টি। আবার উল্টো দিকে একই সঙ্গে উদ্যোগ চলেছে, পার্টিই যাতে শেষ কথা হয়ে থাকে তার জন্য। ফলে লোকে এক দিন বুঝল, দেশ চালায় পার্টির কিছু লোকেই। আর এখানেই, এই লেনিনবাদী পার্টির হাতেই, মৃত্যু হল একটা মহা উদ্যোগের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE