Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

দু’জনে মিলে বই লেখা হল না, আক্ষেপ বন্যার

‘‘কেমন ছড়িয়ে গিয়েছি। ছত্রাকার হয়ে গিয়েছে জীবনটা। আর চিন্তাভাবনাগুলোও।’’ —এই প্রথম প্রকাশ্যে এসে কথাগুলো বলছিলেন রফিদা আহমেদ বন্যা। স্বামী অভিজিৎকে হারানোর পরে মাত্র চার মাস কেটেছে। যুক্তিবাদী চিন্তার প্রচার করে দেশের কট্টরপন্থীদের বিরাগভাজন হওয়ায় কুপিয়ে মারা হয়েছিল তরুণ বাংলাদেশি ওই ব্লগারকে।

২৬ ফেব্রুয়ারি। ঢাকার প্রকাশ্য রাজপথে সেই জঙ্গি তাণ্ডব।

২৬ ফেব্রুয়ারি। ঢাকার প্রকাশ্য রাজপথে সেই জঙ্গি তাণ্ডব।

শ্রাবণী বসু
লন্ডন শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৫ ০২:১৪
Share: Save:

‘‘কেমন ছড়িয়ে গিয়েছি। ছত্রাকার হয়ে গিয়েছে জীবনটা। আর চিন্তাভাবনাগুলোও।’’ —এই প্রথম প্রকাশ্যে এসে কথাগুলো বলছিলেন রফিদা আহমেদ বন্যা। স্বামী অভিজিৎকে হারানোর পরে মাত্র চার মাস কেটেছে। যুক্তিবাদী চিন্তার প্রচার করে দেশের কট্টরপন্থীদের বিরাগভাজন হওয়ায় কুপিয়ে মারা হয়েছিল তরুণ বাংলাদেশি ওই ব্লগারকে। আঁচ পড়েছিল অভিজিতের স্ত্রী বন্যার উপরেও। তার পর থেকে জীবন কতটা পাল্টেছে, গত কাল লন্ডনের ‘ভলতেয়ার লেকচার’-এ সে কথাই জানিয়েছেন তিনি।

সভার বিষয়বস্তু ছিল, ‘কলম দিয়ে ছোরার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’ অভিজিতের মতো বন্যাও বিশ্বাস করেন কলমের শক্তি অনেক বেশি। বলছিলেন, ‘‘ওকে অভি বলে ডাকতাম...আমার বন্ধু, প্রেমিক এবং সর্ব ক্ষণের সঙ্গী। ওকে হারিয়ে ওলটপালট জীবনে বেঁচে থাকার মানে এখন হয়ে উঠেছে সেই কলমই।’’ আর এই কথার সূত্র ধরেই আরও বললেন, ‘‘সামগ্রিক ভাবে জীবনকে দেখা শুরু করেছি তার পর থেকে। বাড়িতে বসে নৈঃশব্দের শব্দ শুনি। অন্ধকারে চেয়ে থাকি। ব্যক্তিগত ক্ষতির পরে জীবনের সঙ্গে গভীর বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। প্রথম প্রথম মনে হত, সারাটা দিন কী ভাবে কাটবে! এখন মনে হয়, সপ্তাহটা কী ভাবে কাটাব।’’

হিলটন মেট্রোপোল হোটেলের প্রেক্ষাগৃহে একাগ্র হয়ে ছ’শো মানুষ শুনছিলেন বন্যাকে। কথা বলতে বলতেই হঠাৎই সহজাত ভাবে হাত দু’টো নাড়লেন তিনি। শ্রোতারা দেখলেন, বন্যার এক হাতের বুড়ো আঙুলটা নেই। মনে পড়ল তখনই, ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বইমেলা থেকে ফেরার সময় প্রকাশ্য রাজপথে অভিজিৎকে নৃশংস ভাবে কুপিয়ে মারার পরে বন্যার আঙুলটাও কেটে নিয়েছিল জঙ্গিরা। ভয়ানক চোট লেগেছিল মাথায়। সেই ভয়াবহ স্মৃতি পিছনে ফেলে বন্যার মাথায় এখন ছোট করে ছাঁটা চুল, পরনে খুব সাধারণ হাতকাটা পোশাক। হঠাৎ দেখে বোঝার উপায় নেই, কী ঝড় বয়ে গিয়েছে তাঁর উপর দিয়ে।


ব্লগার অভিজিৎকে খুনের পর তাঁর স্ত্রী রফিদা আহমেদ বন্যার (ডান দিকে) উপরও হামলা চালায় জঙ্গিরা।

এই সন্ধ্যার অনেকটাই জুড়ে রইল ‘অভি’-র সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা। কী ভাবে তিনি অভিজিতের সব বই কাটাছেঁড়া করতেন, কত বিষয় নিয়ে তর্ক করতেন...তর্কের জেরে তাঁদের মেয়ের মনে হত, বাবা-মা সারা ক্ষণ ঝগড়া করছে। যে দিন অভিজিৎকে হারালেন, ঠিক তার আগের দিনই ভেবেছিলেন, দু’জনে মিলে একটা বই লিখবেন। কথায় কথায় জানালেন, লেখালেখিতেই ডুবে থাকতেন অভিজিৎ। আর সংসার চালানোর ভাবনা ছিল বন্যার একার।

বন্যা জানালেন, বিজ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্যেও কম উৎসাহী ছিলেন না অভিজিৎ। এমনকী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সম্পর্ক নিয়েও লেখালেখি করেছিলেন। কথা বলার চেয়ে লেখায় নিজেকে ভাল ভাবে ব্যক্ত করতে পারতেন। তাই এক বাড়িতে থেকেও দু’জনে চিঠি চালাচালি করতেন। হেসে বললেন, খালি অভিজিতের গলায় গানটাই সহ্য করা যেত না। তাঁদের মেয়ের চোখেও অভিজিৎই ছিলেন আদর্শ পিতা।

ব্যক্তিগত গণ্ডি পেরিয়ে এর পরে বন্যা চলে গেলেন বৃহত্তর পরিসরে। তাঁর কথায়, ‘‘অভিজিৎ জানতেন, তাঁর প্রতিবাদী স্বরের দিকে নজর রয়েছে অনেকেরই।’’ বন্যার প্রশ্ন, ‘‘মানবতাবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষ মানুষকে প্রকাশ্য রাস্তায় মেরে ফেলা হচ্ছে। এ রকম একটা জায়গায় আমরা পৌঁছলাম কী ভাবে?’’ লন্ডনের শ্রোতাদের এর পরে বন্যা জানিয়ে চলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস, একুশে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সাল থেকে কট্টরপন্থীদের রমরমা, মুক্ত চিন্তার ব্লগারদের খতম তালিকা— সব কিছু।

উঠে আসে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাঁর হতাশার কথাও। বন্যার দাবি, অভিজিৎ-হত্যার পরে তারা কিছুই করেনি। ‘‘পুলিশ আমার সঙ্গে কোনও দিন যোগাযোগ করেনি। যেন আমি কোথাও নেই! প্রধানমন্ত্রীর ছেলে শুধু অভির বাবাকে ফোন করেছিলেন।’’ বাংলাদেশে যাবেন আর? ‘‘না! এটা বললে আমার বাবা-মা মেরে দেবে আমায়। ঢাকায় অভির পরিবার রয়েছে। আমার বাবা-মা আমেরিকায়।’’

হতাশার পাহাড় ঠেলে কী ভাবে বেঁচে আছেন তিনি? হেসে বন্যা বলেন, ‘‘ঘুমের ওষুধ! ...আর পরিবার, বন্ধু, মুক্তমনা এবং অপরিচিতদের সহানুভূতি। হতাশায় ডুবে যেতে যেতেও মনে হয় আমার অন্তত বলার একটা জায়গা আছে। যাদের সেটাও নেই? আইএস যাদের মাথা কাটছে? বোকো হারাম যে সব মেয়েদের অপহরণ করছে? এগুলো তো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা বিশ্বজনীন সংগ্রাম। ব্যক্তিগত যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে আলাদা করে তো এগুলোর কোনও মূল্য নেই এই বিশ্বসংসারে।’’

আটলান্টায় বসে লেখালেখি করছেন। আপাত ভাবে জঙ্গিদের চোখরাঙানি থেকে গা বাঁচিয়ে। বন্যা তাই কুর্নিশ করেন মুক্তমনার সব লেখককে। আশা রাখেন, উদ্ধত ছোরার সঙ্গে লড়াইয়ে জিতবে কলম। তবেই হয়তো অভিজিৎ বা অনন্ত বিজয় দাসের মতো নিহত ব্লগারদের জীবনের মূল্য বোঝা যাবে।

— ফাইল চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE