Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
বারবার কম্পনে আতঙ্কিত কলকাতাও

লাশ গুনে যাচ্ছে চৌচির নেপাল

ফুটপাথের উপর সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশের সারি। কেউ কি বেঁচে নেই এঁদের মধ্যে? মানতে চায় না মন। তাই থেকে থেকেই তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসছেন দু’-এক জন। কেউ নাড়ি টিপে ধরছেন প্রাণপণে। কেউ-বা শোয়ানো মানুষটার বুকে মাথা ঠেকাচ্ছেন, যদি কেঁপে ওঠে দৈবাৎ! কেঁপেছে তো! মৃতদেহে প্রাণস্পন্দন ফেরেনি। কিন্তু রবিবার দ্বিতীয় বারের জন্য কেঁপেছে কাঠমান্ডু। এ বার উৎসস্থল নেপালের কোডারি থেকে ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণে। রিখটার স্কেলে তীব্রতার পরিমাণ ৬.৭।

ফের মেয়ের সঙ্গে খেলা করতে পারবেন, ভাবতে পারেননি সুরেশ পরিহার। ছবি: এপি

ফের মেয়ের সঙ্গে খেলা করতে পারবেন, ভাবতে পারেননি সুরেশ পরিহার। ছবি: এপি

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৯
Share: Save:

ফুটপাথের উপর সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশের সারি। কেউ কি বেঁচে নেই এঁদের মধ্যে? মানতে চায় না মন। তাই থেকে থেকেই তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসছেন দু’-এক জন। কেউ নাড়ি টিপে ধরছেন প্রাণপণে। কেউ-বা শোয়ানো মানুষটার বুকে মাথা ঠেকাচ্ছেন, যদি কেঁপে ওঠে দৈবাৎ!

কেঁপেছে তো! মৃতদেহে প্রাণস্পন্দন ফেরেনি। কিন্তু রবিবার দ্বিতীয় বারের জন্য কেঁপেছে কাঠমান্ডু। এ বার উৎসস্থল নেপালের কোডারি থেকে ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণে। রিখটার স্কেলে তীব্রতার পরিমাণ ৬.৭। এ দিন দুপুর ১২টা ৪০ নাগাদ ওই কম্পন অনুভূত হয় নেপাল, বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অংশে। কম্পন টের পাওয়া গিয়েছে দিল্লি, পশ্চিবমঙ্গ-সহ ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে। রাত ১০টা নাগাদ আরও একটি কম্পন অনুভূত হয় নেপাল ও ভারতে। রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫.৪। নেপালের আবহাওয়া মন্ত্রক সূত্রের খবর, আরও কম্পনের সম্ভাবনা রয়েছে আগামী দিনে।

মৃতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ২,৫০০ ছাড়িয়েছে নেপালে। আহতের সংখ্যা ৬ হাজারেরও বেশি। ভারতে সব চেয়ে ক্ষতি হয়েছে বিহারে। মৃতের সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়েছে বলে জানান বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি, সারা দেশে মৃতের সংখ্যা ৬২। বিহারে ৪৬, উত্তরপ্রদেশে ১৩, পশ্চিমবঙ্গে ২ এবং রাজস্থানে ১।


কাঠমান্ডুর স্বয়ম্ভূ এলাকায় বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়েছিলেন বন্ধু ও তিনি। ওই অবস্থাতেই মরতে
দেখেছেন পাশে পড়ে থাকা বন্ধুকে। রবিবার উদ্ধার করা হয় সুরেশকে। ছবি: এএফপি।

নেপালে মৃতের সংখ্যা আরও তিন গুণ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা। কারণ এখনও বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নীচে আটকে রয়েছেন। খোঁজ নেই কয়েক হাজারের। শুধু কাঠমান্ডুতেই এখনও পর্যন্ত হাজারের বেশি মৃত্যুর খবর মিলেছে। তার মধ্যে আজ ফের ভূমিকম্পের কারণে কাঠমান্ডুতে বিকেল ৪টে পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বন্ধ রাখা হয় উদ্ধারকাজ। লাগোয়া জেলা রাসুয়া, গোর্খা, সিন্ধুপালচক, ধারিং, কাভরেপালানচক এবং ঢোলাকাতেও একই ছবি। সঙ্গে চোখ রাঙাচ্ছে বৃষ্টি। আবহবিদদের দাবি, বিশেষত দেশের পূর্ব অংশে আগামী দু’দিন ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে আজ ফের তুষার-ধস নেমেছে এভারেস্টে। পরিস্থিতির কারণে ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে নেপাল সরকার।

কাঠমান্ডু শহরটা যেন প্রকৃতির তাণ্ডবে রাতারাতি দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। যার একটা অংশ ঘুমিয়ে মাটির নীচে। অনড়, প্রাণহীন। অন্যটা তাঁবু খাটিয়ে খোলা আকাশের নীচে। শহরের মাঝখানে প্যারেড গ্রাউন্ডে তাঁবু খাটানো হয়েছে। আশ্রয় নিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। ভয়ে বাড়ি ফিরতে চাইছেন না কেউ। রাস্তায় নেমে আসতে হয়েছে দেশের প্রেসিডেন্টকেও। কাল সারা রাত তাঁবুর মধ্যেই কাটিয়েছেন রামবরণ যাদব। প্রেসিডেন্টের দেড়শো বছরের পুরনো দফতর-আবাসন ‘শীতল নিবাস’-এ একাধিক জায়গায় ফাটল ধরেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালার বাসগৃহও।

কাঠমান্ডুর রাজপথ এখন ফাটলে ফাটলে চৌচির। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে বেশির ভাগ বহুতল। ধ্বংস হয়েছে ঐতিহ্যশালী কাষ্ঠমণ্ডপ, বসন্তপুর দরবার, দশাবতার এবং কৃষ্ণ মন্দির। মুম্বইয়ে সাংবাদিকতা করেন নেপালের লেংদুপ ভুটিয়া। মুম্বইয়ের একটি সংবাদপত্রে তিনি লিখেছেন তাঁর ছোটবেলার স্মৃতি। দাদু বলতেন, পৃথিবী যদি কোনও দিন ধ্বংস হয়ে যায়, বোধনাথ স্তূপ তোমাকে রক্ষা করবে। মধ্য তিরিশের লেংদুপ ভারতে বসে খবর পাচ্ছেন, সেই বোধনাথ স্তূপের গায়েই চিড় ধরেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পশুপতিনাথ মন্দিরও। আজ ধরহরা মিনারের ধ্বংসস্তূপ থেকে ২০০টি দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বাতাসে ধুলোর গন্ধ, মাটিতে রক্তের দাগ। আর স্বজনহারা কান্নায় ভারী চারপাশ।

চিকিৎসকদের আশঙ্কা, এ দিনের দ্বিতীয় কম্পনের পর আহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এ দিকে ওষুধপত্রের মজুত দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। পোখরায় চিকিৎসা চলছে হাসপাতালের বাইরেই। হাসপাতাল ভবনের মধ্যে ঢুকতে ভয় পাচ্ছেন চিকিৎসক-কর্মীরা। বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ নেই শনিবার থেকে।


তথ্যচিত্র তুলতে এভারেস্ট বেসক্যাম্পে ছিলেন এএফপি-র চিত্রগ্রাহক রোবের্তো শ্মিট।
হঠাত্ দেখলেন, ধেয়ে আসছে তুষারধস। শনিবার।

রবিবার নতুন করে ভূমিকম্পের পরে অবশ্য দীর্ঘক্ষণ বন্ধ রাখা হয়েছিল অসামরিক বিমান পরিষেবা। বিকেলের পর তা স্বাভাবিক হয়েছে বলে এয়ার ইন্ডিয়া সূত্রের খবর। সারা দিনে কাঠমান্ডুর উদ্দেশে পাঁচটি উড়ান চালু রাখতে চেয়েছিল এয়ার ইন্ডিয়া। যার মধ্যে তিনটি বাতিল করতে হয়েছে। ইন্ডিগো এবং স্পাইসজেটের একটি করে উড়ান যাত্রা শুরু করেও ফিরে আসে। এরই মধ্যে আজ সারা দিনে কাঠমান্ডু-সহ নেপালের বিভিন্ন এলাকায় আটকে পড়া প্রায় ১০৫০ জন ভারতীয়কে দেশে ফিরিয়ে এনেছে বায়ু সেনা। আটকে পড়া ভারতীয় মহিলা ফুটবলের অনূর্ধ্ব ১৪ দলের ১৮ জন সদস্যকেও ফেরানো হয়েছে বলে বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর। এয়ার মার্শাল অরূপ রাহা জানিয়েছেন, আরও ১৩টি বড় উদ্ধারকারী বিমান কাঠমান্ডুতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উদ্ধারকাজে তৎপরতা বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নেপালে মৃত ভারতীয়দের পরি বারকে ৬ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। উদ্ধারকাজ নিয়ে এ দিন একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর আরও ৩০০ কর্মীকে নেপালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। উদ্ধারকাজ ও ত্রাণে আন্তর্জাতিক সাহায্য চেয়েছে নেপালও। সাহায্যের প্রতিশ্রুতি মিলেছে আমেরিকা, ব্রিটেন, চিন, পাকিস্তান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফে। বিপর্যয়ের মুখে নেপালের পাশে দাঁড়াতে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে ইজরায়েল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE