ডাউনটাউন ব্রিসবেনের অভিজাত হোটেল সোফিটেল! ধোনিদের স্থানীয় আস্তানা।
তার প্রশস্ত বারে বসে রেড ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে ভারতীয় টিম ডিরেক্টর বললেন, “এখনই আমাদের লড়াইয়ের বাইরে ফেলে দেবেন না যেন। সেকেন্ড ইনিংসে আমরা সাড়ে তিনশো করে দিলে ম্যাচ আছে।”
দুপুরে যখন একচেটিয়া মারছেন অস্ট্রেলিয়ার টেলএন্ডাররা। মানসিক ভাবে অর্ধনমিত দেখাচ্ছে ভারতের ক্রিকেট পতাকা। ডিপ্রেশনের অবস্থা গাব্বাজুড়ে ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীর। সেই সময় চ্যানেল নাইনে ডাকা হয়েছিল তাঁকে। সেখানেও শেন ওয়ার্নকে একই কথা বলে এলেন ভারতীয় টিম ডিরেক্টর। “ম্যাচ চলে যায়নি। আমরাও রান করব। তার পর অস্ট্রেলিয়াকে ফোর্থ ইনিংসে কিন্তু রানগুলো তুলতে হবে।”
এখন শুক্রবার রাত ন’টা। ক্রিসমাসের আগে শেষ উইকএন্ডের আবাহনে উত্তাল ব্রিসবেন। আজ থেকে অস্ট্রেলিয়া জুড়ে বড়দিনের ছুটি পড়ে গেল। সোফিটেল হোটেলেও যেন সবে সন্ধে হল। বারের ভেতর লোকে এসেই চলেছে। দীর্ঘ পা-টা প্রসারিত করে এ বার রিস্টওয়াচ দেখলেন রবি শাস্ত্রী। “ও বাবা, ন’টা! শুয়ে পড়ি।”
ন’টায় ঘুমিয়ে পড়ার কথা চিন্তা করছেন শাস্ত্রী, এ তো গাব্বায় তৃতীয় দিন পিচ যে অসম্ভব ব্যাটসম্যান সহায়ক হয়ে পড়ল। অস্ট্রেলিয়ার শেষ চার ব্যাটসম্যান মোট ২১৫ রান করলেন এ সবের চেয়েও বিস্ময়কর! কোনও কুইজ শোয়ে যদি এখুনি জিজ্ঞেস করা হত গাব্বায় কোণঠাসা কোন পক্ষ? তা হলে ভারতই একমাত্র উত্তর। এখনও তাদের নেট স্কোর দেখাচ্ছে যে মাইনাস ২৭। ইন ফর্ম ব্যাটসম্যান হারিয়ে হাতে নয় উইকেট।
ডনের দেশে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়া মোটামুটি সব ভারতীয় দলই আগাম হাত তুলে দিয়েছে। এরা সেটা করতে রাজি নয়। টিমটার নামেই ধোনি ক্যাপ্টেন। অন্তর্লীন স্পিরিটটা তৈরি হচ্ছে কোহলি-ধবন-বিজয়-ইশান্ত এই সব কমবয়সিদের নিয়ে। আর এঁদের অর্কেস্ট্রার কনডাক্টর হলেন শাস্ত্রী। যিনি নিজের জীবনে চির-রক্ষণশীল বম্বে হলেও নতুন ভূমিকায় ছেলেদের বোঝাতে পেরেছেন, অবস্থা যা-ই হোক একমাত্র জেতার জন্যই ঝাঁপাবে।
ব্রিসবেন টেস্ট যে অবস্থায় তিন রকম পরিস্থিতি ঘটতে পারে।
সম্ভাবনার অর্ডারে সাজালে
১) অস্ট্রেলিয়া স্টিভ স্মিথ-মিচেল জনসনের মোড় ঘোরানো ১৪৮ রানের পার্টনারশিপের দৌলতে জিতল।
২) ভারত দারুণ ব্যাট করে ড্র করতে পেরেছে।
৩) ক্ষতচিহ্নওয়ালা উইকেটে চতুর্থ ইনিংস দ্রুত শেষ করে অস্ট্রেলিয়াকে হারাল ভারত।
তিন নম্বরটা যত ক্ষীণই হোক। কোহলির শনিবারের গাব্বা ইনিংসের ওপর যত প্রচণ্ড রকম নির্ভরশীল হোক। টিমের তরুণরা মানতেই রাজি নন যে অস্বাচ্ছন্দে আছেন। ভারতীয় টিম ডিরেক্টরকে এক সময় বলা হত জিটিইউ। গির গয়ে ভি টাঙ্গ উপর। কোহলিদের এই টিমটা এ বার সমবেত ভাবে যেন জিটিইউ হওয়ার দিকে এগোচ্ছে! ভাগ্যচক্রে অ্যাডিলেডের সেই চিরস্মরণীয় তারিখের ঠিক সাত দিনের মধ্যেই নতুন পরীক্ষা এ দিন। আবার অ্যাডিলেডের চাপ! কিন্তু ধবন-কোহলিদের দেখে মনে হল তাঁদের মনোভাব হচ্ছে— অস্ট্রেলীয় মাঠের মন্বান্তরে মরিনি, আমরা চাপ নিয়ে ঘর করি।
তারুণ্যের এ দিকটা যেমন আকর্ষণীয়। আর একটা দিক হল উত্সাহের প্রাচুর্যে ভেসে যাওয়া। এগারো বছর আগে ওয়ান্ডারার্সে এমন প্রাচুর্য মর্মান্তিক ভুগিয়েছিল সৌরভের ভারতকে। যখন কাপ ফাইনালে হেডেনকে স্লেজ করতে গিয়ে জাহির আর নেহরা নিজেরাই দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। ওটা ছিল ওয়ান ডে। এটা টেস্ট। ওটায় সৌরভ। এটায় ধোনি। কিন্তু এগারো বছর পর ওয়ান্ডারার্স এসে যেন গাব্বার হাত ধরল! একটা সময় অস্ট্রেলিয়া ২৪৭-৬। ভারত সম্পূর্ণ খেলার দখলে। নেমেছেন মিচেল জনসন।
হঠাত্ তাঁকে স্লেজিং শুরু করলেন রোহিত শর্মা। তার পর বিরাট কোহলি ছুটে গেলেন সে দিকে। ধোনিরও হঠাত্ কী হল, তিনি পেসারদের নির্দেশ দিলেন যত পারো শর্ট পিচ। তখন হঠাত্ই ভারতীয় ফিল্ড প্লেসিং এত মাচো হয়ে গিয়েছে যে, মিড অফ পর্যন্ত নেই। সব আশেপাশে। আর দু’জন ফিল্ডার হুকের জন্য। বোলিংয়ে ছন্দ না পাওয়া জনসন একটু ডাউন হয়ে ক্রিজে এসেছিলেন। রাগিয়ে দিয়ে কোহলিরা যেন তাঁকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে দিলেন। ভারতীয় পেসাররা যত শর্ট বল করছেন, তত তিনি মারছেন। উল্টো দিকে স্টিভ স্মিথকেও নড়ানো যাচ্ছে না। ধোনি ফের নিয়ে এলেন অশ্বিনকে। প্রথম সাত বলের মধ্যেই যাঁর উইকেট রয়েছে। কিন্তু একটা সময় দেখা গেল অশ্বিনের বোলিং হিসেব ১-১ থেকে ১-১২১। নবম উইকেটে অস্ট্রেলিয়া জুড়ল ৫৬। দশমে ৫১। টেলএন্ডারদের টানা শর্ট বল করে গেলেন উমেশরা। বিদেশে এ সব সময় ধোনির সোনার কেল্লার মুকুলের মতো স্মৃতি বিভ্রম হয়। তাঁর নিশ্চেষ্টতায় আরও রান হয়ে গেল।
ভারত মিস করল কোনও অলরাউন্ডারকে। যিনি ব্যাটিংয়ের পাশে মিডিয়াম পেসটাও করে দিতে পারেন গাব্বা সারফেসের সুযোগ নিয়ে। হয়ে উঠতে পারেন ভারতের ওয়াটসন। তা শাস্ত্রী বললেন, “বারবার সৌরভের কথা মনে হচ্ছিল। আজকের দিনে ও আমার হাতে থাকলে খুব কাজে দিত।” এটাও বিস্ময় সিরিজের ওপরের দিকে যাবে সন্দেহ না রেখেই।
এ বার অন্তিম এবং আসল প্রশ্ন, ধোনির ভারত কেমন লড়বে কাল? গাব্বার চতুর্থ দিন ঐতিহাসিক ভাবে যে বিভীষিকা বয়ে আনে তার মতো অবস্থা উইকেটের আদৌ নয়। এখনও ব্যাটসম্যানের খনি। সুইং বিশেষ করেনি। এক-আধটা বল বেশি বাউন্স করেছে। পরীক্ষাটা তাই একান্তই মনের! অ্যাডিলেড যদি আবার ফেরত আনা যায়!
ভারত
প্রথম ইনিংস
৪০৮
স্মিথ বো ইশান্ত ১৩৩
মিচেল মার্শ বো ইশান্ত ১১
হাডিন ক পূজারা বো অ্যারন ৬
জনসন ক ধোনি বো ইশান্ত ৮৮
স্টার্ক বো অশ্বিন ৫২
লিয়ঁ ক রোহিত বো অ্যারন ২৩
হ্যাজলউড নটআউট ৩২
অতিরিক্ত ১৯
মোট ৫০৫।
পতন: ৪৭, ৯৮, ১২১, ২০৮, ২৩২, ২৪৭, ৩৯৫, ৩৯৮, ৪৫৪।
বোলিং: ইশান্ত ২৩-২-১১৭-৩, অ্যারন ২৬-১-১৪৫-২,
উমেশ ২৫-৪-১০১-৩, অশ্বিন ৩৩.৪-৪-১২৮-২, রোহিত ২-০-১০-০।
ভারত
দ্বিতীয় ইনিংস
বিজয় বো স্টার্ক ২৭
ধবন ব্যাটিং ২৬
পূজারা ব্যাটিং ১৫
অতিরিক্ত ৩
মোট ৭১-১।
পতন: ৪১।
বোলিং: জনসন ৮-৩-২৯-০, হ্যাজলউড ৬-০-২৪-০,
স্টার্ক ৪-১-১০-১, ওয়াটসন ৫-৩-৬-০।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy