আইএসএল জিতলে কাকে উত্সর্গ করবেন কলকাতা কোচ আন্তোনিও হাবাস? মা-কে। “ছিয়াশি বছরের মা আমার মাদ্রিদে শয্যাশায়ী। ট্রফি জিতেই মা-কে দেখতে দেশে ফিরব।”
মেহতাব হোসেন ট্রফি জিতে জিদানকে জন্মদিনে উপহার দিতে চান। জিনেদিন জিদান নন। কেরল ব্লাস্টার্স মিডিওর ছেলে জিদান হোসেন। শনিবারই তার জন্মদিন। টিম মালিকের টিকিট নিয়ে মেহতাবের স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে আসছেন মুম্বইতে।
মেহতাবের কোচ ডেভিড জেমস ভারতে আসার পর খবর পান তিনি সর্বস্বান্ত হয়েছেন। নিলামে উঠেছে তাঁর যাবতীয় ফুটবল সরঞ্জাম। জুয়া খেলে আর স্ত্রী-কে ডিভোসের্র খোরপোশ দিতে গিয়ে প্রচুর ধার করে ফেলেছিলেন ইংরেজ বিশ্বকাপার। তারই গুনাগার। “ভারতে আসার পরেই বড় আঘাতের খবরটা পেয়েছিলাম দেশ থেকে। ট্রফি জিতে ফিরতে পারলে কিছুটা স্বস্তি পাব। কিছু টাকাও পকেটে আসবে।”
আটলেটিকো দে কলকাতার মার্কি ফুটবলার লুই গার্সিয়া ট্রফি জিতলে কাকে উত্সর্গ করবেন বলছেন না। তবে হাবেভাবে মনে হল— সেটা হয়তো ফিকরু তেফেরা! ফিকরুকে কোচ ফাইনাল থেকে ছেঁটে ফেলার পর গার্সিয়ার দিকেই তো তাকিয়ে গোটা কলকাতা। ফিকরুর জনপ্রিয়তায় অভিমানী স্প্যানিশ বিশ্বকাপারের দেখানোর আছে, তিনিও জেতাতে পারেন। দলকে করতে পারেন চ্যাম্পিয়ন।
নরিম্যান পয়েন্টের পঁয়ত্রিশ তলা হোটেলের বিভিন্ন ঘর থেকে আইএসএল ফাইনালের আগের দিন এ রকম নানা প্রতিজ্ঞা, অভিমান, জেদ, স্বপ্ন যেন ঠিকরে-ঠিকরে বেরোচ্ছে! ফাইনালের মেজাজ তাই আর শুধু সচিন বনাম সৌরভে আটকে নেই। আটকে নেই কেরল বনাম কলকাতায়।
কেরলের কোচ-কাম-কিপার জেমস যখন অনুশীলন করত করতে কোচিং করাচ্ছেন, তখন ছেলেদের শারীরিক সক্ষমতা পরীক্ষার জন্য মাঠে ‘বাটি’ বসাচ্ছিলেন ট্রেভর মর্গ্যান। ইস্টবেঙ্গলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রাক্তন কোচ এখন কেরল টিমে জেমসের সহকারী। এই ট্রফিটা পেলে কি আপনার তিন বছরেও লাল-হলুদকে আই লিগ দিতে না পারার অতৃপ্তি ঘুচবে? কুপারেজ স্টেডিয়ামের নতুন সিন্থেটিক টার্ফের মতোই চকচক করে ওঠে মর্গ্যানের মুখ। “আই লিগটা খুব কাছে এসেও ইস্টবেঙ্গলকে দিতে পারিনি। আইএসএল জিতলে সেই দুঃখ ভুলব বলছি না। তবে কেরল টিমে আমার ইস্টবেঙ্গলের সেই সময়ের অনেক ফুটবলার আছে। হয়তো একটু স্বস্তি পাব।” এই সে দিনও চিফ কোচের সঙ্গে যাঁর মনোমালিন্য ছিল কোচিজুড়ে আলোচনার বিষয়, ফাইনালের আগে সেই মর্গ্যান ফুরফুরে। জেমসও বুঝে গিয়েছেন ভারতীয় ফুটবলারদের নিলামের সময় মেহতাব, ইসফাক, পেন, সন্দীপদের মর্গ্যান তুলতে না পারলে এই জায়গায় পৌঁছতে পারত না টিম। “প্রথম পাঁচ ম্যাচ তো বুঝতেই পারিনি কী করব। মর্গ্যান সাহায্য করেছিলেন ওই সময়।” হোটেলের ছাদ থেকে ভারতের বাণিজ্য নগরী দেখার ফাঁকে বললেন ইংল্যান্ডের নামী দৈনিকের কলাম-লেখক জেমস।
কেরলের বিরুদ্ধে দু’টো লড়াইয়ের একটাতেও জেতেনি কলকাতা। যুবভারতীতে ড্র। কেরলে বিতর্কিত ম্যাচে জিতেছিলেন হিউমরা। গার্সিয়ার একটা নিশ্চিত গোল বাতিল করেছিলেন রেফারি। যা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল দেশের ফুটবল মহলে। দাবি উঠেছিল আইএসএলে গোললাইন প্রযুক্তি চালুর। দশ কোটি খরচ বলে চালু করা যায়নি।
কোচিতে গার্সিয়ার গোল বাতিলের পর থেকেই ‘চক্রান্ত’ শব্দটা ঢুকে পড়েছে আটলেটিকোর অন্দরমহলে। কী আশ্চর্য! বিশ্বকাপ খেলানো সেই উজবেক রেফারি রবসন-ই ফাইনাল খেলাবেন। যে খবর হঠাত্-ই ফিকরু-বিদায়ে শান্ত হয়ে পড়া হাবাস ব্রিগেডে আতঙ্কের ঢেউ তুলছে। অনুশীলন থেকে বেরোনোর সময় গার্সিয়ার কটাক্ষ এক কর্তাকে, “আবার সেই রেফারি! এ বার হয়তো নাতো কিংবা বোরহার গোল বাতিল করবে লোকটা।” প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, এই দুই দলেরই আগের ম্যাচে যে রেফারিকে ঘিরে বিতর্ক হয়েছে তাঁকেই আবার বাঁশি দেওয়া কেন?
মাঝখানে লন্ডনের কোম্পানির তৈরি করা পঁচিশ কেজি রুপোর ট্রফি রেখে দুই কোচকে বসিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন সংগঠকরা। কোচেদের সঙ্গে এসেছিলেন দুই অধিনায়ক— গার্সিয়া আর হিউম। আটলেটিকো টিম সূত্রের খবর, হাবাসকে কেরল কোচের পাশে বসে সাংবাদিক সম্মেলন করতে রাজি করাতে নাকি কালঘাম ছুটেছে কলকাতা দলের কর্তাদের। আবার রাজি হয়ে প্রেস মিটে হাবাস এমন কিছু গরমাগরম বললেনও না, যা ঢেউ তুলতে পারে এ দেশের ফুটবল মহলে। মোক্ষম সময় ফিকরুর দেশে চলে যাওয়াটা টিমে প্রভাব ফেলবে কি না জানতে চাইলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে শুধু বললেন, “ওর চোট। তাই ফেরত পাঠিয়েছি। তাতে টিমে প্রভাব পড়বে কেন?”
ফিকরু-বিহীন প্রতিপক্ষ নিয়ে মেহতাব অবশ্য বললেন, “কলকাতাকে আটকাতে হলে গার্সিয়াকে খেলতে দেওয়া যাবে না।” গার্সিয়া আর হাবাস— কলকাতার স্প্যানিশ কোচ আর মার্কি ফুটবলারের যুগ্ম মগজাস্ত্র চিন্তায় রেখেছে কেরলকে। কলকাতা টিমের চার বছর আগের বিশ্বকাপজয়ী স্প্যানিশ-মডেলের আলট্রা ডিফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজি ভাঙতে শুক্রবার চমকপ্রদ অনুশীলন করল জেমস-মর্গ্যানের টিম। টিভিতে কুইজের সময় হওয়া ‘র্যাপিড ফায়ার’-এর মতো হোসেমি-অণর্বদের নিয়ে তৈরি রক্ষণ ভাঙতে কতকটা ওই রকম মুহুর্মুহু আক্রমণের স্ট্র্যাটেজি নিতে চাইছে কেরল। টাইব্রেকারকে মাথায় রেখে কুপারেজে দেড় ঘণ্টার অনুশীলনে পেনাল্টি কিক মারা তো চললই। কিন্তু বেশি হল দুই উইং থেকে বল বিপক্ষ বক্সে পাঠানোর সঙ্গেই অ্যাটাকিং থার্ডে আরও কামড় দেওয়ার অনুশীলন।
সেমিফাইনালে চেন্নাইয়ানের এলানোকে নড়তে দেননি মেহতাব। কলকাতার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গার্সিয়াকে আটাকনোর দায়িত্বও বারুইপুরের বঙ্গসন্তানের উপর। অ্যাটাকিং থার্ডে পিয়ারসন নেতৃত্ব দেবেন কেরলকে। অনুশীলনেই বোঝা যায়। হাবাসের পাল্টা আক্রমণের স্ট্র্যাটেজি কেরলের ঘুম ছুটিয়েছে। তবে ফাইনালের আগের দিন হাবাসের অনুশীলনে নতুনত্ব ছিল না। সম্ভবত সেমিফাইনালের দলে কোনও পরিবর্তন করতে চাইছেন না কলকতা কোচ। কেরলের ৪-৪-২-এর পাল্টা ৪-৫-১-ই ধরে রাখতে চাইছেন তিনি।
অলআউট আক্রমণ বনাম কাউন্টার অ্যাটাক— উদ্বোধনী আইএসএল ফাইনালকে কতটা উচ্চাঙ্গে তুলবে সন্দেহ আছে। বিশেষজ্ঞরাও দু’ভাগ। ভাইচুং যেমন বললেন, “কলকাতার ডিফেন্স আর মিডফিল্ড সংগঠন খুব ভাল। ওরাই ফেভারিট।” আবার পাশে দাঁড়িয়ে বিজয়নের মন্তব্য, “ফেভারিট কেরল। ওরাই জিতবেই। আমার ভোট ওদের দিকেই।” প্রাদেশিকতা, না আবেগ— কোনটা ফেভারিট বাছতে কাজ করছে কে জানে! দেল পিয়েরো কিন্তু বললেন, “ক্লোজ ম্যাচ। যে কেউ জিততে পারে। আমি ফেভারিট বেছে বিপদে পড়তে চাই না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy