ফাইনালের নায়ক, নেপথ্যের কারিগর। শনিবার মুম্বইয়ে হাবাস-রফিক। ছবি: উত্পল সরকার
টিভি খুলতে প্রথমেই আটলেটিকো দে কলকাতার লাইনআপের দিকে চোখ পড়ল। আর একই সঙ্গে যেমন গর্বে বুকটা ফুলে উঠল, তেমনই আফসোসে ফেটে পড়ল!
ফিকরু ছাটাই! গার্সিয়া-হোফ্রে প্রথম এগারোয় নেই! বিশ্বাস করুন, আমি শনিবার হাবাসের জায়গায় থাকলে এতটা সাহসী সিদ্ধান্ত কখনওই নিতে পারতাম না। আমাকে নিতে দেওয়াই হত না।
কলকাতার বড় ক্লাবের কোচ হিসাবে কী টিম নামাব কর্তাদের কানে যদি একবার পৌঁছে যায়, তা হলে আর রেহাই নেই। সারা রাত, এমনকী মাঠে দল নামানোর আগে পর্যন্ত রেকর্ড বেজেই যাবে, ‘একে নামান, ওকে বসান। ও ভাল, এ খারাপ’। ভারতীয় ফুটবলের চরম দুর্ভাগ্য হল, ফুটবলে যাঁরা হয়তো কোনও দিন পা দেননি, তাঁরাও ছুটে আসবেন পছন্দের টিম বাছতে।
তাই কলকাতার ঐতিহাসিক আইএসএল জয়ের পরে আমি হাবাসের সাহসকে কুর্নিশ জানানোর পাশাপাশি কলকাতা ফ্র্যাঞ্চাইজির কর্তাদেরও ধন্যবাদ জানাতে চাই। যাঁরা কোচের উপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস রেখেছেন। আফসোস, আমার এত লম্বা কোচিং কেরিয়ারে যা কখনও ঘটেনি। আর ঘটবে কিনাও সন্দেহ!
কলকাতার এই জয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমাদের ক্লাব-ফুটবল অপেশাদারিত্বের কোন অন্ধকার কুয়োয় পড়ে! আমার এখনও মনে আছে, ইস্টবেঙ্গল কোচ থাকার সময় কী ভাবে কর্তারা জোর করে এক জন বিদেশি স্টপার নামিয়েছিলেন ডার্বিতে। সেই ম্যাচ ৩-৪ গোলে হেরেছিলাম। আবার মোহনবাগান কোচ থাকার সময় ওডাফাকে নামানো নিয়ে কত ঝামেলা, কত ঘটনা যে আছে, হয়তো গুণে শেষ করা যাবে না।
একবার ভাবুন তো, ফিকরু-গার্সিয়া-হোফ্রেকে বাদ দিয়ে ফাইনাল খেললেন হাবাস! এবং জিতলেনও। আমি যদি কোনও ডার্বিতে ওডাফা-ভাইচুং-ব্যারেটোকে রিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়ে রেখে নামতাম, সেই রাতেই আমার চাকরি আর থাকত না, গ্যারান্টি! হয়তো একটা ই-মেল পাঠিয়েই তাড়িয়ে দেওয়া হত। যেটা আবার আমি পাওয়ার আগে গণ-মাধ্যমে পৌঁছে যেত।
কলকাতার আটলেটিকোর সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হল, ওরা শেষ মিনিট পর্যন্ত কোচের উপর বিশ্বাস রেখেছে। ফিকরু দলের প্রধান স্ট্রাইকার হলে কী হবে! হাবাস মনে করেছেন, দলের জন্য ও ফিট নয় তো নয়। ওখানেই ফুল স্টপ। কোনও বিতর্ক নেই। ঝামেলা নেই। আর থাকলেও সেটা গণ-মাধ্যমের মাধ্যমে বেরনোর কোনও জায়গা নেই। আমি এর জন্য অবশ্য সৌরভকে আলাদা করে শুভেচ্ছা জানাতে চাই। ও ময়দানটাকে চেনে। জানে কী ভাবে ট্যাকল করতে হয়। আর সেটা করলও দারুণ ভাবে।
তবে অনেকেই হয়তো বলতে পারেন, ফাইনালে কলকাতা না জিতলে কী হত? হ্যাঁ, সেক্ষেত্রে হাবাসের সমালোচনা হত। কিন্তু তাঁর সাহসটাকে তো অস্বীকার করা যেত না! তা ছাড়া টুর্নামেন্টে আটলেটিকোর অনেক খারাপ সময় কিন্তু গিয়েছে। তখনও সেখানে কোচের পাশেই থেকেছেন কলকাতা দলের কর্তারা।
হাবাস যে কত বড় স্ট্র্যাটেজিস্ট, সেটা আজ আর আলাদা করে বলার কোনও দরকার নেই। গোয়া ম্যাচের মতো এ দিনও পুরো অঙ্ক কষে জিতলেন তিনি। তবে পুরো অন্য স্ট্র্যাটেজিতে। সেমিফাইনালে বিপক্ষের গতি সামলাতে খেলাটাকে স্লো করে দিয়েছিলেন।
মুম্বইয়ে বিপক্ষের গতি থামানোর জন্য পাল্টা গতিকেই অস্ত্র বানালেন। তাই গার্সিয়া-হোফ্রের মতো বল ধরে খেলার ফুটবলারদের বসিয়ে সঞ্জু, বলজিত্, আর্নলদের মতো আদ্যন্ত আক্রমণাত্মক মানসিকতার ছেলেদের দিয়ে শুরু করেন। যারা দৌড়তে পারে। একটা সময় দেখে মনে হচ্ছিল, কোনও ব্লকারই নেই কলকাতার টিমে। কিন্তু নিজের দলের স্ট্রাইকার-সমস্যা মেটাতেই এই গতির বিরুদ্ধে পাল্টা গতির স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিলেন হাবাস।
তাতে অবশ্য ঝুঁকিও আছে। কারণ দু’দিকেই গোলের মুখ খোলা থাকে। গোল দেওয়ার মতো গোল খাওয়ারও সম্ভাবনা রয়ে যায়। ফলে গোলকিপারের উপর বাড়তি চাপ পড়ে। তার পারফরম্যান্স বাড়তি মাত্রা পেয়ে যায়। এবং এই জায়গাটায় কলকাতার বিদেশি গোলকিপার বেটে এ দিন অনবদ্য। যেখানে কেরলের বিশ্বকাপার গোলকিপার শেষ মুহূর্তে চাপের মুখে ভেঙে পড়ল।
আমার আরও ভাল লাগছে, আনন্দবাজারে আমি যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, মিলে গেল। কলকাতা সেমিফাইনালে উঠল, কাপও জিতল। তবে এ বার আটলেটিকো কর্তাদের থেকে কিছু পেশাদারিত্বের শিক্ষা নেওয়া উচিত দুই প্রধানের কর্তাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy