Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে রমণীদার কথাগুলো মনে পড়ছে

পঁচাত্তরে ইস্টবেঙ্গল যে বার ক্সাবের ইতিহাসে প্রথমবার টানা ছয় বার কলকাতা লিগ ঘরে তুলল, তখন এই অধম স্পোর্টিং ইউনিয়নের এক নবাগত স্ট্রাইকার। বয়স মোটে ১৪।

ডার্বির আগে ড্রেসিংরুমের রাজপাটে আত্মবিশ্বাসী বিশ্বজিৎ। বৃহস্পতিবার। ছবি:উৎপল সরকার।

ডার্বির আগে ড্রেসিংরুমের রাজপাটে আত্মবিশ্বাসী বিশ্বজিৎ। বৃহস্পতিবার। ছবি:উৎপল সরকার।

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:২৫
Share: Save:

পঁচাত্তরে ইস্টবেঙ্গল যে বার ক্সাবের ইতিহাসে প্রথমবার টানা ছয় বার কলকাতা লিগ ঘরে তুলল, তখন এই অধম স্পোর্টিং ইউনিয়নের এক নবাগত স্ট্রাইকার। বয়স মোটে ১৪।

স্পোর্টিং ইউনিয়নে তখন আমাদের কোচ ছিলেন রমণীদা (রমণী সরকার)। ১৯৭৫ তো ইস্টবেঙ্গলের সোনাঝরা বছর। আই এফ এ শিল্ডে মোহনবাগানকে পাঁচ গোল। সঙ্গে হেক্সা লিগ। মনে আছে, প্রদীপদার (পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়) টিম সে বার টানা নতুন ইতিহাস তৈরি করার পরদিনের ঘটনাটা। রমণীদা হঠাৎ আমাকে আর সতীর্থ অমিত বাগচিকে প্র্যাকটিসের পর ডাকলেন। তার পর বললেন, ‘‘সুভাষ, শ্যাম, সুরজিৎরা কী রকম খেলছে দেখছ? চেষ্টা করো, এক দিন তোমরাও বড় দলে নতুন নজির গড়তে পারবে।’’

চার দশক পর ২০১৫-য় সে দিনের সেই চোদ্দো বছরের ছেলেটাই আজকের ইস্টবেঙ্গল কোচ। সামনে আর দু’টো ম্যাচ। তার মধ্যে একটা আবার সম্মানের ডার্বি। এই দুই ম্যাচ থেকে এক পয়েন্ট পেলেই লিগ উঠবে আমাদের তাঁবুতে। তার চেয়েও বড় কথা, ফের টানা ছ’ বার কলকাতা লিগের রং হবে লাল-হলুদ। ইতিহাস ছুঁতে পারব আমরা।

সে দিনের রমণীদার আরও একটা কথা খুব মনে পড়ছে আজ। ‘‘টার্গেটটা শুরুতেই ঠিক করে নিবি। আর শৃঙ্খলার সঙ্গে আপস করবি না। তা হলেই সাফল্য তোর দরজায় কড়া নেড়ে যাবে।’’

ভাববেন না যে, লিগ জেতার দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে আত্মতুষ্টির ঢেকুর তুলছি। এ বার ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব নেওয়ার পর আবাসিক শিবিরে গিয়ে প্রথম দিনই ছেলেদের এই ‘টার্গেট’টা ফোকাস করে দিয়ে বলেছিলাম, সারা পৃথিবী ওলটপালট হয়ে গেলেও তোমাদের সব ম্যাচ জিততে হবে। তা হলেই হেক্সা লিগ ইস্টবেঙ্গলের। তোমরাও ঢুকে যাবে ইতিহাসে। এ বার ঠিক করো তোমরা কী করবে? এরিয়ান ম্যাচের ড্র বাদ দিলে ছেলেরা সেই কথা কিন্তু এখনও পর্যন্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। সামনে আরও দু’টো হার্ডল। মনে হয় ও দু’টোই পেরিয়ে যাব আমরা।

রবিবারের ডার্বি ড্র করলেই লিগ আমাদের। এই পরিস্থিতিতে আমরাই চাপে বলে একটা মহল থেকে প্রচার হচ্ছে। বুধবার কালীঘাট এমএস ম্যাচের পর ড্রেসিংরুমে খাবরা, অবিনাশদের বললাম কোনও ড্র নয়। বাকি মোহনবাগান এবং সাদার্ন সমিতি ম্যাচ আমাদের জিততেই হবে। আমরা লিগও নেব, ডার্বিও জিতব। এটাই আমাদের শপথ।

জানি, কেউ কেউ এতটা পড়েই হয়তো বলতে শুরু করেছেন, ডার্বিতে যদি আপনার ডং আটকে যায়? তা হলে কী করবেন? মনে রাখবেন, পুলিশ ম্যাচেও ডং আটকে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা প্ল্যান বি-র তাস ফেলতেই ডং গোল করে। কাজেই ডং আটকে গেলে কী ভাবে প্ল্যান বি মগজ থেকে বের করে ডার্বি জয়ের অঙ্ক মিলিয়ে দিতে হবে তা নিয়ে ড্রেসিংরুমে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। চলছেও। আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টাতেও হবে। আর বিশদে নাই বা বললাম।

কথা উঠবে, আট ম্যাচে আমাদের টিমের আট গোল খাওয়া নিয়ে। যা নিয়ে কোনও অজুহাত খাড়া না করেই বলছি, আমাদের ডিফেন্সের কয়েক জন চোটের জন্য একটু দেরিতে ম্যাচ ফিট হচ্ছে, কেউ বা আইএসএলে চলে গিয়েছে। তাই বোঝাপড়াটায় একটু গণ্ডগোল হচ্ছে কখনও কখনও। কথা দিচ্ছি আত্মসম্মানের ডার্বিতে সেটা হবে না।

বৃহস্পতিবার আনন্দবাজারেই দেখলাম ডার্বিতে আমার দলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বাগান কোচ ভ্রাতৃসম সঞ্জয় সেন মন্তব্য করেছেন— যদি কালীঘাট ইস্টবেঙ্গলকে তিন গোল দিতে পারে তা হলে আমরাও...। মজার ব্যাপার ওই প্রতিবেদনেই সঞ্জয় আমার হয়ে উত্তরটাও দিয়ে ফেলেছে। ‘‘টিমটা গোল খেলেও গোল দিয়ে ম্যাচ জেতার ক্ষমতা রাখে।’’

আশা রাখি, রবিবার লাল-হলুদ সমর্থকরা মশাল জ্বালিয়েই বাড়ি ফিরবেন। আমার ছেলেরা ড্রেসিংরুমে সে ব্যাপারে কথা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে শুধু বেলো, গুরবিন্দর, র‌্যান্টিকে ডেকেছিলাম অনুশীলনে। সেখানে ওরাও কথা দিয়েছে, কালীঘাট ম্যাচের ভুল ডার্বিতে হবে না।

অফিসে, রাস্তাঘাটে, বাজারে গেলে অনেক লাল-হলুদ সমর্থকই এগিয়ে এসে জানতে চাইছে ইস্টবেঙ্গল টিমটার জোশ কয়েক মাসে এতটা বদলে গেল কী ভাবে? উত্তরটা হবে— আমার সাপোর্ট স্টাফ আর টিম স্পিরিট। দেবজিৎ, সঞ্জয় স্যামিরা মাঠে ও ড্রেসিংরুমে টিমের সঙ্গে এতটাই একাত্ম যে কোনও অবাঞ্ছিত ঘটনার সম্ভাবনাই তৈরি হয়নি এই কয়েক মাসে। আর আমার ফুটবলাররা? সবাই বলছে, ‘‘ডং কো পকড়না মুশকিল হি নহি, নামুমকিন হ্যায়।’’ ডং ভাল ফুটবলার সেটা মানছি। কিন্তু ওকে গোলের বল যারা বাড়াচ্ছে সেই খাবরা, মেহতাব, সামাদ বিকাশদের কথাটাও বলুন। এই স্পিরিটটাই আমাদের এগিয়ে চলার রসদ। খাবরা, তুলুঙ্গা, দীপকদের সহযোগিতার তুলনা নেই। খাবরা তো টিমের জন্য বুধবার স্টপারেও খেলে দিল। এর পর গোলকিপারের জায়গাটা ওর জন্য বাকি রয়েছে। জুনিয়র, সিনিয়র এই বন্ডিংটাই দু’গোল খেলেও এ বার আমাদের ঠিক ম্যাচ জিতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

আর এর জন্য একটা বড় ধন্যবাদ প্রাপ্য আমার সাপোর্ট স্টাফ দেবজিৎ, সঞ্জয়, স্যামির। ম্যাচের মাঝে ওদের সহযোগিতাও ইস্টবেঙ্গলকে টিম হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।

এর আগে মাঝপথে মোহনবাগানের দায়িত্ব নিয়ে বাগানে শেষ বার কলকাতা লিগটা এনে দিয়েছিলাম। সেই পাঁচ বছর আগের মে মাসে। এ বার মরসুমের শুরু থেকেই ইস্টবেঙ্গলে চিফ কোচের দায়িত্বে। সাংবাদিক বন্ধুদের প্রশ্ন লিগটা পেলে ময়দানে প্রতিষ্ঠিত হব কি না।

না, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য তাতেও প্রতিষ্ঠিত হবে না। কারণ আমার কোচ হিসেবে আরও অনেক কিছু প্রমাণ করতে হবে। করার আছে। এগিয়ে যাওয়ার এই শিক্ষাই তো রমণীদা, প্রদীপদা, অমলদারা দিয়ে গিয়েছেন।

আর সবশেষে ওই সমর্থকদের একটা ধন্যবাদ। যারা মরসুমের শুরুর দিকে রোজ আমার জন্য বাছা বাছা বিশেষণ নিয়ে মাঠে আসতেন। ওঁদের সেই কটাক্ষগুলোই যে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে মেহতাবদের সেরা ফুটবলটা মাঠে বের করে আনতে। ডার্বিতে প্লিজ আপনারা মাঠে আসুন। মোহনবাগানকে হারিয়ে লিগ জিতলে সেই আনন্দ উৎসবে আপনাদেরও পাশে চায় বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE