পেলের দেশ থেকে বিশ্বকাপ জয় করে জোয়াকিম লো-র জার্মানি শুধু লাতিন আমেরিকার মাটিতে প্রথম ইউরোপিয়ান দেশ হিসেবে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ডই করেনি। স্বয়ং জার্মান কোচ বোধহয় বিশ্ব ফুটবলে কোচেদের নতুন ধারার জন্ম দিলেন!
আপনাকে মোটেই বড় ক্লাবের প্রাক্তন ফুটবলার হতে হবে না! জাতীয় দলের প্রাক্তন তারকা হওয়ারও দরকার নেই। কোচের সিভি-তে প্রচুর অভিজ্ঞতার বিবরণ না থাকলেও চলবে। মিডিয়া হাইপ তোলার মতো মন্তব্য না করে চুপচাপ নিজের কাজ করলেও দিনের শেষে মেগাকোচের স্বীকৃতি পাওয়া যাবে... ইত্যাদি, ইত্যাদি।
চুয়ান্ন বছরের জোগি লো ফুটবলারজীবনে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ভীষণ ডিফেন্সিভ। কোনও স্ক্যান্ডাল নেই। জাতীয় দলের হয়ে কোনও দিন খেলেননি। জার্মান জার্সি গায়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতা অনূর্ধ্ব-২১ দলের হয়ে দু’বছরে (১৯৭৯-’৮০) সাকূল্যে চারটি ম্যাচে। ক্লাব? সে-ও তো আটাত্তর থেকে দীর্ঘ দেড় দশকে ন’টা বিভিন্ন টিমে খেললেও দরের ক্লাব বলতে একটাই ভিএফবি স্টুটগার্ট।
পঁচানব্বইয়ে ফুটবলার হিসেবে অবসর নেওয়ার এক বছর আগেই কোচিংয়ে এসে পড়েছিলেন। তাতেও তো কুড়ি বছরে ক্লাব আর জাতীয় দল মিলিয়েটিলিয়ে ১১টা টিমকে কোচিং করিয়েছেন। কিন্তু ১৩ জুলাই, ২০১৪-র আগে কোনও বড় ট্রফি নেই। কিন্তু জোগি লো-র প্রথম ট্রফিটাই বিশ্বফুটবলের সর্বোত্তম ট্রফি ফিফা বিশ্বকাপ! অথচ য়ুরগেন ক্লিন্সম্যান আর চুক্তি পুনর্নবিকরণ করতে না চাওয়ায় ২০০৬-এ তাঁর সহকারী লো যখন জার্মান জাতীয় দলের চিফ কোচের দায়িত্বে এলেন, তার পর থেকে রবিবারের মারাকানা অবধি তাঁর রেকর্ড রীতিমতো ঈর্ষণীয়। ১১২ ম্যাচে ৭৭ জয়, ২০ ড্র, মাত্র ১৫ হার। সাফল্যের শতাংশ প্রায় ৬৯%।
তা সত্ত্বেও এত দিন ছ’ফুটের, দলের ম্যাচেও মাঠে স্টাইলিস্ট আউটফিটে থাকা লো-র কোচিং ঘরানার কত সমালোচনা! আসলে বিভিন্ন বড়মাপের টুর্নামেন্টে গত আট বছরে নক আউটের মোক্ষম সময়ে লো-র জার্মানির পতনই সমালোচনার কারণ। ২০০৮ ইউরো ফাইনাল... ২০১৪ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল... ২০১২ ইউরো সেমিফাইনাল সবেতে জার্মানি পৌঁছেছে কিন্তু মাঠ ছেড়েছে বিজিত টিম হিসেবে।
মারাকানা ফাইনালই লো-র জার্মানির প্রথম ব্যতিক্রম! বিশ্বকাপেও ফিলিপ লাম-কে পরিচিত ফুলব্যাক না খেলিয়ে উইং হাফে খেলানোটা রক্ষণশীল জার্মানদের পছন্দ হয়নি। অথচ কেউ লক্ষ্য করেনি, ফুলব্যাক পজিশনে ফিরে গিয়েও ছোটখাটো চেহারার জার্মান অধিনায়ককে ফাইনালে কতবার টাচলাইন দিয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠতে দেখা গিয়েছে! কতবার দলের আক্রমণে ডিফেন্স থেকে লাম তাতে বাড়তি তীক্ষ্মতা আমদানি করেছেন।
ব্রাজিলে লো-র জার্মানির খেলাটার ফুটবলমহল একটা নতুন নাম দিয়েছে ‘কুইকিতাকা’। বা, ডাইরেক্ট তিকিতাকা। মানে জাভি-ইনিয়েস্তাদের স্পেনের মতোই পাস-পাস-পাস কিন্তু সেটা অনেক বেশি গতিতে। যা স্পেনও পারেনি। বায়ার্নের প্রাক্তন বার্সেলোনা কোচ পেপ গুয়ার্দিওলার তিকিতাকাকে একটু অন্য ভাবে জার্মানি দলে প্রয়োগ করেছেন লো। তার জেরেই ফাইনালে মেসিকে স্রেফ জোনাল মার্কিয়ে বোতলবন্দি করে রেখেছিলেন সোয়াইনস্টাইগাররা।
আর একটা জিনিস লো তাঁর ব্রিগেডে সফল ভাবে এনেছেন। জার্মান ফুটবলের যুব শক্তির সিনিয়র জাতীয় দলে নিখুঁত প্রতিষ্ঠা। ২০১৪ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন জার্মানি দলের হাফডজন ফুটবলারের ২০০৯ অনূর্ধ্ব-২১ ইউরো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব আছে। দেশের ফুটবল ফেডারেশনের ইউথ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম আর ইউথ কোচের (বিশ্বজয়ী কোচ হিসেবে লো-র চুয়ান্ন বছরটা একটা বয়স হল!) যুগলবন্দিতে আজ জার্মানি বিশ্বসেরা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy