Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

গোললাইনে রক্ষণ নয়, চাই শূন্য দখলের মাস্তানি

বিপরীত মেরুর দুই গোলকিপার। গোল লাইনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে গোল বাঁচাচ্ছেন ওচোয়া।

বিপরীত মেরুর দুই গোলকিপার। গোল লাইনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে গোল বাঁচাচ্ছেন ওচোয়া।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৪ ০২:৫৩
Share: Save:

রোগ নিরাময় নয়। রোগ প্রতিরোধ!

এই কথাটাকে যেন অদলবদল করে নিয়েছেন এ বারের বিশ্বকাপের বেশ কয়েক জন গোলকিপার। ব্রাজিলে দুরন্ত পারফর্ম করা মেক্সিকোর গুলেরমো ওচোয়া, নাইজিরিয়ার ভিক্টর এনিয়েমা, কোস্টারিকার কেলর নাভাসরা পড়েছেন সেই তালিকায়।

এক জন ভাল চিকিৎসকের কাছে রোগীকে সারিয়ে তোলা মুখ্য নয়। তাঁর প্রধান কাজ, রোগকে রোগীর ধারে-কাছে ঘেঁষতে না দেওয়া। ব্রাজিলের মাঠে ওচোয়াদের দর্শন ঠিক তার উল্টো। এ বারের বিশ্বকাপে গোলের নীচে দাঁড়িয়ে যাঁদের দর্শন ছিল রোগ প্রতিরোধ নয়। রোগ নিরাময়। অর্থাৎ কোনও ভাবে গোলটা বাঁচিয়ে দাও। টেকনিকের গলদ নিয়ে পরে ভাবা যাবে।

এঁদের পারফরম্যান্সের ময়নাতদন্তের পর এক দল বিশেষজ্ঞ বলেই দিচ্ছেন, বিশ্বকাপে এঁদের সেভগুলো ঝলমলে লাগলেও, গোড়ায় কিন্তু গলদ রয়েছে এই কিপারদের।

দুরন্ত রিফ্লেক্সের সৌজন্যে এঁদের বক্সের মধ্যে লাফ-ঝাঁপ, অনবদ্য সেভ সাধারণ দর্শকের প্রশংসা কুড়োলেও বেশ কয়েকটি প্রাথমিক ভুল বিশেজ্ঞদের ভ্রু কুঁচকে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। কারও আউটিং খারাপ তো কেউ বক্সে শট মারার জন্য সময় দিচ্ছেন প্রতিপক্ষকে। কেউ আবার সহজ এরিয়াল বল তালুবন্দি করার বদলে তা চাপড় মেরে বার করে দিয়েই খালাস। গণ্ডগোল রয়েছে ফুটওয়ার্কেও। কিন্তু গোল বাঁচানোর দক্ষতায় এ বলে আমাকে দেখ তো ও বলে আমায়!

এক কথায় ব্যাপারটা এ রকম প্রথাগত নয়। কিন্তু ফলপ্রসূ প্রয়াস! যা দর্শকদের প্রশংসা কুড়োলেও নিরাশ করেছে বিশেষজ্ঞদের। নিরাশ করছে, কারণ এঁরা গোলকিপিংয়ের ব্যাকরণটাই ভুলে মেরে দিয়েছেন। ছ’ গজের বক্সে দাঁড়িয়ে থেকে ডিফেন্ডারদের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়েই থেকে যাচ্ছেন। প্রয়োজনে কখনও শূন্যে, কখনও জমিতে সাহস এবং নিখুঁত টাইমিং দেখিয়ে আক্রমণের গোড়াতে করাত চালাতে পারছেন না। এই প্রতিরোধের কাজটাই কিন্তু একজন আদর্শ গোলকিপারের আসল পরিচয়।

তবে বিশ্বকাপে কিপিং করা সকলেই যে এই দলে পড়ছেন তা নয়। যেমন জার্মানির গোলকিপার ম্যানুয়েল নয়্যার। জোয়াকিম লো-র দলের শেষ প্রহরী আলজিরিয়ার বিরুদ্ধে তো একইসঙ্গে দুটো ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। কিপার-কাম-সুইপার। যেমন অ্যান্টিসিপেশন, তেমনই গোল ছেড়ে বেরোনো। শূন্যেও বিপক্ষ ফুটবলারদের সঙ্গে লড়াইয়ে নয়্যারই বাজিমাত করেছেন। একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতিতেও বিপক্ষ ফরোয়ার্ডের সামনে গোলের অ্যাঙ্গেল ছোট করে দিয়ে তাঁকে বাধ্য করেছেন গায়ে মারতে। আলজিরিয়ার বিরুদ্ধে তো ১৯ বার বক্স থেকে বেরিয়ে এসে বাঁচিয়েছেন জার্মানদের। দেখা গিয়েছে নয়্যার দাঁড়িয়েছিলেন গোল লাইনের ১২ গজ আগে।


নয়্যার সেখানে ৬ গজের বাইরেও অপ্রতিরোধ্য।

যা দেখার পর প্রাক্তন ভারতীয় গোলকিপার তনুময় বসু বললেন, “এটাই বুঝিয়ে দেয় নয়্যার অন্যদের চেয়ে আলাদা। ওচোয়াদের রিফ্লেক্স ভাল। কিন্তু এক জন আদর্শ কিপারের যা-যা গুণ থাকা দরকার তার বেশির ভাগটাই দেখলাম নয়্যারের খেলায়।”

এখানেই না থেমে তনুময় বলেন, “গোললাইন থেকে ১২ গজ এগিয়ে থাকার কারণ একটাই। সে দিন জার্মান ডিফেন্ডাররা অনেকটা উপরে উঠে খেলছিল। ডিফেন্স চেরা কোনও থ্রু এলে যাতে প্রয়োজনে মাঝমাঠে এসে সেই বল ক্লিয়ার করা যায় সেটাই মাথায় রেখেছিল নয়্যার।”

ফরাসি লিগে খেলা ওচোয়া ব্রাজিল এবং নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে যে খেলা দেখিয়েছেন তার পরে বীরের সম্মান পেয়েছেন দেশে ফিরে গিয়ে। তাঁর সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করেছেন ইউরোপের প্রথম সারির ক্লাবগুলোও। কিন্তু ওচোয়া ধরা পড়ে গিয়েছেন প্রযুক্তির কাছে।

যে চার ম্যাচ তিনি খেলেছেন এ বারের বিশ্বকাপে, সেগুলোতে তাঁর ‘হিট ম্যাপ’ (খেলা চলাকালীন যে সব জায়গায় ফুটবলারটি মুভ করে তার রেখচিত্র) অনুযায়ী, ওচোয়া বেশির ভাগ সময় থেকে গিয়েছেন তাঁর ছ’গজ বক্সের ভিতরে। নেদারল্যান্ডস ম্যাচে আবার ডাচ ব্রিগেডের স্তেফান দে ভ্রিস-এর শট খুব কাছ থেকে বাঁচিয়ে মেক্সিকোর এই গোলকিপার হাততালি পেলেও ধরা পড়ে গিয়েছেন অন্য জায়গায়। টিভি ক্যামেরায় দেখা গিয়েছে, যে বলে দে ভ্রিস শট নিয়েছিলেন, তা যখন বক্সে উড়ে আসে তখন তা বিপন্মুক্ত করার জন্য ঠিক জায়গায় ছিলেন না ওচোয়া। তাঁর আউটিংয়ের ভুলেই বলটা পেয়ে গিয়েছিলেন ভ্রিস। এমনকী অন্যান্য ম্যাচেও বেশ কয়েকটি সেভের সময় ওচোয়ার চোখও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ বলের উপর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চোখ রাখার যে আপ্তবাক্য, সেটাই মানেননি ওচোয়া।

নাইজিরিয়ার ভিক্টর এনিয়েমা ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অনবদ্য খেললেও শেষ লগ্নে গোলের দিকে ভেসে আসা ক্রস অনুমান করতে পারেননি। এতটাই নড়বড়ে ছিলেন যে গোল ফাঁকা রেখে বেরিয়ে যান। ম্যাচের পর যে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে দলের কোচ স্টিফেন কেসি বলেছিলেন, “বড়সড় মূল্য চোকাতে হল।” এর পরেই প্রশ্নটা তুলে দিয়েছেন ওচোয়ারই দেশের প্রাক্তন বিশ্বকাপার গোলকিপার জর্জ কাম্পোস। চুরানব্বইয়ের বিশ্বকাপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রংবেরং-এর জার্সি পরে নেমে যিনি সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। কাম্পোস বলছেন, “এরা আসল সময় গোললাইন ছেড়ে বেরোতেই ভয় পায়।” গোলকিপার কোচেদের দুষে বলেছেন, “কেউ এদের সঠিক ব্যাপারটা শেখায়ও না।”

আসলে যে কারণে কাম্পোসের এই আক্ষেপ তার পিছনে যুক্তি রয়েছে। ওচোয়া, এনিয়েমা, নাভাসদের মতো কেউ-কেউ নিজেদের দুরন্ত রিফ্লক্সের সুবাদে হকির গোলকিপারের মতোই কাছ থেকে নেওয়া শট রুখে হাততালি কুড়িয়েছেন দেদার। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, মাঠে দর্শনীয় সেভ বা পেনাল্টি বাঁচানোর চেয়েও এক জন কিপারের বড় গুণ বিপক্ষের ফুটবলারকে শট নিতে না দেওয়া বা শট নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে না দেওয়া। ঠিক এখানেই ফেল করে গিয়েছেন ওচোয়ারা।

যা শুনে ডেনমার্কের লিগে খেলা ভারতীয় গোলকিপার সুব্রত পাল বলছেন, “ওদের কয়েক জনের গোলকিপিংয়ের গোড়ায় কিছু ভুল রয়েছে তা দেখেছি। টি-২০ ক্রিকেটেও তো প্রথার বাইরে শট নিয়ে সফল ক্রিস গেইল, সহবাগরা। এখানেও ঠিক সেটাই হচ্ছে পরিস্থিতির চাপে। তবে এরা একটা টুর্নামেন্টে সফল হলেও ক্লাব ফুটবল খেলতে গেলে ধরা পড়ে যাবে। তখন শুরু হবে দুর্দিন।”

বিশ্বকাপে ৫০ ম্যাচে ১৪০ গোল দেখার পর কাম্পোসের বক্তব্য, ৩৯টা গোল হয়েছে কিপারের বেসিক ভুলে। তাঁর খেদ, “গত দশ বছর ধরে দেখছি বল গ্রিপ করার চেয়ে ফিস্ট করে বার করে দেওয়াকে নিরাপদ কাজ মনে করছে এখনকার সফল কিপাররা। অথচ রিবাউন্ড বা সেকেন্ড বল থেকে যে বিপদটা আসতে পারে তা বুঝছে না। এ বার যেমন এই ফ্যাক্টরে ভুগেছে কাসিয়াস-ও।”

তবে এই বক্তব্যে নানা মত কলকাতার কিপারদের। সুব্রত বলছেন, “বল অনেক সময় হাওয়ায় উল্টো-পাল্টা বাঁক নেয়। সে জন্যই ফিস্ট করতে হয়।” জাতীয় দলে বিদেশি কোচের সঙ্গে কাজ করা তনুময়ও বলছেন, “এরিয়াল বলে আগে কিপারকে স্পর্শ করলেই ফাউল হত। এখন অনেক রেফারি তা দিতে চান না। তাই বিদেশি কোচেরাও এটা পাখি পড়ার মতো শেখান কিপারদের, যে বল ফিস্ট করে দাও। ঝুঁকি নিয়ে গ্রিপ করতে যেও না।”

যদিও ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় একমত নন এর সঙ্গে। তার কথায়, “এখন তো দেখি সোজা বলও ফিস্ট করা হচ্ছে। যা দেখে অবাক লাগে। গোলকিপারের গ্রিপ প্লেসমেন্ট যদি ঠিক থাকে তা হলে বল তালুবন্দি করতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”

তাও কেন দুনিয়া জুড়ে কিপাররা ফিস্ট করছেন? ভাস্করের মতে, “আগে ৪-২-৪ বা ৩-২-৫ ছকে উইং প্লে বেশি হত। গোলকিপাররাও উইং থেকে বল বেশি আসায় গ্রিপ করতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু আজকের ৪-৪-২ বা ৪-৪-১-১ ছকে উইং প্লে-র চেয়ে মিডল করিডর বেশি ব্যবহার হওয়ায় কিপাররাও এরিয়াল বল আগের চেয়ে কম ধরছে। তাই গ্রিপিংয়ে মরচে ধরেছে। বেড়েছে চাপড় মেরে বল বিপন্মুক্ত করার কৌশল।”

মোদ্দা কথাটা বছর কয়েক আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেই ফেলেছিলেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে চেলসির গোলকিপার পের চেক। যা নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল ফুটবল দুনিয়ায়!

কী বলেছিলেন চেক? চেক প্রজাতন্ত্রের এই কিপার বলেছিলেন, “বেশ কিছু গোলকিপারের রিফ্লেক্স চোখ ভরে দেখার মতো। কিন্তু তাঁদের অনেকে ভুলও করেন প্রচুর। ওঁদের আগে শেখা দরকার বক্সে বল আসলে সঠিক পজিশনটা কোথায় হবে আর কখন গোল ছেড়ে বেরোতে হবে আর কখন নয়।”

ওচোয়ারা সেই কথার তোয়াক্কা না করে বিশ্বকাপে ঝলমলে হয়ে উঠলেও, ভবিষ্যতে এই ত্রুটিগুলো সারাতে না পারলে দ্রুতই নিষ্প্রভ হয়ে যাবেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ইনসেটে দুই গোলকিপারের বিচরণের ‘হিট ম্যাপ’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

fifaworldcup goalkeeping
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE