Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দেবজিতের দস্তানায় বাগানে তিন পয়েন্ট

ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতি ফিরে এল চল্লিশ বছর পর! আর এক মোহনবাগান কিপার দেবজিত্‌ মজুমদারের হাত দিয়ে। পঁচাত্তরে পাঁচ গোলের (তিনি অবশ্য চার গোল হজম করেছিলেন) লজ্জার অন্ধকার কাটিয়ে দেশের এক নম্বর কিপার হয়ে উঠতে ভাস্করের লেগেছিল পুরো একটা বছর। পরের মরসুমে বাগান ছেড়ে বেঙ্গলে গিয়ে নায়ক হয়ে উঠে! আর ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের থুতুর প্রতিশোধ নিতে দেবজিত্‌ সময় নিলেন প্রায় চার বছর।

নেতা, নায়ক ও নতমস্তক। বাগান কোচ সঞ্জয়। ডার্বির সেরা দেবজিত্‌। ব্যর্থ লাল-হলুদ কোচ এলকো। ছবি: উত্‌পল সরকার ও শঙ্কর নাগ দাস।

নেতা, নায়ক ও নতমস্তক। বাগান কোচ সঞ্জয়। ডার্বির সেরা দেবজিত্‌। ব্যর্থ লাল-হলুদ কোচ এলকো। ছবি: উত্‌পল সরকার ও শঙ্কর নাগ দাস।

রতন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৫ ০২:৫০
Share: Save:

মোহনবাগান-১ (বলবন্ত): ইস্টবেঙ্গল-০

ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতি ফিরে এল চল্লিশ বছর পর! আর এক মোহনবাগান কিপার দেবজিত্‌ মজুমদারের হাত দিয়ে।

পঁচাত্তরে পাঁচ গোলের (তিনি অবশ্য চার গোল হজম করেছিলেন) লজ্জার অন্ধকার কাটিয়ে দেশের এক নম্বর কিপার হয়ে উঠতে ভাস্করের লেগেছিল পুরো একটা বছর। পরের মরসুমে বাগান ছেড়ে বেঙ্গলে গিয়ে নায়ক হয়ে উঠে!

আর ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের থুতুর প্রতিশোধ নিতে দেবজিত্‌ সময় নিলেন প্রায় চার বছর। লাল-হলুদের পোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে চার গোল খেয়েছিলেন তিনিও। এরিয়ান ম্যাচে।

শনিবার ডার্বিতে সঞ্জয় সেনের টিমকে চার-চারবার অবিশ্বাস্য ভাবে বাঁচানো বাগান কিপার পুরো টিম নিয়ে উচ্ছ্বসিত সবুজ-মেরুন গ্যালারির দিকে দৌড়ে গেলেন ম্যাচের পর। যেতে যেতে অন্তত দু’বার ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির দিকে তাকালেন হিন্দমোটর বিধানপল্লির দেবজিত্‌। লাল-হলুদ গ্যালারিতে তখন হতাশা আর হতাশা। জেতা ম্যাচ হেরে যাওয়ার আফসোস।

“বহু দিন ধরে অভিমানটা পুষে রেখেছিলাম। তাই বাড়তি একটা জেদ নিয়েই নেমেছিলাম বলতে পারেন,” বলার সময় রাতারাতি অখ্যাত থেকে নায়ক হয়ে ওঠা দেবজিতের গলা বুজে আসে আনন্দ আর আবেগে। “হ্যাঁ, ওদের সমর্থকেরাই তো আমাকে থুতু দিয়েছিলেন সে দিন। সেই টিমকে হারিয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।”

দেবজিতের সেই অভিশপ্ত কলকাতা লিগ ম্যাচের পর দীর্ঘক্ষণ পুরো ইস্টবেঙ্গল টিমকে মাঠে আটকে রেখেছিলেন সমর্থকেরা। মাঠ থেকে বেরোনোর সময় সদস্য গ্যালারি থেকে থোকা থোকা থুতু উড়ে এসেছিল সে দিনের ‘কলঙ্কিত’ গোলকিপারের উদ্দেশ্যে।

আর এ দিন ইস্টবেঙ্গলের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার পর দেবজিতের জন্য উড়ে এসেছে মেরুন আবির, ফুলের মালা। জ্বলেছে সবুজ মশাল। তাঁর দুটো হাত ছুঁতে চেয়েছেন হাজার হাজার বাগান সমর্থক। সঙ্গে বর্ষিত হয়েছে লাল-হলুদের কেবল আফসোস। ইস্টবেঙ্গল কোচ স্বীকার করে নিয়েছেন, “বাগান কিপারের রিফ্লেক্সের কাছে হেরেছি। অন্য দিন হলে দু’চার গোল পেয়ে যেতাম।”

এলকো যেটা বলতে চেয়েছেন সেটা গোদা বাংলায়ঈশ্বর আজ ভর করেছিলেন বঙ্গসন্তান কিপারের উপর। না হলে কখনও পাখির মতো উড়ে গিয়ে, কখনও স্পাইডারম্যান হয়ে ডুডু-র‌্যান্টি-ডিকার নিশ্চিত গোলের শট বাঁচাতে পারতেন না দেবজিত্‌। বাগান কোচকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কে আপনাকে জেতালেন? বলবন্ত না দেবজিত্‌? স্পষ্টভাষী বঙ্গসন্তান কোচ বলেন, “অবশ্যই দেবজিত্‌। ও যা সেভ করেছে, অসাধারণ!” ডেম্পোর পর ডার্বিতেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ দেবজিত্‌। কত দূর যেতে পারেন এই কিপার? দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা কিপার ভাস্কর বলছিলেন, “মাথা ঘুরে না গেলে অনেক দূর যাবে। কিপারের সব গুণ ওর মধ্যে আছে। তবে গ্রিপিংটা আরও ভাল করতে হবে। আর একটা ম্যাচ জিতেই উচ্ছ্বসিত হওয়া ঠিক নয়। ও যেন মনে রাখে, কিপারের জীবন এক বলের। ক্রিকেটের ব্যাটসম্যানের মতো। একটা মিস করলেই শেষ।”

দেবজিতের দস্তানা অপরাজিত রেখে দিল সনি-বোয়াদের। টানা নয় ম্যাচে হার নেই। যুবভারতীর বাইরে স্লোগানও উঠে গিয়েছে, নয়ে নয়! ডুডু-র‌্যান্টি বুলডোজার রুখে দিয়ে লিগ শীর্ষেই রয়ে গেল সঞ্জয়ের টিম। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই বলবন্ত সিংহের চতুর গোলে ডার্বিতে এল পুরো তিন পয়েন্ট। তবু এখনই দলটাকে অশ্বমেধের ঘোড়া বলা যাচ্ছে না। বলা যায় বহু দিন পর চ্যাম্পিয়ন্স লাক কাজ করছে শতবর্ষপ্রাচীন ক্লাবের জন্য।

না হলে নিশ্চিত হারা ম্যাচ কেউ এ ভাবে জেতে! ম্যাচের স্কোরলাইনে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, হওয়া উচিত ছিল, ইস্টবেঙ্গল ৪ : মোহনবাগান ১। নব্বই মিনিটে গোলের তো একটা সুযোগই পেয়েছিল বাগান। ইতিহাস অবশ্য কখনও ব্যর্থদের ক্ষমা করেনি। সব সময় জয়ীদের নিয়েই গৌরবগাথা লিখেছে। ডুডু-র‌্যান্টিদের নিশ্চিত গোলের সুযোগ নষ্ট করাকে তাই ক্ষমা করা যাচ্ছে না। দেবজিত্‌, বলবন্তদের গৌরবের কথাই লিখতে হচ্ছে।

ম্যাচটা দেখে মনে হচ্ছিল, মাঠে নামার আগে দুই কোচই একে অপরের টিম নিয়ে অনেক কাটাছেঁড়া করেছেন। ফলে ম্যাচটা কখনওই তেমন উঁচু মানের হতে পারল না। ট্যাকটিক্সের জাঁতাকলে পড়ে চোখের আরাম দিতে পারলেন না কোটি টাকার ফুটবলাররা। বাগানের কাতসুমির পিছনে বেঙ্গলের লালরিন্দিকা, সনিকে আটকাতে চোরাগোপ্তা মার, উল্টো দিকে র‌্যান্টি-ডুডুর জন্য জোড়া মার্কিং, মাঝমাঠে পায়ের জঙ্গল--- বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে থাকা নব্বই বছরের কলকাতা ডার্বির সব রং শুষে নেয় এ দিন। তাতে পঞ্চাশ হাজার ফুটবলপাগল উদ্বেল হননি তাও অবশ্য নয়। বলবন্তের গোলের সময় বাগান গ্যালারিতে বাজি ফেটেছে, উড়েছে আবির। দেবজিতের ‘পাখি হওয়া’ দেখে হাততালির ঝড় উঠেছে ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতেও!

সঞ্জয়ের দল জিতলেও তার কোচের টিম কম্বিনেশন দেখে মনে হয়নি তিনি জিততে চান। এক পয়েন্ট পেলেও হয়তো অখুশি হতেন না তিনি। তবে তাঁকে একটা ব্যাপারে কৃতিত্ব দিতেই হবে যে রক্ষণ নিয়ে বাগান এ দিন মাঠে নেমেছিল সেটা আগে কখনও নামেনি। কিংশুক-বেলো-আনোয়ার-সুখেন, মরসুমে প্রথমবার এক সঙ্গে নামলেন। তাও ডার্বিতে। কিন্তু তাতেও মোটামুটি হিট!

ডার্বি জিতলেও বাগান কি শেষমেশ আই লিগ পাবে? শীর্ষে থাকা সনি-কাতসুমিদের সামনে কিন্তু আরও কঠিন লড়াই। বেঙ্গালুরু ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। দৌড়ে রয়েছে করিমের পুণেও। এদের সঙ্গে খেলতে হবে। বাকি এগারো ম্যাচের ছ’টা বাইরের মাঠে।

ডার্বির ধারাভাষ্য দিতে এসেছিলেন সুভাষ ভৌমিক। বোয়াদের এ মরসুমেরই প্রাক্তন কোচের হয়তো আফসোস হচ্ছিল, তাঁর চারা লাগানো বাগানের গাছেই ফুল ফোটাচ্ছেন সঞ্জয়। টিমটার আটানব্বই শতাংশ ফুটবলারই তো সুভাষের বাছা। দুর্দান্ত কাজ করে চলা ট্রেনার গার্সিয়াও তাঁরই আমদানি।

ডার্বির আগেই অবশ্য সুভাষ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, এ বার ট্রফি হয় মোহনবাগান, নয়তো বেঙ্গালুরুর। শনিবারের ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গল হারে না, সেই মিথও এ দিন ভাঙার পর চেতলার সঞ্জয় যদি শেষ পর্যন্ত লিগ জেতেন তা হলে বঙ্গসন্তান কোচের রমরমা ফিরবে। সুভাষ-সুব্রত-মনোরঞ্জনের পর বাঙালি কোচেদের জাতীয় লিগে যে আর সাফল্যই নেই!

মোহনবাগান: দেবজিত্‌, কিংশুক, আনোয়ার, বেলো, সুখেন, সনি, ডেনসন, শৌভিক (বিক্রমজিত্‌), কাতসুমি, বলবন্ত (জেজে), বোয়া।

ইস্টবেঙ্গল: শুভাশিস, খাবরা, অর্ণব, সুসাক (রাজু), রবার্ট, রফিক, লালরিন্দিকা (লোবো), মেহতাব, তুলুঙ্গা (বলজিত্‌), ডুডু, র‌্যান্টি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE