Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

পাহাড়চুড়োর ডাকে লোক নেই সস্তা ক্লাবের, আছে শুধুই খরচ

শীতকালীন পিকনিক আর পিঠে-পার্বণের চেনা ছন্দ থেকে বেশ আলাদা ওঁদের শীত। পুজো কাটতেই হাওয়ায় শিরশিরে ভাব এল কি এল না, হাত পা যেন সুড়সুড় করে ওঠে। জুতো, ব্যাগ ঝেড়েঝুড়ে নামিয়ে টুক করে বেরিয়ে পড়া। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার সবুজ পাহাড়গুলোর ডাকে ওদের কোলের কাছে ক’দিন থেকে আসা। তা-ও আবার একা নয়, দলবল বেঁধে। ছেলে-বুড়ো মিলিয়ে সে এক হইহই যাত্রা। যাত্রার পোশাকি নাম ‘রক ক্লাইম্বিং কোর্স’। লিখছেন তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৫ ১৯:২১
Share: Save:

শীতকালীন পিকনিক আর পিঠে-পার্বণের চেনা ছন্দ থেকে বেশ আলাদা ওঁদের শীত। পুজো কাটতেই হাওয়ায় শিরশিরে ভাব এল কি এল না, হাত পা যেন সুড়সুড় করে ওঠে। জুতো, ব্যাগ ঝেড়েঝুড়ে নামিয়ে টুক করে বেরিয়ে পড়া। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার সবুজ পাহাড়গুলোর ডাকে ওদের কোলের কাছে ক’দিন থেকে আসা। তা-ও আবার একা নয়, দলবল বেঁধে। ছেলে-বুড়ো মিলিয়ে সে এক হইহই যাত্রা। যাত্রার পোশাকি নাম ‘রক ক্লাইম্বিং কোর্স’।

বাঙালির ভ্রমণপ্রিয় তকমাটাও সরাসরি দেওয়া যায় না এঁদের। কারণ, ভ্রমণটা ঠিক চেনা ছন্দে হয় না যে। লটবহর নিয়ে স্টেশনে পৌঁছে কুলি ডাকাডাকিতে অভ্যস্ত নন এঁরা। পিঠে ছিমছাম রুকস্যাক চাপিয়ে ট্রেনে উঠে পড়েন। রুকস্যাকে নতুন স্টাইলের জামাকাপড়ের ভিড় নেই। বদলে আছে কয়েক গাছা দড়ি, হয়তো একটা ছুরি, টুপি, জুতো, হয়তো বা একটা ক্যামেরা। ঠান্ডা রোখার রংবাহারি সোয়েটার-কম্বল নেই, আছে গাবদা স্লিপিং ব্যাগ। এই রুকস্যাক-জনতার ভিড়টা বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ওড়িশা ইত্যাদি রুটের ট্রেনগুলোয় দিব্যি চোখে পড়ে শীতের সময়ে।

দু’-চার দিনের এই প্রকৃতি পাঠের আসরের আয়োজন করে পর্বতারোহণ ক্লাবগুলো। রক ক্লাইম্বিং, র‌্যাপেলিং, রিভার ক্রসিংয়ের সঙ্গে শেখানো হয় ক্যাম্পিংয়ের মজাও। কনকনে শীতের ভোরে স্লিপিং ব্যাগের আলিস্যি ছেড়ে বেরিয়ে দৌড়ঝাঁপ করে গা ঘামানো। ফিরে জলখাবার খেয়েই জামা-প্যান্ট-জুতো-টুপি পরে, দড়িদড়া নিয়ে পাহাড়ের চড়াই ভাঙা। কখনও পাহাড়ি খাঁজগুলো খুঁজে পেতে আঁকড়ে ক্লাইম্বিং, কখনও বা দড়ির সাহায্যে সড়সড়িয়ে র‌্যাপলিং করে নেমে আসা। সেই সঙ্গেই আবার দড়িতে ঝুলে পাহাড়ের এক মাথা থেকে আর এক মাথায় রিভার ক্রসিং। দুপুরে হা-ক্লান্ত হয়ে নেমে এসে ফাঁকি, ঝিমুনি আর থিওরি ক্লাসের মধ্যে বিকেল পেরিয়ে সন্ধে গড়াতেই খেয়ে দেয়ে তাঁবুর ভিতরে।

কয়েকশো কিলোমিটার দূরের চেনা শহুরে জীবন যখন শীতের সন্ধের উন্মাদনায় সবে গা ভাসাতে শুরু করছে, তত ক্ষণে স্লিপিং ব্যাগের ঘুমের আদর গায়ে জড়িয়ে নিয়েছেন প্রকৃতি পাঠের পড়ুয়ারা।

চার দিনের রক ক্লাইম্বিং কোর্স তো হল, তবে এতেই কিন্তু ছুটি মেলে না ক্লাবগুলোর।

বসন্তের গোড়া থেকেই ফের শুরু ক্লাইম্বিং মরসুম! এ বার আর পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার ছোট সবুজ পাহাড় নয়, ডাক পাঠায় বরফ চাদরে মোড়া আকাশছোঁয়া হিমালয়। ডাক পাঠায় হিমালয়ের কঠিন থেকে কঠিনতম শৃঙ্গের বিপদসঙ্কুল চড়াই-উতরাইগুলো। চ্যালেঞ্জ জানায় তুষারঝড়ের দিনরাত্রি। অভিযানের নেশায় ঘর ছাড়েন কিছু আরোহী। ফের ফিরবেন কি না তা না জেনেই।

আর এই অভিযানের প্রস্তুতিতে ঘাম ছোটে আয়োজক ক্লাবগুলোর। সদস্যদের দক্ষতা বুঝে শৃঙ্গ খুঁজে বার করা, গাড়িচালক থেকে শুরু করে শেরপা-গাইড সকলের সঙ্গে দরাদরি করে খরচ কমানোর প্রবল চেষ্টা, আর টাকার জোগাড়ের চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে যাওয়া। এভারেস্ট-কাঞ্চনজঙ্ঘা-লোত্‌সের মতো বড় শৃঙ্গ অভিযানের ভিড়ে ছোট শৃঙ্গের জন্য স্পনসরদের দোরে ঘোরাটাও খুব একটা আশাপ্রদ হয় না। ফলে ক্লাবের ক্ষুদ্র ফান্ড আর সদস্যদের পকেটই সম্বল। তাই দক্ষতা আর ইচ্ছা থাকলেও, টাকার অভাবে অনেকেই গিয়ে উঠতে পারেন না অভিযানে। কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জিনিসপত্রের পাহাড় গোছানোয় হাত লাগান সবাই মিলেই। বলা ভাল, মূল অভিযানে বেরোনোর আগেই একটা আস্ত প্রস্তুতি অভিযান সেরে ফেলেন ক্লাব-কর্তারা, থুড়ি, ক্লাব-কর্মীরা।

এ অবশ্য স্বল্প বাজেটের গরিব ক্লাবগুলোর বছরনামচা। পর্বতারোহণ আয়োজক এজেন্সির কল্যাণে আর তত কঠিন নয় প্রস্তুতি পর্ব। নিজের জিনিসপত্রটুকু নিয়ে তাদের দুয়োরে পৌঁছলেই হল। তারাই ব্যবস্থা করে দেবে যন্ত্রপাতি, তাঁবু, জুতো, খাবার, স্লিপিং ব্যাগ সব কিছুর। তার বদলে অবশ্যই চাই পকেটের জোর। সবাই মিলে ভাল-মন্দ বুঝে প্রস্তুতির মজাটাও অবশ্য একেবারেই মেলে না ওই ধরনের ‘রেডিমেড’ অভিযানে।

তবে রক ক্লাইম্বিং কোর্স করার পর বড় মাপের অভিযানে উত্‌সাহী হন ক’জন? ক’জন বড় মাপের অভিযাত্রী তৈরি হন এই ক্লাবগুলির মাধ্যমে? ক’জনই বা পাকাপাকি ভাবে ক্লাবের সদস্য হয়ে ওঠেন?

ভারতের অন্যতম ছাত্র-পরিচালিত ক্লাব হিসেবে ১৯৫৬ সাল থেকে প্রতি বছর পর্বত অভিযানের আয়োজন করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মাউন্টেনিয়ারিং ও হাইকিং ক্লাব। ছাত্র-পরিচালিত এই ক্লাবটির বার্ষিক ফান্ড মোটে ৩৫ হাজার টাকা। তবু প্রত্যেক বছর দেড়-দু’লাখ টাকা খরচ করে বড় অভিযানের আয়োজন করে তারা। ক্লাবের বর্তমান সম্পাদক সৃজন সাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তিনি জানালেন, রক ক্লাইম্বিং কোর্সের জন্য অনেকে উত্‌সাহী হলেও বড় মাপের অভিযানের সদস্য সংখ্যা কমই। প্রতি বছর হয়তো দু’জন, বড় জোর তিন জন বড় অভিযানে নাম লেখান। আর ছাত্র পরবর্তী সময়ে অভিযান চালিয়ে যাওয়া সদস্যের সংখ্যাও হাতে-গোনা। এর কারণ হিসেবে সৃজন বললেন, “ছাত্রদের পকেট-মানিটুকুই ভরসা। বড় অভিযানের জন্য কিছুটা টাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া গেলেও, তার পর বেশির ভাগটাই ছাত্রদের নিজেদের জোগাড় করতে হয়। ফলে ইচ্ছে থাকলেও অনেক অভিযান করা হয়ে ওঠে না তাঁদের।”

তবে শুধু অভিযানই নয়, লোক মেলে না ক্লাবের অন্য কাজকর্মে হাত লাগানোর জন্যও। সেই গুটি কতক মুখই থেকে যায় বছরের পর বছর। অভিযানের জিনিসপত্র গুছিয়ে বস্তায় ভরা থেকে শুরু করে পাহাড়ে গিয়ে ছোটদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, মায় ক্লাব তহবিলে জমা-খরচের হিসেব মেলানো পর্যন্ত সবই একা হাতে সামলান তাঁরা।

প্রায় তিরিশ বছর ধরে পাহাড়ের নেশায় ডুবে বারাসতের সুনীতা হাজরা। ১৯৮৭ সালে বসিরহাটের ট্র্যাভেলার্স গিল্ড-এর সঙ্গে রক ক্লাইম্বিং কোর্সে গিয়েই ভাল লেগে যায়। পর পর দু’তিন বছর এ রকম কোর্স, ছোট ট্রেকিং করতে করতেই বুঝেছিলেন, পাহাড়ে যাওয়ার জন্য সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন টাকার। তাই মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েই নার্সিং ট্রেনিং নিতে শুরু করেন। নয়ের দশকের গোড়ার দিকে সেই সময়ে কাগজে পড়তেন অসামরিক বাঙালি দলের প্রথম এভারেস্ট অভিযানের কথা। আরও উঁচু পাহাড়চুড়ো ছোঁয়ার স্বপ্ন বোনা হয়ে গিয়েছিল তখনই।

রতবন, ভাগিরথী-২, পাপসুরার মতো একাধিক ছ’হাজারি শৃঙ্গে পা রাখার পর ২০০৫ সালে মা হন সুনীতা। দীর্ঘ সাত বছরের বিরতির পর ২০১২ সালে সুযোগ মেলে রাজ্য সরকারের যুবকল্যাণ দফতরের ৬৫৯৩ মিটার উচ্চতার মনিরাং শৃঙ্গ অভিযানে সহ-দলনেত্রী হিসেবে যোগ দেওয়ার। তখন সুনীতা চল্লিশ ছুঁয়ে ফেলেছেন। পর্বতারোহী হিসেবে বয়সটা বড় কম ছিল না। বয়সের বাধা উড়িয়ে অভিযানে সফল হন তিনি।

একাধিক ছ’হাজারি শৃঙ্গে পা রেখেও ছোটখাটো বিভিন্ন ক্লাবের রক ক্লাইম্বিং কোর্সের প্রশিক্ষক হিসেবে এখনও যান পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার পাহাড়ে। এভারেস্টে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন ঠিকই, কিন্তু কখনওই ভোলেন না নিজের শিকড়কে।

কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে পর্বতারোহণের জগতে থাকা চন্দননগরের সম্রাট বসুর ঝুলিতে একাধিক ছ-সাত হাজারি শৃঙ্গের পালক থাকলেও, নানা অনুষ্ঠানে ফিতে কাটা আর মঞ্চে উঠে সংবর্ধনা নেওয়ার ভিড়ে তাঁকে দেখে না আরোহী-মহল। ২০০৪ সালে ছুঁয়ে ফেলেন সাত হাজারি শৃঙ্গ কামেট। তার পর শতপন্থ, মেন্থসা, দেওবনের মতো একাধিক সুউচ্চ শৃঙ্গ। পাশাপাশিই চলতে থাকে ছোট ছোট বাচ্চাদের পর্বতারোহণে হাতেখড়ি দেওয়ানোর কাজ। এভারেস্টের স্বপ্ন যে একেবারেই দেখেন না তা নয়, কিন্তু পাশাপাশি এটাও বিশ্বাস করেন, চলতি পথে এভারেস্ট অভিযান আরোহণ জীবনের একটা মাইলস্টোন হয়ে উঠবে শুধু। প্রকৃত অভিযানের চ্যালেঞ্জ হয়তো কিছুটা হলেও ফিকে হবে।

ছবি: লেখক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE