Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ফিয়েরের জয়োৎসবে আজ থাকতে পারেন আগের তিন বারের কাপ জয়ীরা

ব্যান্ডেনবুর্গ গেট-এর যেখানে কাল রাতে দশ লক্ষেরও বেশি জার্মান জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখেছিল, সেখানেই তৈরি হচ্ছে লাম-গোটজেদের বরণ-মঞ্চ। মঙ্গলবার ভারতীয় সময় দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ জাম্বো জেটটা যখন বার্লিনে নামবে তখন কী হবে ভাবছি! রবিবার সারা রাত যা দেখলাম! জার্মানিতে জন্মের পর সাঁইত্রিশ বছর এ দেশে আছি। কখনও শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং নীতিনিষ্ঠ জার্মানিকে এ রকম উচ্ছাসে উদ্বেল হতে দেখিনি।

উচ্ছ্বল বার্লিন। ছবি: এএফপি

উচ্ছ্বল বার্লিন। ছবি: এএফপি

অরুণাভ চৌধুরী
কোলন শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৪ ০৩:০১
Share: Save:

ব্যান্ডেনবুর্গ গেট-এর যেখানে কাল রাতে দশ লক্ষেরও বেশি জার্মান জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখেছিল, সেখানেই তৈরি হচ্ছে লাম-গোটজেদের বরণ-মঞ্চ। মঙ্গলবার ভারতীয় সময় দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ জাম্বো জেটটা যখন বার্লিনে নামবে তখন কী হবে ভাবছি! রবিবার সারা রাত যা দেখলাম!

জার্মানিতে জন্মের পর সাঁইত্রিশ বছর এ দেশে আছি। কখনও শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং নীতিনিষ্ঠ জার্মানিকে এ রকম উচ্ছাসে উদ্বেল হতে দেখিনি। সারাক্ষণ টেনশনে কাটিয়ে গ্লাসের পর গ্লাস বিয়ারে ডুবে থাকলেও আমাদের এখানকার সকলের ধারণা ছিল চ্যাম্পিয়ন হবে জার্মানি-ই। আর সেটা সেটা হল কিনা আমাদের মেসি গোটজের গোলে অতিরিক্ত সময়ে। তারপরে তো পুরো জার্মানিই মনে হল রাস্তায় নেমে এসেছে। ফাইনাল যখন শেষ হয়েছে তখন এখানে রাত বারোটা। ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল। যদিও আমার শহরে কিছু হয়নি। অন্যত্র কোথাও কোথাও হয়েছে।

তাতে কী? সারা রাতই তো জেগেছিল জার্মানি! কে নেই সেই দলে আট থেকে আশি সবাই। স্কুল ছাত্র থেকে তার মা, দাদুর সঙ্গে নাতি সবাই রাস্তায়! চব্বিশ বছর পরের কাপ জয় সবাইকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। এ রকম দৃশ্য তো কলকাতার দুর্গাপুজোর সময় ঠাকুর দেখতে গিয়ে দেখেছি। বিয়ার পাবে গিয়ে কত পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। পার্ক, পাব, নদীর ধার কোথায় মানুষ না আনন্দ করছে! সবার মুখেই ফিয়ের চার নম্বর কাপ জয়ের স্লোগান।

জার্মানরা ছুটিতে বিশ্বাস করে না। আমাদের দেশের চ্যান্সেলর বিশ্বকাপ জয়ের অনুষ্ঠানে থাকলেও ছুটি ঘোষিত হয়নি এখানে। তবে বিভিন্ন অফিসে কেউ কেউ দেরি করে এলেও বসের বকা খায়নি। কারণ বস-ও তো হয়তো জীবনে প্রথম বার নির্দিষ্ট সময়ের পরে এসেছেন। তবে শুনলাম অফিসে হাজিরার সংখ্যা কম। হবেই তো।

জার্মান দেশে এই উলটপুরাণ কেমন ছিল বোঝাতে দু’টো উদাহরণ দিচ্ছি। এক) জার্মানির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দর্শক রবিবার রাতে বসেছিল টিভির সামনে। সংখ্যাটা দিয়েছে আমাদের জাতীয় টিভিফার্স্ট চ্যানেল। দুই) আর শুনলাম জার্মানির ইতিহাসে নাকি কোনও রাতে এত বিয়ার বিক্রি হয়নি। বুন্দেশলিগায় বরুসিয়া ডর্টমুন্ড আর শালকের মধ্যে সম্পর্ক ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো। গোল করে কাপ এনে দেওয়া গোটজে আগে খেলত ডর্টমুন্ডে। সেখান থেকে এ বার গিয়েছে বায়ার্ন মিউনিখে। এই অ্যাটাকিং মিডিওর উপর কিন্তু কোনও রাগ নেই শালকের সমর্থকদের। দেখলাম তারাও স্লোগান দিচ্ছে গোটজের নামে।

তবে ক্র্যামারের চোট পাওয়াটা সবাইকে দুঃখ দিয়েছে। ছেলেটা আমার বাড়ির কাছেই থাকে। এক বছর আগে ও যখন ছোট দল বরুসিয়া মুনসেনগ্ল্যাডবাখের হয়ে বুন্দেশলিগায় খেলত তখন ওকে ইন্টারভিউতে প্রশ্ন করেছিলাম, তুমি বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন দেখো? ও মাথা নিচু করে লাজুক লাজুক মুখ করে বলেছিল, “স্বপ্ন তো দেখিই। কিন্তু তা সফল হবে কি না জানি না।” কাল যখন ওয়ার্ম আপে চোট পাওয়া খেদিরার জায়গায় শুরুতেই নামল ক্র্যামার, তখন কী উল্লাস এখানে। কিন্তু ওকে মেরে মেরে শেষ করে দিল আর্জেন্তিনা। ও যখন বাইরে চলে যাচ্ছিল তখন জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখতে আমার পাশে বসা দু’জন মেয়ের চোখে দেখলাম জল! তবে তারা সেই জল মুছে ফেলেছে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে। আরে, আমরা তো নিশ্চিত ছিলামই চ্যাম্পিয়ন হবে জার্মানি। এতটাই যে, সরকার ফাইনালের আগেই পঞ্চাশ লাখ সেলিব্রেশন ডাকটিকিট ছাপিয়ে রেখেছিল।

জার্মান ফুটবল ফেডারেশনে খোঁজ নিয়ে জানলাম, গতকাল রিওতে সারারাত পার্টি করেছেন লাম-মুলাররা। আমাদের সরকার এবং ফেডারেশনের সব লোকজনও ছিলেন টিম হোটেলে। একটা জাম্বো জেটে করে চ্যাম্পিয়নরা আসবে বার্লিনে। হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সবাই যাবে সংবর্ধনা মঞ্চে। সেখানেই দেশবাসীর উদ্দেশ্যে কাপ প্রদর্শন হবে। ফুটবলাররা ছবি তুলবেন ফ্যানদের সঙ্গে। ১৯৫৪, ’৭৪, ’৯০-এর পর ২০১৪। শুনলাম এই অনুষ্ঠানে ডাকা হবে আগের তিন বারের বিশ্বজয়ী ফুটবলারদের। বেকেনবাউয়ার, লোথার ম্যাথেউস, পল ব্রাইটনার, ক্লিন্সম্যান সবার থাকার কথা। ’৫৪-র কাপ জয়ী দলের দু’জন ফুটবলার বেঁচে আছেন। তাদের আনার চেষ্টা হচ্ছে। বাসে করে টমাস মুলার, সোয়াইনস্টাইগারদের শহর ঘোরানো হবে কি না তা অবশ্য এখনও ঠিক হয়নি। মার্সিডিজ কোম্পানি আমাদের জাতীয় দলের স্পনসর। তারাই বাস দেবে বলে শুনছি। কিন্তু আবহাওয়া এত খারাপ, শেষ পর্যন্ত মনে হয় ভিকট্রি র্যালি দেখা যাবে না।

বাসে করে ঘোরানো হোক বা না হোক, জার্মানিতে ২০০৬ থেকে ’৫৪, ’৭৪, ’৯০ কাপ জয় নিয়ে যে সব গান প্রতিদিন বাজত তা অন্তত এ বার বদলাবে। বন্ধ হবে। লেখা হবে নতুন গান। আমরা যে ফোর স্টার পেয়ে গিয়েছি। দোকানগুলোতে চব্বিশ বছর ধরে থ্রি স্টার জার্সি বিক্রি হয়ে চলেছে। সেটাও বদলাবে। আমরা যে এখন চার বারের বিশ্বচ্যাম্পিনফিয়ের। ফিয়ের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE