Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বৃষ্টির লঙ্কায় পড়ে থাকল কিশোর, উইকেট আর লোকেশ রাহুলের পা

‘মেরে সপ্নো কি রানি কব আয়েগি তু...!’ সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের দুপুরে হঠাৎ কিশোরকুমার কেন? মোহিনী গলায় সেটা গাইছেনই বা কে? কমেন্ট্রি বক্স থেকে ওটা আসছে যখন, নির্ঘাৎ সঞ্জয় মঞ্জরেকর গাইছেন।

শুক্রবার কলম্বোর এসএসসি যেমন। পা পিছলে পড়লেন কোহলি।

শুক্রবার কলম্বোর এসএসসি যেমন। পা পিছলে পড়লেন কোহলি।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
কলম্বো শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৫ ০৩:০৮
Share: Save:

‘মেরে সপ্নো কি রানি কব আয়েগি তু...!’

সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের দুপুরে হঠাৎ কিশোরকুমার কেন? মোহিনী গলায় সেটা গাইছেনই বা কে?

কমেন্ট্রি বক্স থেকে ওটা আসছে যখন, নির্ঘাৎ সঞ্জয় মঞ্জরেকর গাইছেন। বাংলা সিনেমার প্লেব্যাকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরীক্ষায় যখন লেটার মার্কস নিয়ে সসম্মানে উত্তীর্ণ, কিশোরে তখন আর কত অসুবিধে হবে? ঠিকই। একটা শেষ। দ্বিতীয়টা শুরু। শেষে পরপর। তবে আর গলায় নয়, মোবাইলে। মঞ্জরেকরও আর নন। দেখাদেখি এ বার শুরু করেছেন আর এক ধারাভাষ্যকার।

কী আর করবেন? হাতে তো কাজই নেই। মাইক ধরতে হচ্ছে না। কমেন্ট্রি করতে হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে একটু শো-এ বসো আর টুকটাক আপডেট, ব্যস।

সৈয়দ সাবা করিম অভিভূত। দিন দুয়েক আগে কলম্বোর একটা অনাথ আশ্রমে ঘুরে এসেছেন। সার্কিটের বন্ধুদের সবিস্তারে শোনাচ্ছেন সব। পাশে দাঁড়িয়ে আর এক জাতীয় নির্বাচক বিক্রম রাঠৌর। একটু দূরে আর একটা ব্যাপার নিয়ে আলোচনা চলছে। দক্ষিণ আফ্রিকা ‘এ’-র বিরুদ্ধে অক্ষর পটেলের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। বলাবলি চলছে, সামনেই দক্ষিণ আফ্রিকা আসছে। বাঁ হাতি স্পিনার তা হলে কে থাকবে টিমে? অক্ষর না কি ওঝা?

কী আর করবেন? এঁদেরও হাতে কোনও কাজ নেই। ম্যাচ দেখতে হচ্ছে না। নোট নিতে হচ্ছে না। কারণ ম্যাচটাই আর হচ্ছে না।

মোটে পনেরো ওভার হয়েই বৃষ্টির প্রকোপে ওটা দিনের মতো পাট চুকিয়েছে।

অদৃষ্টকে দোষ দেওয়া যেতে পারে। ক্রিকেট-দেবতার পরিহাসে আঘাত পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাস্তব এটাই যে, লঙ্কার লর্ডসে শিরশিরানি ধরানো এক যুদ্ধকে প্রথম দিনের মতো ধ্বংস করে দিয়ে গেল ভারত মহাসাগরের মেঘ। সিরিজ নির্ণয়ের যে যুদ্ধের কার্টেন-রেজার হল কলকাতা বোর্ড বৈঠকের উত্তেজনা দিয়ে। যেখানে প্রথম দশ ওভারের মধ্যে গেল দু’টো, খোঁচা উঠল আরও গোটা দুয়েক। যা প্রতি মুহূর্তে ইঙ্গিত দিচ্ছিল রক্তক্ষয়ী এক টেস্ট সংগ্রামের, তার পরিশেষে কি না ফুটনোটের মতো পড়ে থাকল কিশোরকুমার, উইকেট, আর কেএল রাহুলের পা!

সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের প্রবীণ সদস্যদের কাছে লর্ডস ছাড়াও এ মাঠের আরও একটা আদরের নাম আছে। ইয়র্কশায়ার অব লঙ্কা। আভিজাত্য আর প্রাচীনত্বে তুলনাহীন বলে। এবং লঙ্কার ইয়র্কশায়ারের বাইশ গজে ভারতের প্রাথমিক অবস্থা দেখে সত্যিকারের ইয়র্কশায়ারকে মনে পড়ে গেলে দোষ দেওয়া যেত না। ওই পনেরো ওভারের ছিটেফোঁটাতেই মনে হচ্ছিল, এশিয়া কোথায়? কোহলিদের ব্রিটিশদের মাঠে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বল নড়ছে। ব্যাটসম্যান নড়ছেন। খোঁচা উঠছে। নার্ভ হারিয়ে রান আউটের সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। ভারতের ভাগ্য ভাল যে, প্রতিপক্ষ দু’টো নিলেও সমান ভ্রান্তিতে ভুগেছে। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা অধিনায়ক। দীনেশ চন্ডীমল ব্যাটিং অর্ডারে এ বার কত নম্বরে নামবেন, এখন সেটা আগ্রহের বিষয়। উপরে উঠলে অধিনায়ক ম্যাথেউজ তবু বাঁচলেও বাঁচতে পারেন। কারণ চন্ডীমলকে সরিয়ে যাঁর হাতে কিপিংয়ের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন লঙ্কা অধিনায়ক, সেই কুশল পেরেরার টেস্ট অভিজ্ঞতার বয়স শূন্য। এটাই প্রথম। আর টেস্ট অভিষেকে সর্বপ্রথম যে লোপ্পাটা তিনি ছাড়লেন, তার জন্য ভুগতে হলে অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলোর ম্যাচ ফির অর্ধেক শ্রীলঙ্কা বোর্ড কেটে নিলে কিছু বলার থাকবে না। কারণ ক্যাচটা বিরাট কোহলির!

ঠিক তেমনই কেএল রাহুলেরও কিছুটা গেলে বলার থাকবে না। এক বার ভুল করলে ক্ষমা প্রাপ্য হয়। কিন্তু একই ভুল বারবার করলে কাঠগড়ায় উঠতে হয়। বিকেলে টিম ইন্ডিয়ার বাস মাঠ ছেড়ে যাওয়ার সময় রাহুলকে দেখা গেল বাসে নিষ্প্রাণ মুখচোখ নিয়ে উঠছেন। কিন্তু তাতে চিঁড়ে তো ভিজছে না। বরং দু’টো বলেই কর্নাটকী ব্যাটসম্যান বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত) হয়ে গিয়েছেন। সাংবাদিক সম্মেলন করতে এসে ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গারকে একপ্রস্ত শুনতে হল। সঞ্জয় বলে গেলেন, দেশে কোকাবুরা বলে খেলতে হয় না বলে সুইং ম্যানেজ করতে সমস্যা হচ্ছে ভারতীয় ওপেনারের।

যে ব্যাখ্যা রাহুলের ফুটওর্য়াকের মতোই অবাক করা। দেশে যে বলেই খেলা হোক, ঘরোয়া ক্রিকেট তো বোর্ডের নির্দেশিকায় এখন হয় সবুজ পিচে। সেখানেও প্রথম দিনের প্রথম দু’ঘণ্টায় বল সুইং করে। তা হলে? কোনও সন্দেহ নেই যে, সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের বাইশ গজ ব্যাটসম্যানের কাছে সহজপাচ্য নয়। রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে নিষ্ক্রিয় করতে যে পিচ শেষ পর্যন্ত দিয়েছেন কিউরেটর, তা আদতে দাঁড়িয়েছে অনিশ্চয়তার। অন্তত এ দিনের এক ঘণ্টায় পিচের আচার-ব্যবহার দেখলে তাই মনে হবে। ঘাস আছে, কিন্তু কয়েকটা জায়গায়। যেখানে আছে, বল পড়লে ভাল রকম মুভ করছে। কোহলির মতো দুঁদে ব্যাটসম্যানকেও স্তম্ভিত করে ছাড়ছে। যেখানে নেই, সেখানে পড়লে কিপারে ব্যাটের কানা নিয়েও ফার্স্ট স্লিপের কাছে পৌঁছচ্ছে না।

অতএব, ম্যাচ এগোলে পিচ কোন মূর্তি ধরবে, আন্দাজ করা এখনই অসম্ভব।

কিন্তু লোকেশ রাহুল সেই অজুহাতটা ব্যবহার করতে পারবেন না। অজিঙ্ক রাহানেও এলবিডব্লিউ হয়েছেন। কিন্তু তাঁর, লোকেশেরটা চরম দৃষ্টিকটু। কর্নাটকী তো জানতেন যে, তাঁর দুর্বলতা কোথায় প্রতিপক্ষ জানে। পি সারার দ্বিতীয় ইনিংসে যে ভাবে বোল্ড হয়েছেন, তাতে দুধের শিশুও বুঝবে যে ভিতরে আসা ডেলিভারিতে তাঁর সমস্যা আছে। শুধু লোকেশ সেটা বুঝলেন না। পি সারার মতো এসএসসিতেও আবার ধামিকা প্রসাদ। লোকেশ সামনে এলেন না, পিছনে গেলেন না, পা নিশ্চল হয়ে থাকল এবং মাঝামাঝি থেকে জাজমেন্ট দিয়ে দেখলেন প্রসাদের ডেলিভারিটা অফস্টাম্পের বাইরে পিচ পড়ে অনেকটা গোঁত্তা খেয়ে তাঁর স্টাম্প উড়িয়ে দিয়েছে।

তবু এখনও কিছুই হয়নি। কারণ ম্যাচটাই হয়নি। গোটাটাই পড়ে। এখনও কোহলি আছেন। আট মাস পরে অনভ্যস্ত ব্যাটিং অর্ডারে নামা চেতেশ্বর পূজারাকেও খুব খারাপ দেখাচ্ছে না। এঁরা টেনে দিলে, ভারতের অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। আর যন্ত্রণাটাও তো নতুন নয়। সিরিজে ৫০-২ এখন ভারতের নিয়ম। সিরিজে এখনও পর্যন্ত তিনটে কম্বিনেশন নামিয়েও তো ভারত ওপেনিংয়ে পঁয়ত্রিশ পার করতে পারেনি।

টেনশন বরং অন্য জায়গায়। স্থানীয়দের থেকে খোঁজখবর নিয়ে কেউ কেউ বলছিলেন, কলম্বোর ধর্মই এটা। পূর্ণিমা যত কাছে আসে, তত এ রকম দুমদাম ভয়াবহ বৃষ্টিতে সব অচল করে দিয়ে যায়। এবং তার শেষেও পুরো প্রভাবটা নাকি যায় না। অগস্টের শেষ সপ্তাহে নাকি অতীতের প্রচুর টেস্টের ভাগ্য ভারত মহাসাগরে তলিয়ে গিয়েছে। আশঙ্কা সত্যি হলে, বাইশ বছর বাদে লঙ্কারাজ্য থেকে কোহলির ভারতের সিরিজ তুলে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নও যে একই সঙ্গে তলিয়ে যাবে না, কে বলতে পারে।

আর আজ, শনিবারই কলম্বোয় পূর্ণিমা!

ভারত

প্রথম ইনিংস ৫০-২

লোকেশ বো প্রসাদ ২

পূজারা ন.আ. ১৯

রাহানে এলবিডব্লিউ প্রদীপ ৮

কোহলি ন.আ. ১৪

অতিরিক্ত

মোট ৫০-২।

পতন: ২, ১৪।

বোলিং: প্রসাদ ৪-০-১৬-১, প্রদীপ ৬-০-১৬-১,

ম্যাথেউজ ৪-২-৭-০, হেরাথ ১-০-৬-০।

ছবি: এএফপি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sri Lanka rain-hit day Cricket virat koholi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE