বক্তার নাম এডুয়ার্ডো গঞ্জালভেজ দে আন্দ্রাদে। সেটা নিশ্চয়ই বাড়ির লোক ছাড়া সবাই ভুলে গিয়েছে। বিশ্ব যে একটা নামেই চেনে টোস্টাও! আরও একটা নাম তাঁর হয়ে গিয়েছিল হোয়াইট পেলে। চোখের জন্য মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে খেলা না ছেড়ে দিতে হলে কোথায় গিয়ে থামতেন কেউ জানে না। এত কম বয়সে খেলা ছেড়েও ব্রাজিলীয় ফুটবলের প্রবাদপুরুষদের মধ্যে তিনি গণ্য হন। আর একটা কারণে বাড়তি শ্রদ্ধা পান। সত্তর দশকের সেই প্লেয়ারদের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত বলে। সাতষট্টি বছরের আজকের মানুষটা জনপ্রিয় কলামনিস্ট। মিডিয়ায় তাঁর প্রচুর প্রতিপত্তি। রোববার ফাইনালের কয়েক ঘণ্টা আগে যখন বেলো হরাইজন্তের বাড়িতে তাঁকে মোবাইলে ধরলাম, খুব তাড়ার মধ্যে। এই নিয়ে চার বার ফোনে কথা হয়েছে। খুব হালকা ইংরেজি জানলেও কিছুতেই তাঁকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি করাতে পারিনি। রোববার দুপুরে গ্লোবো ডট কমের নামী সাংবাদিক আলেজান্দ্রে গন্তিজো দোভাষীর কাজ করতে রাজি হওয়ায় অবশেষে টোস্টাওকে রাজি করানো গেল...
টোস্টাও: প্রথমে কোনও প্রশ্ন শোনার আগেই বলি, আমি আজকাল ইন্টারভিউই দিই না। স্রেফ নিজের লেখা লিখি। ব্রাজিল ফুটবল নিয়ে আমার বিরক্তিটা এত চরমে পৌঁছেছে যে, ইন্টারভিউ দিয়ে কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না। এটা একেবারেই অপরিচিত এক সাংবাদিককে দেওয়া, যে অন্য দেশ থেকে এসেছে। সে দেশের মানুষকে সম্মান করে দেওয়া, কারণ ব্রাজিলীয় ফুটবলে ভালবাসার মতো এখন কিছু পড়ে নেই।
প্রশ্ন: দু’ম্যাচের দশ গোল দেখছি আপনাকে একেবারে তেতো করে দিয়েছে!
টোস্টাও: ভুল ধারণা। আমি অনেক দিন ধরেই ব্রাজিল ফুটবল নিয়ে সমালোচনা করে আসছি আর সেটা যে যথার্থ ছিল, এত দিনে আমার পাঠকেরা নিশ্চয়ই বুঝেছেন। আমি টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই বলেছি, ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতে ফেললে উচ্ছন্নে যাবে আমাদের দেশের ফুটবল! আর কোনও পরিবর্তনই হবে না। সিস্টেমের গলদগুলো যা ছিল তাই থেকে যাবে।
প্র: বলছেন কী? তার মানে দশ গোলে আপনি বিষণ্ণ নন?
টোস্টাও: আমার মধ্যে দুটো সত্ত্বা কখনও কাজ করে। আর একটা আর একটাকে ঢেকে দেয়। কলাম-লিখিয়ে হিসেবে আমি সংস্কার চাই। আর তার জন্য ব্রাজিলের খারাপ খেলাটা দরকার। কিন্তু প্রতি বার যখন খেলাটা শুরু হয়, হলুদ জার্সি মাঠে দেখলেই আমি ব্রাজিলকে নিয়ে আত্মহারা হয়ে যাই। যদি আমার মনের কথা জিজ্ঞেস করেন, আমি ব্রাজিলীয় ফুটবলের ধারাবাহিক রমরমা দেখতে চাই। জার্মানিকে সে দিন ব্রাজিল দু’গোল দিলে আমাদের সিস্টেমটা যা থাকার তাই থেকে যেত। আমার শহরে খেলা সে দিন, মাঠেও যাইনি। কিন্তু টিভিতে ওই গোলগুলো দেখে আমার মনে হচ্ছিল হার্ট বন্ধ হয়ে যাবে। কী করছেটা কী এরা আমাদের নিয়ে। হাফটাইমের পরে গোল দিচ্ছে না আমাদের কৃপা করে হচ্ছেটা কী! তার পরে মনে হল পেলের তা হলে বুকের ভেতরটা কী হচ্ছে? ও হল ফুটবল সম্রাট। এই হলুদ জার্সিটা ওর সাম্রাজ্য। তাকে নিয়ে কী হচ্ছে।
প্র: টুর্নামেন্টের শুরুতেই আপনি বলেছিলেন, ব্রাজিলের দুটো স্ট্র্যাটেজি। এক, বল পেলে নেইমারকে বাড়াও। দুই, বল পেলে নেইমারকে বাড়াও। লাইনটা এতই জনপ্রিয় হয় যে, ইংল্যান্ডের কাগজগুলোও পর্তুগিজ থেকে অনুবাদ করিয়ে আপনাকে উদ্ধৃত করেছে। দশ গোল পরবর্তী সময়ে এখন লাইনটা নিয়ে কী মনে হচ্ছে?
টোস্টাও: কিছুই মনে হচ্ছে না। যা ঘটার ছিল তাই হয়েছে। আমরা গত বছর কনফেড কাপ জিতে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলাম। রিয়্যালিটি চেক করতে চাইনি। ভাবিনি যে বিশ্বকাপ আর কনফেড কাপ দুটো আলাদা পৃথিবী। আমরা বুঝিনি যে ব্রাজিল বলে বিশাল ইগো নিয়ে মাঠে নেমে পড়ার দিন শেষ হয়ে গিয়েছে।
প্র: ইগো?
টোস্টাও: ইগোটা একটা বিশাল সমস্যা আমাদের ফুটবল মহলের। সব সময় একটা উন্নাসিকতা আমি ব্রাজিল! আরে ভাই তুমি ব্রাজিল তো কী! চোখ তুলে তাকাও আর দ্যাখো তোমার আশেপাশেও এ রকম অনেক ব্রাজিল গজিয়ে গিয়েছে।
প্র: এই ইগোটা তো সবচেয়ে বেশি দেখিয়েছেন স্কোলারি। হাঁড়িকাঠে প্রথম ওঁর মাথাটাই যাওয়া উচিত নয়?
টোস্টাও: না, আমি এই স্কোলারি বিরোধী উগ্র হাইপের মধ্যে নেই। আমি মনে করি না স্কোলারিকে তাড়ালেই ব্রাজিলের সমস্যা মিটে যাবে। সমস্যার শো-কেস স্কোলারি হতে পারেন। কিন্তু এর মুখ নয়। এর আসল মুখ অনেক গভীরে।
প্র: মানে?
টোস্টাও: সবার আগে দরকার আমাদের দেশের যুব কোচগুলোকে তাড়ানো। ব্রাজিলীয় ফুটবল কাঠামোর এই ঘুণ ধরে যাওয়ার জন্য ওরা দায়ী। সিনিয়র টিমে সে যখন আসে, তার খেলার স্টাইল তখন তৈরি হয়ে গিয়েছে। কোচ কতটা আর বদলাবে! আসল হচ্ছে জুনিয়র পর্যায়ের কোচিং। ব্রাজিলের রোগটা সেখানে।
প্র: জুনিয়র কোচ কী করবে?
টোস্টাও: আমাদের পুরনো বলের টাচ ফিরিয়ে আনবে তার ছাত্রদের মধ্যে। একই সঙ্গে আমি ব্রাজিল না ভেবে সে ফুটবল-উন্নত দেশগুলো যা করছে সেটা নিয়ে আসবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ব্রাজিল ফুটবলকে সবার আগে বিনয়ী হওয়া শিখতে হবে। ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনো। একই সঙ্গে আধুনিকতার আলোটা জ্বালাও।
প্র: দুটো একই সঙ্গে সম্ভব?
টোস্টাও: নিশ্চয়ই সম্ভব। নইলে এই দুর্দিনের দিন পরের বিশ্বকাপগুলোতেও দেখার জন্য তৈরি থাকুন।
প্র: পেলে সম্পর্কে আপনি একটু আগে উচ্ছ্বসিত ভাবে বললেন। পেলে না মারাদোনা?
টোস্টাও: দু’জনেই ফুটবল জিনিয়াস।
প্র: এক জনকে বাছতে বললে?
টোস্টাও: কোনও সন্দেহ নেই, পেলে! অনেক বেশি কমপ্লিট ফুটবলার। মারাদোনাও জিনিয়াস, কিন্তু পেলের জিনিয়াসের পাশে আবার একটা প্লাস সাইন আছে!
প্র: পেলে না গ্যারিঞ্চা?
টোস্টাও: পেলে। পেলের সব কিছু ছিল। দু’পায়ে শট, ড্রিবল, হেড, ওই রকম গতি। মডার্ন ফুটবল পেলের পরীক্ষা অনেক বাড়িয়ে দিত। জায়গা পেত না। ওকে ভিডিও দেখে ধরে ফেলত বেশি। গোল অনেক কমত। কিন্তু পেলেই সেই এক নম্বর থেকে যেত। আমি ওর সঙ্গে খেলতাম তো, চোখের সামনে দেখেছি!
প্র: মেসি?
টোস্টাও: এটাই যেন শেষ প্রশ্ন হয়। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, মেসিও এক জন গ্রেট শুধু নয়। ও জিনিয়াসদের ওই সরণিতে চলে গিয়েছে। আজকের ফাইনাল জিততে না পারলেও ওই জায়গাটা ওর থাকবে।
প্র: আর কিছু?
টোস্টাও: এখানে মেসিকে যে ভাবে টিমকে টেনে তুলতে দেখলাম, তাতে ওর ওপর প্রচুর চাপ বোঝাই যাচ্ছে। আমার মনে হয় দেশের হয়ে এত অনন্ত চাপ বিহীন ক্লাব ফুটবলেই ওকে আরও বড় ভূমিকায় দেখা যাবে। এখন তো আর আগের মতো নয় যে, বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেল তো ফুটবল প্রদর্শনীর জায়গাটাই কয়েক বছরের জন্য জনতার মন থেকে চলে গেল। আমার মনে হয় মেসিকে ক্লাব ফুটবলের দুনিয়ায় আমরা ফুটবলার হিসেবে আরও উন্নতি করতে দেখব!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy