আটলেটিকো-উৎসব। মঙ্গলবার যুবভারতী।
আটলেটিকো ২(আরাতা, লারা) : কেরল ১(ডাগনাল)
জনা পঁচিশ মহিলা ঢাকির সুরেলা বোলে ম্যাচের আগেই মাঠ জুড়ে উৎসবের পরিবেশ। তাতে যেন বারবার সঙ্গত করছিল স্টেডিয়াম জকির সেই প্রশ্ন। জিতবে কে? আর বারুদে আগুন লাগার মতো ষাট হাজারের গ্যালারিতে উচ্ছ্বাসের তুবড়ি ছুটছিল। বারবার আছড়ে পড়ছিল সেই শব্দব্রহ্ম, ‘‘এ টি কে...এ টি কে!’’
পাঁচ দিন আগে ভেস্তে যাওয়া ইডেনের ম্যাচে লোক হয়নি। আটলেটিকো দে কলকাতার খেলা দেখতে কিন্তু উপচে পড়া ভিড় যুবভারতীতে। স্টেডিয়ামের সামনের পার্কিং লট গাড়িতে ঠাসা। পুজো নিয়ে উৎসাহের তীব্র আবহেও।
কে নেই সেই ভিড়ে? মঙ্গলবার রাতের যুবভারতীতে পাল্লা দিয়ে মহিলা সমর্থকরাও যে এসেছেন। রঙিন হতে। রাঙিয়ে দিতে। মাথায় লাল-নীল রিবন। মুখে আঁকা হাবাসের দলের জার্সির রং। কাকিমার সঙ্গে খুকুমণি হাজির। দাদুর সঙ্গে নাতিও। কলকাতার ফুটবল ডার্বিতে অহরহ দেখা যায় মেক্সিকান ওয়েভ। সেটা উঠেছে এ দিনও। কিন্তু এ ভাবে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে মাঠে আসার দর্শক-দৃশ্য কখনও দেখেনি কলকাতার ফুটবল। আর এই উচ্ছ্বাসে হারিয়ে গিয়েছে গ্যালারিতে সামান্য কিছু হলেও কেরল সমর্থকদের সর্ষে-হলুদ জার্সি। পতাকা।
ভিআইপি বক্সের উল্টো দিকে এটিকে-র ফ্যানস জোনে নানা পোস্টার হিউম-পস্টিগাদের। তার সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছেন সমর্থকরা। আইএসএল-টুতে কলকাতা যেন আরও বেশি করে বদলে ফেলেছে ফুটবল দেখার মেজাজ। গত বছর তো তবুও উদ্বোধন দেখার ভিড় ছিল। এ বার তো তা-ও নেই। তা-ও এত দশর্ক! অবাক লাগছিল।
সচিন তেন্ডুলকর শেষ পর্যন্ত তাঁর কেরল টিমকে সমর্থন করতে কলম্বো থেকে কলকাতায় আসেননি। ফলে মাস্টার ব্লাস্টারকে নিজের মাঠের গ্যালারিতে বসিয়ে রেখে হারানোর আনন্দটা পাননি শহরের ‘মহারাজ’ সৌরভ। তবে নীতা অম্বানীরা ছিলেন গ্যালারিতে। সেলফির ছবি হতে। গ্যালারিতে কে আছেন বা নেই, তা নিয়ে দর্শকদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। কলকাতার গোলের সময় তাঁদের উচ্ছ্বাস, ম্যাচটা ২-১ হওয়ার সময় তাঁদের দীর্ঘশ্বাস দেখে মনে হয়েছে নিখাদ একটা ফুটবল প্যাকেজ দেখতে এসেছেন সবাই। যা দেখে মনের তৃপ্তি না হলেও চোখের আনন্দ হয়।
মঙ্গলবারের জনতার ঢল ফের তুলে দিল সেই প্রশ্ন। ক্ষয়িষ্ণু আই লিগকে বাঁচাতে এখনই আইএসএলের সঙ্গে তা মিশিয়ে দেওয়া উচিত কি না? কারণ যে ভাবে দেশীয় ফুটবলের এই নতুন টুনার্মেন্টের জনপ্রিয়তা বাড়ছে তাতে দুই লিগ মিশে না গেলে কিন্তু আই লিগের ক্লাবগুলি আরও বিপন্ন হয়ে পড়বে আগামী দিনে।
আটলেটিকোর এ বারের ‘নীলকন্ঠ’ যেন গত বারের ফিকরু তেফেরা। ইজুমি আরাতা ভারতের পাসপোর্ট পাওয়ার পর নীলকন্ঠ নাম নিয়েছেন। লাল-সাদার জন্য নীল-ই এখন গোল আনছেন! ঠিক ফিকরুর মতো। জিকোর দলের বিরুদ্ধে গোয়ায় গোল পেয়েছিলেন। ঘরের মাঠে নেমেও চ্যাম্পিয়নদের প্রথম ম্যাচেই তাঁর পা থেকে ছিটকে বেরিয়েছে হাবাসের টিমের প্রথম গোল। আরাতাকে যখন হাবাস মুম্বইয়ের নিলামে দলে নিয়েছিলেন তখন তাঁকে নানা সমালোচনা শুনতে হয়েছিল। কিন্তু মাদ্রিদে পৌনে এক মাসের ট্রেনিং আরাতা থেকে নীলকন্ঠ হয়ে যাওয়া মিডিওকে কেমন যেন ‘স্প্যানিশ’ করে দিয়েছে। জাপানি থেকে ভারতীয় হয়ে এখন তিনি সত্যিই যেন ‘মাদ্রিদ-ম্যান’। স্পেনে গিয়ে যে আরাতা নতুন জীবন পেয়েছেন সেটা বলতে তাই ভোলেননি কলকাতার মিডিও। বলেছেন, ‘‘হাবাসকে ধন্যবাদ দিতে চাই। উনি আমাকে বদলে দিয়েছেন।’’ ফিকরু না থাকায় নতুন হেয়ার স্টাইলের আরাতা হঠাৎই হার্টথ্রব হয়ে গিয়েছেন কলকাতার। এমন একটা সময় আরাতা গোলটা করলেন যখন ‘নেই’ রাজ্যের বাসিন্দা স্প্যানিশ কোচের জন্য একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারের দরকার ছিল।
আর এই গোল-অক্সিজেনই যেন কলকাতাকে অনেকটা চাপমুক্ত করে দিয়ে গেল। গ্যালারিকেও। হাবাস টিম সাজিয়েছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধি করে। এবং যথেষ্ট সাহস দেখিয়ে। গোলকিপার পজিশনে প্রথমবার নামিয়েছিলেন বিদেশি সাঞ্চেজকে। স্প্যানিশ এই কিপার এ দিন নায়ক এবং খলনায়ক দুই-ই হয়ে রইলেন। ২-০ ম্যাচ থেকে ২-১ হল তাঁর দোষে। আবার শেষ দিকে দু’টো দুর্দান্ত সেভও করলেন এটিকে কিপার। পতন রুখলেন দলের।
কলকাতা কোচ ফর্মেশনটা এমন করেছিলেন যাতে মাঝমাঠেই বিপক্ষের খেলা আটকে যায়। ৪-২-৩-১ যে কোনও কোচের কাছেই ব্যালান্সড স্ট্র্যাটেজি। হাবাস জানতেন, তাঁর হাতের সেরা টেক্কা ভয়ঙ্কর হিউম। যিনি বিপক্ষ ডিফেন্সকে ফালাফালা করে দিতে পারেন তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত দৌড় দিয়ে। বোরহা আর গাভিলানকে পিভট করে হাবাস দাঁড় করিয়ে দিলেন চার ডিফেন্ডারের সামনে। ফলে যা হওয়ার তাই হল। কেরলের সব আক্রমণ থেমে যেতে থাকল মাঝমাঠে। জাভি লারার গোলটা বিরতির পর ওই স্ট্র্যাটেজির সুফল।
গত বারের মার্কি ফুটবলার কার্লোস মারচেনা না থাকায় কেরল টিমের রক্ষণ বেশ নড়বড়ে। মাঝমাঠে মেহতাব তাঁর অদম্য শক্তি দিয়ে একটা লড়াই চালাচ্ছিলেন বটে। কিন্তু সেটা সিন্ধুতে বিন্দু। কেরলের কোচ পিটার টেলর ব্রিটিশ। টিমে তাঁর দেশের ফুটবলারদের ভিড় বেশি। ভারতীয় যে সব ফুটবলারকে নেওয়া হয়েছে তাঁদেরও গড় বয়স তুলনায় বেশি। সেই সুযোগটা পুরোপুরি নিয়ে গেলেন হাবাস। কারণ মাদ্রিদের অনুশীলন পুরো টিমটাকে টাট্টু ঘোড়ার মতো দৌড় করাচ্ছে। টিম গড়ার সময় এটাই তো চেয়েছিলেন বলিভিয়ার প্রাক্তন কোচ হাবাস। ঘরের মাঠে নেমে অনেক নেই-এর মধ্যেও তাই প্রথম ম্যাচেই রাঙিয়ে দিলেন উৎসবমুখী শহরকে। দেবীপক্ষ শুরু হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই হাবাসের সাহস আর অঙ্ক রং এনে দিল আসন্ন শারদোৎসবে। তিন ম্যাচ পরেই তাঁর দল লিগ টেবলের শীর্ষে।
আরাতার গোল।
হাবাসের টিমে অন্তত পাঁচ জন প্রথম একাদশের গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার নেই। টিমের এক নম্বর স্টপার জোসেমি আবার হাফ ফিট। ফলে শেষের দিকটায় ক্লান্ত হয়ে পড়লেন তিনি। আর ডিফেন্সের ‘ক্যাপ্টেন’-এর ক্লান্তির জন্য শেষ দিকে কিছুটা সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল কলকাতা। সেই সুযোগে ডাগনাল গোল করে ২-১ করেন। ম্যাচটাও তখন কিছুটা জমেছিল। চাপের মুখে বারুইপুরের ছেলে মেহতাব হোসেন আবার লাল কার্ড দেখে ফেললেন। ফলে অতিরিক্ত সময়ে মিলে মিনিট পাঁচেক কেরলকে দশ জনে খেলতে হল।
যুবভারতীর অ্যাস্ট্রোটার্ফে এর আগে বহু ফুটবলার খেলতে গিয়ে পেশিতে চোট পেয়েছেন। তাঁদের মাঠের বাইরে বসে থাকতে হয়েছে মাসের পর মাস। সেখানে এখন নতুন ঘাস বসেছে। কিন্তু পরিচর্যার অভাবে সেটাও এখন ফুটবলারদের কাছে বধ্যভূমি। পাস বাড়াতে গেলে মাটি উঠে যাচ্ছে বুটের সঙ্গে। নন কিকিং ফুট রাখতে গিয়ে পড়তে হচ্ছে সমস্যায়। তারই শিকার হলেন কেরলের গুরবিন্দর সিংহ। আরাতার গোলের সময় তিনি ট্যাকল করতে গিয়ে পিছলে গেলেন। নন কিকিং ফুটটা সরে গেল। ফলে বড় চোট পেয়ে গেলেন তিনি। কবে মাঠে ফিরবেন, কে জানে। পরিস্থিতি যা তাতে এই যুবভারতী কিন্তু বিপক্ষের থেকেও বড় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে চ্যাম্পিয়ন কলকাতার। সেই আশঙ্কাটা থেকেই যাচ্ছে।
দূর্গাপুজোর পর আবার আরাতা-জাভিলারারা ঘরের মাঠে নামবেন খেলতে। তত দিনে যদি যুবভারতীর নতুন ঘাস আর তার নিচের মাটি এ রকমই থাকে তবে এই উৎসব দীর্ঘস্থায়ী হওয়া কঠিন।
আটলেটিকো: স্যাঞ্চেজ, ডেঞ্জিল, অগাস্টিন, জোসেমি, মোহনরাজ, বোরহা, গাভিলান, আরাতা (ক্লিফোর্ড), লারা (ভালদো), নাদং (সুশীল), হিউম।
ছবি: উৎপল সরকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy