প্রশ্ন: কলকাতার চ্যারিটিতে কাল আপনার যে স্নেহশীল মুখ দেখা গিয়েছে, তা এই শহর কখনও দেখেনি। আপনি শুধু এক কোটি টাকা দানই করেননি, শিশুদের সঙ্গে মিশেছেন। অথচ আপনাকে আমরা চিনি দয়ামায়াহীন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে। যিনি লোহার হাতুড়ি হাতে শাসন করেন।
শ্রীনিবাসন: কালকেরটাই রিয়েল আমি! আমি নিজে সেকেন্ড জেনারেশন উদ্যোগপতি। ব্যবসাটা শুরু করেছিলেন আমার বাবা। আমি সেটাকে প্রচুর বাড়িয়েছি। এমন ভঙ্গিতে বাড়িয়েছি, যা দেখলে বাবা হয়তো খুব খুশিই হতেন। আমার বাবা ছিলেন খুব উদার মানুষ। ব্যবসা-উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বরাবরই লক্ষ্য থাকত সমাজে কিছু কন্ট্রিবিউট করার। তিনটে সেক্টর আমরা বেছে নিয়েছিলাম। শিক্ষা। ধর্ম। খেলাধুলো। সেই পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে ভারতীয় ক্রিকেটে বলতে গেলে কোনও টাকাই ছিল না। আমরা কিন্তু সেই সময়ও ক্রিকেটারদের পাকা চাকরি দিয়েছি। একটা সময় পুরো তামিলনাড়ু টিমটাই ছিল ইন্ডিয়া সিমেন্টসের পে রোলে। আজও চেন্নাইয়ের বিভিন্ন লিগে আমাদের প্রায় পঞ্চাশ জন ক্রিকেটার খেলে। তাই আমি যখন আমার সম্পর্কে নানান অভিযোগের কাসুন্দি শুনি, তখন আমার নিজের মনেই এক চিলতে হাসি খেলে। হায়, ওই লোকগুলো যদি জানত! যদি সমালোচকরা সেই সময় আমাদের কাছ থেকে দেখতে পেত, তা হলে বুঝত ওই সামাজিক মনটাই আমাদের ভ্যালু। ওটাই আমাদের সহজাত।
প্র: আপনাকে নিয়ে প্রচুর গল্প প্রচলিত আছে। সব গল্পের ধরনই খুব চরম। প্রাক্তন বাংলাদেশ কর্তা, বর্তমানে আইসিসি প্রেসিডেন্ট মুজতবা কামাল যেমন বলেন, শ্রীনির মতো কর্মদক্ষতা আমি কোথাও দেখিনি। ভারতীয় বোর্ডেও অনেকে একই কথা বলেন। আবার ঠিক উল্টো মেরুর বক্তব্য হল, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য আপনি যা খুশি তাই করতে পারেন। এ ব্যাপারে আপনি রাজনীতিবিদদেরও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দেবেন।
শ্রীনিবাসন: (প্রশ্ন শুনে মুখটা একেবারেই অপ্রসন্ন) এটা বলা একেবারেই ঠিক হবে না যে আমি ক্ষমতা ছিনিয়ে নিই। বা আমার মধ্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা আছে। বিসিসিআইতে আমি অনেক বছর ধরে রয়েছি। যেখানে এক-এক জন কর্তার টার্মসগুলো সংক্ষিপ্ত। কেন এটা বলা হচ্ছে জানি না। তবে আমি বলতে পারি বিসিসিআইতে আমি বরাবরই খুব একমনা থেকেছি। আমার দায়িত্ব খুব মন দিয়ে পালন করেছি। যা থেকে প্রচুর ফায়দা বিসিসিআইও পেয়েছে। কাজেই আমি অভিযোগ স্বীকার করতে একেবারেই রাজি নই।
প্র: আপনার বিরুদ্ধে যখনই অভিযোগ ওঠে আপনি নিজের দিকটা বলেন না কেন? আপনি কি মানুষ হিসেবে লাজুক?
শ্রীনিবাসন: লাজুক কিছুটা। মানুষ হিসেবে আমি খুব প্রাইভেট। যদি না আমি খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে থাকি। বা এমন মানুষদের সঙ্গে থাকি যাদের উপস্থিতিতে আমি খুব স্বচ্ছন্দ। তখন আমি খুবই স্ট্রেট ফরোয়ার্ড। খোলামেলা। আর রিল্যাক্সড। কী, তাই তো? (একটু দূরে বসা সিএবি কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে-র দিকে তাকিয়ে। বিশ্বরূপ সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়েন।) কিন্তু আমি যাদের চিনি না, সেখানে আমি একদম নীরব। আমি কাউকে ইচ্ছাকৃত আঘাত দিতে চাই না। কিন্তু যেখানে চিনি না জানি না, সেখানে আমি নীরবই থাকি।
প্র: মিডিয়াতে যে আপনাকে নিয়মিত আক্রমণ করা হয়। বারবার আঘাত আসে আপনার ভাবমূর্তির ওপর। তাতে খারাপ লাগে না? নাকি আপনার কিছু যায় আসে না?
শ্রীনিবাসন: (কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর) আমি এ ভাবে দেখি আমার একটা চাকরি আছে। একটা গম্ভীর দায়িত্ব আছে। আমি সেটা মন দিয়ে করতে চাই। চটকদার হেডলাইন দরকার নেই আমার। আমি এটুকু খুব দ্রুতই বুঝে যাই যে আমার সিদ্ধান্তগুলো যতই সঠিক হোক না কেন, এ দেশে ক্রিকেটের যা চারিত্রিক মাহাত্ম্য তাতে ঐকমত্যে কোথাও পৌঁছনো যাবে না। মেনে নিতে হবে যে একটা ইস্যুতে বিভিন্ন মতামত আসবে। একই সঙ্গে সবাইকে আপনি খুশি করতে পারবেন না। কাজেই সেই চেষ্টারই কোনও দরকার নেই। আর অনেকে অনেক কথা বলছে বলে আপনাকে থেমে গেলে চলবে না। এটা এই পোস্টেরই ধর্ম।
প্র: ক্রিকেট বোর্ডে আপনার সহযোগীরা অনেকে অবাক হয়ে যান এত মামলা-মোকদ্দমা, দেশে আপনার বিরুদ্ধে নিয়মিত এত নেগেটিভ প্রচার, তবু এত অবিচলিত থাকেন কী করে?
শ্রীনিবাসন: আমার যদি গণ্ডগোলই থাকত, আমি যদি অসত্ কাজকর্ম সত্যিই কিছু করতাম, এমন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না। আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি কারণ আমার বিবেক খুব পরিষ্কার যে, আমি কোনও অন্যায় করিনি। আমার বিবেক আর নিজের প্রতি আস্থা এই দু’টো জিনিস আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আপনি যদি নিজের সম্পর্কে নিশ্চিত থাকেন, তা হলে যে কোনও সমালোচনার মুখেও অক্ষত থাকবেন। আর একটা জিনিস হল আমি ভীষণ ধার্মিক। ঈশ্বরের প্রতি অখণ্ড বিশ্বাসও আমার শক্তির একটা জায়গা।
প্র: কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা নিউজ টেলিভিশনের যুগে আপনার ওপর আক্রমণের মাত্রাটাও তো অনেক বেশি। সারাক্ষণ বাড়ির বাইরে ওবি ভ্যান বসানো। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর আপনি বাড়ি ফিরছেন, কখন ঢুকছেন, সব চ্যানেল দেখিয়ে দিচ্ছে। সেটা কি মারাত্মক একটা শাস্তি নয়?
শ্রীনিবাসন: না, টর্চার আমি বলব না। ক্রিকেট আমাদের দেশে একটা পাবলিক গেম। আপনাকে বুঝতেই হবে চারদিকে এ সব ঘটবে। আর তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।
প্র: মাঠের বাইরে আপনি যখন ক্রিকেট প্রশাসনে ভারতকে অমিত শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলছেন, তখন ক্রিকেট মাঠে কোনও এক মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ক্রমাগত জয় পতাকা ওড়াচ্ছেন। কী বলবেন এই শ্রীনি-ধোনি কম্বিনেশন সম্পর্কে?
শ্রীনিবাসন: এমএসডি হল এক ফেনোমেনন। আমি ভারতীয় ক্রিকেট অনেক বছর ধরে দেখছি। কম বেশি সব ক্রিকেটারকেই ঘনিষ্ঠ ভাবে চিনি। কিন্তু ধোনি হল অল টাইম গ্রেটদের একজন। ওর সমসাময়িক হিসেবে আমি গর্ব অনুভব করি। ক্রিকেটে সমস্ত ট্রফিই ধোনি জিতে ফেলেছে। ওর অধিনায়কত্বে টিম আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর হয়েছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে। ওয়ান ডে বিশ্বকাপ জিতেছে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পেয়েছে।
প্র: আপনি এঁদের সবাইকে কাছ থেকে দেখেন। আপনার মতে ধোনির সঙ্গে অন্যদের তফাতটা কোথায়?
শ্রীনিবাসন: এর উত্তরে বলি, ভারতের প্রাক্তন বিদেশি কোচ আমাকে বলেছিলেন, মাঠের মধ্যে দেখানো দাপটে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সমকক্ষ বিশ্ব ক্রিকেটে কেউ নেই।
প্র: কিন্তু যতই বলুন, কোনও দেশের সর্বময় ক্রিকেট কর্তা তার ক্যাপ্টেনের ওপর এতটা ভরসা রেখেছেন ভাবাই যায় না।
শ্রীনিবাসন: এই সিদ্ধান্তটাই কি দিনের শেষে সবচেয়ে অবজেক্টিভ আর নিখুঁত মনে হচ্ছে না আজ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy