Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
রইল বাকি সাত

ভারত আর ইতিহাসের মাঝে প্রাচীর ম্যাথেউজ

সোনার ইতিহাসের স্বর্ণ-দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি কী কী হয়? টেনশনে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। অল্পেই ধৈর্য হারায়। আবার সম্ভাবনার রোদ বাড়তে দেখলে, সে তখন শিশু। কেউ কেউ আবার নিজেকে সম্পূর্ণ সুইচ অফ করে দেয় বাইরের পৃথিবী থেকে। ঢুকে যায় নিজের জগতে। মনুষ্যচরিত্র অনুযায়ী প্রবৃত্তির ধরন বদলায়, তার প্রকাশ পাল্টায়। অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নখ ম্যাচে নামলে আর আস্ত থাকত না।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
কলম্বো শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৫১
Share: Save:

সোনার ইতিহাসের স্বর্ণ-দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি কী কী হয়?
টেনশনে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। অল্পেই ধৈর্য হারায়। আবার সম্ভাবনার রোদ বাড়তে দেখলে, সে তখন শিশু। কেউ কেউ আবার নিজেকে সম্পূর্ণ সুইচ অফ করে দেয় বাইরের পৃথিবী থেকে। ঢুকে যায় নিজের জগতে। মনুষ্যচরিত্র অনুযায়ী প্রবৃত্তির ধরন বদলায়, তার প্রকাশ পাল্টায়। অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নখ ম্যাচে নামলে আর আস্ত থাকত না। ঠিক তেমনই শোনা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে পাকিস্তান ম্যাচের আগে সচিন রমেশ তেন্ডুলকর সন্ধেয় ঘরের লাইট অফ করে শুয়ে টিভি দেখছিলেন। বলা ভাল, নির্নিমেষ দৃষ্টিতে টিভির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কারণ, ওটা ছিল তাঁর নিজস্ব যুদ্ধের রসদ সংগ্রহের প্রক্রিয়া, যার পোশাকি নাম কনসেনট্রেশন।
৩১ অগস্ট, ২০১৫-র রাতটা বিরাট কোহলির কেমন কাটবে, কে জানে। উত্তেজনায় নখ কাটবেন, আলো নিভিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকবেন, নাকি গল স্পেস রোডের হোটেলের কাঁচের জানলা থেকে সমুদ্রের ঢেউ দেখবেন, নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। রাত পেরোলে এমন একটা দিন তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ারে আসছে, যা তাঁর মাস তিনেকের টেস্টে পূর্ণ দায়িত্বের জীবনে অলিভ পাতার মুকুট হয়ে থাকতে পারে। বিদেশে টেস্ট সিরিজ জয় বলতে তো বছরচারেক আগে পদ্মাপারে তাঁর পূর্বসূরির ২-০। কিন্তু দ্বীপপুঞ্জ থেকে সিরিজ তুলে নিয়ে যেতে সেই পূর্বসূরিও পারেননি। তিরানব্বইয়ে ভারতের শেষ লঙ্কাজয়। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার তখনও অক্ষত ছিল। লিওনেল মেসির নাম কেউ শোনেনি। শাহরুখ খান সদ্য বলিউডে নাম করছেন। আর আজকের তিনি বিরাট কোহলি, সবে হামা দেওয়া ছেড়েছেন!
বাইশ বছরের সুদীর্ঘ অভিশাপ কাটাতে একটা দিন, তিনটে সেশন আর নব্বইটা ওভার আজ হাতে পাচ্ছেন কোহলি। সাতটা উইকেট শুধু ফেলতে হবে, সর্বাগ্রে তুলে নিতে হবে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউজকে। পারা তো উচিত। তাঁর হাতে একটা ইশান্ত শর্মা আছেন যিনি যুদ্ধের আঁচে মেজাজ হারালেও বলের লাইন হারাচ্ছেন না। মস্তিষ্কের আগ্রাসনকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন পেস বোলিংয়ে, ইতিমধ্যে দু’টো তুলে আরও কয়েকটার জন্য ঠোঁট চাটছেন। তাঁর হাতে একটা রবিচন্দ্রন অশ্বিন-অমিত মিশ্র স্পিন জুটিও আছে। যাঁদের দ্বৈত ভূমিকা ম্যাচের পঞ্চম দিনেও একেবারে প্রভাব না ফেললে বিস্ময়কর হবে। তার চেয়েও বড়, তাঁর হাতে আছে ৩৮৫ রানের দৈত্যাকার পর্বতমালা, যার অনন্ত চাপেই প্রতিপক্ষের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত। পড়ে তো একটা অ্যাঞ্জেলো, থিরিমান্নে আর ছোকরা কুশল। কোনও এক কুমার সঙ্গকারাও আর নেই। পি সারায় শেষ দিন আটটা ফেলতে লাঞ্চ অবধি লেগেছিল। এ বার আটের বদলে সাত, বিরাট কোহলির তো পারা উচিত।

প্রতিপক্ষও কিন্তু গুটিয়ে গিয়েছে। সন্ধের এসএসসিতে নুয়ান প্রদীপকে নিয়ে এল শ্রীলঙ্কা। ভারতীয় ইনিংসে চার উইকেট নেওয়া প্রদীপ যতই বলুন, “আমরা পজিটিভ ক্রিকেট খেলব, জেতার দিকে যাব,” গলার স্বর কিন্তু সেটা বলল না। মুখচোখ নিস্তেজ, কথা প্রায় শোনাই যাচ্ছে না। বোঝাই যাচ্ছে দেখে যে, এ দিনের লঙ্কা পেস ব্যাটারির সেরা অস্ত্র বাকি ম্যাচটা অ্যাঞ্জেলো আর ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। উপায় কী? এ মাঠে শ্রীলঙ্কার রান তাড়ার সেরা নিদর্শন ১৯৯৮ সালে। ফ্লাওয়ার ভাইদের জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে চতুর্থ ইনিংসে ৩২৬ তুলে জেতা। কিন্তু সে টিমে কোনও এক অরবিন্দ ডি’সিলভা ছিলেন। যিনি দ্বিতীয় ইনিংসে প্রায় একাই দেড়শো করে চলে যান। ক্ষুরধার মেধাসম্পন্ন এক অর্জুন রণতুঙ্গা ছিলেন। যাঁর ব্যাট থেকে অমূল্য ৮৭ রান ডি’সিলভার সঙ্গতে সে দিন বেরিয়েছিল।

কিন্তু সেই অরবিন্দও আর নেই, সেই লঙ্কাও নেই। অতীতের যাবতীয় ক্রিকেট-গৌরব ভারত মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। আজ তিনটে রান তুলতে দু’টো উইকেট বেরিয়ে যায়, তিনশো আশি তাড়া করতে গিয়ে দিনের শেষে কোনওমতে ওঠে ৬৭। অরবিন্দ-অর্জুনের ছায়াও নেই আর যে বাঁচাবে। অন্তত নিদেনপক্ষে একটা রোহিত শর্মাও যদি থাকত। যে পারত সকালের সেশনটা পার করে দিতে!

ভারতীয় ক্রিকেট আজ ধন্যবাদ দিতে পারে মুম্বইকরকে। চলতি সিরিজে রোহিতের অসহ্য ব্যাটিং দেখে জাতীয় মিডিয়ায় বলাবলি হচ্ছিল, আর নয়। এ বার যাওয়ার সময় হয়েছে। এটা ঠিক যে, রোহিত ব্যাটটা করছিলেনও খুব খারাপ। দলের প্রয়োজনে বিপক্ষকে উইকেট ‘উপহার’ দিয়ে দায়ভার মেটাচ্ছিলেন। সোমবারও যদি রোহিত না পারতেন, তাঁর টেস্ট কেরিয়ার বেশ কিছু দিন কফিনবন্দি হয়ে যেতে পারত। এসএসসি বাইশ গজে প্রথম সেশনের চাপ স্বয়ং অধিনায়ককেও কিন্তু নড়িয়ে দিয়েছিল। ২১-৩ দিয়ে দিন শুরু করে ৬৪-৪ হয়ে গিয়েছিল ভারত। রোহিতও ওখানে চাপে ন্যুব্জ হয়ে পড়লে কে বলতে পারে ভারতও ম্যাচে শাসিতের ভূমিকায় থেকে যেত না।

ইশান্তকে ধামিকার
বাউন্সার উপহার।

ধামিকাকে হেলমেট দেখিয়ে ইশান্ত:
মারো আমার মাথায়।

মুখেই জবাব
শ্রীলঙ্কা-পেসারের।

চন্ডিমলের উইকেট তুলে পাল্টা।
ক্রূদ্ধ ইশান্তকে সামলালেন টিমমেটরা।

আড়াইশো দিয়ে ম্যানেজ করা যাবে তৃতীয় দিনের শেষে, এমন একটা সার্বজনীন ভাবনা (গাওস্করও বলেছিলেন) তৃতীয় দিনের শেষে তৈরি হলেও, তা দিয়ে বোধহয় সম্ভব হত না। পিচ পরের দিকে এত সহজ হয়ে যাচ্ছে যে, আট এবং ন’নম্বর ব্যাটসম্যানের পার্টনারশিপেও পঞ্চাশ উঠে যাচ্ছে। তাই প্রথম সেশন সামলে দেওয়াটাই সর্বাধিক চ্যালেঞ্জের ছিল। এবং যে চ্যালেঞ্জে নেমে মুম্বইকর ঠুকঠুকের রাস্তায় গেলেনই না। উল্টে লঙ্কার সেরা পেসার প্রদীপকে বেছে নিলেন সংহারের জন্য। পরপর দু’টো বাউন্ডারি মেরে চাপ ঘাড় থেকে অনেকটাই নামিয়ে দিলেন। বিশেষ করে কভার দিয়ে যেটা ছুটে গেল, তা যে কোনও টিমকে ব্যাটসম্যানের উপর আস্থা দেবে। সত্তর স্ট্রাইক রেট রেখে এ দিন খেলে গিয়েছেন রোহিত। লাঞ্চের আগে টিমকে দিয়ে গিয়েছেন আড়াইশোর স্বস্তির লিড। তাঁর হাফসেঞ্চুরির পর ট্রেডমার্ক ভঙ্গিতে আউট হওয়া নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ করতে পারেন যে, লোকটা সত্যিই টেস্ট ক্রিকেটের উপযোগী কি না। এটাও বলাবলি চলতে পারে টিমের সর্বোচ্চ রান অশ্বিনের, স্টুয়ার্ট বিনি-অমিত মিশ্রও লড়ুয়ে ইনিংস খেলে গিয়েছেন। তা হলে শুধু রোহিত কেন?

আপাতদৃষ্টিতে ভাবনাটা ভুল নয়। ভারতীয় ইনিংসে আজ সেঞ্চুরি হয়নি। কিন্তু দুর্মূল্য কয়েকটা পার্টনারশিপ হয়েছে। যেমন কোহলি-রোহিত ৫৭। রোহিত-বিনি ৫৪। বিনি-ওঝা ৪২। মিশ্র-অশ্বিন ৫৫। কিন্তু পরবর্তী সব ক’টা পার্টনারশিপের বিশ্বাসের বেদী ছিল রোহিতের ওই হাফসেঞ্চুরি। প্রেক্ষাপট, পরিস্থিতি বিচারে ওটা ‘আ ব্রিলিয়ান্ট হান্ড্রেড!’ টিমকে শেষ পর্যন্ত যা লিডের অন্তরীক্ষে পৌঁছে দিল। আড়াইশো থেকে তিনশো, তিনশো থেকে সাড়ে তিন, শেষে তিনশো তিরাশি। আর তার প্রভাব এতটাই যে, ধামিকা প্রসাদের সঙ্গে তুমুল ঝামেলার পরেও ইশান্তের বোলিংয়ে তার কোনও রেশ দেখা গেল না। সাধারণত উল্টোটা হয়, এলোমেলো করে দেয় ভুক্তভোগীকে। আসলে টেস্টে ‘হারতে পারি’-র চাপটাই তো আর নেই। এখন হয় আমরা জিততে পারি, নইলে খুব খারাপ হলে ড্র। টার্গেটের শৃঙ্গ এতটাই উঁচু যে শ্রীলঙ্কা যতই বেয়ে ওঠার চেষ্টা করুক, সে প্রচেষ্টাকে ফুটনোটই দেখাবে। শেষ দিনে ৩১৯ আর কে কবে তুলেছে?

কোহলি তাই রাতে একটু ঘুমিয়ে নিলে পারেন। ক্রিকেট-ইতিহাস তাঁর দিকে। তা ছাড়া একজন তো মনে হয় ঘুমোবেন না।

ইশান্ত শর্মা নিশ্চিত আজ রাতে আর ঘুমোবেন না!

ভারত ৩১২ ও ২৭৪

কোহলি ক থরঙ্গা বো প্রদীপ ২১

রোহিত ক প্রদীপ বো প্রসাদ ৫০

বিনি ক থরঙ্গা বো প্রসাদ ৪৯

নমন ক করুণারত্নে বো হেরাথ ৩৫

মিশ্র রান আউট ৩৯

অশ্বিন ক পেরেরা বো প্রসাদ ৫৮

উমেশ ক হেরাথ বো প্রদীপ ৪

ইশান্ত ন.আ. ২

অতিরিক্ত ১০

মোট ২৭৪ অল আউট

পতন: ০, ২, ৭, ৬৪, ১১৮, ১৬০, ১৭৯, ২৩৪, ২৬৯

বোলিং: প্রসাদ ১৯-৩-৬৯-৪, প্রদীপ ১৭-২-৬২-৪, হেরাথ ২২-০-৮৯-১, ম্যাথেউজ ৬-৩-১১-০, কৌশল ১২-২-৪১-০।

শ্রীলঙ্কা ২০১ ও শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয় ইনিংস ৬৭-৩

থরঙ্গা ক নমন বো ইশান্ত ০

সিলভা ন.আ. ২৪

করুণারত্নে ক নমন বো উমেশ ০

চন্ডীমল ক কোহলি বো ইশান্ত ১৮

ম্যাথেউজ ন.আ. ২২

অতিরিক্ত

মোট ৬৭-৩

পতন: ১, ২, ২১

বোলিং: ইশান্ত ৭-২-১৪-২, উমেশ ৫-১-৩২-১, বিনি ৪-১-১৩-০, মিশ্র ২-০-২-০, অশ্বিন ০.১-০-৪-০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE