অঞ্জুম চোপড়া, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সচিন তেন্ডুলকর।
ভারত ২৯১-৯
লোকেশ রাহুল নামটা হলে কোথাও কোনও অসুবিধে ছিল না। কিন্তু তাই বলে তিনি!
স্বর্ণ-ইতিহাসের গ্রিন পার্কে সকালের দিকেই ব্যাপারটা চোখে পড়েছিল। গ্রিন পার্ক স্টেডিয়ামের কমেন্ট্রি বক্সটা একদম উপরে, চার তলার খোলা ছাদে। প্রায় একশো সিঁড়ি ভাঙতে হয়। তা বেঁটেখাটো চেহারাটা হোস্ট ব্রডকাস্টারদের শোয়ের তাগিদে যত বার ওঠা-নামা করেছে, ভদ্রলোকের চুল গড়ে অন্তত দু’বার করে মিডিয়ার দৃষ্টি মাঠ থেকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। পনিটেল নয়। পাতলা হয়ে আসা চুলের আসল আর্কষণ শেষ ভাগে। চুলের একটা ছোট্ট অংশ কাঁধে ঝুলে রয়েছে। পোশাকি নাম ‘চোটি’।
ভদ্রলোক কে? আর কেউ নন, সুনীল মনোহর গাওস্কর!
ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বপ্রথম ‘লিটল মাস্টারের’ প্রখর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ব্যাপারটা কল্পনা করা আপাত ভাবে দুঃসাধ্য ঠিকই, কিন্তু কাহিনি জানলে এতটুকু বিসদৃশ লাগবে না। বরং দাদু-নাতি সম্পর্কের এক নিটোল গল্পে মন ভিজে যেতে পারে। মাস ছয়েক আগের কথা। রোহন গাওস্করের ছেলে ও রকমই এক ‘চোটি’ করিয়ে স্কুলে যাওয়ায় নাকি বন্ধুরা তাকে ‘তোর চুল মেয়েদের মতো’ বলে প্রবল ক্ষেপিয়েছিল। লিটল-গাওস্কর স্কুল থেকে ফিরে দাদুকে অভিমানে বলে ফেলে যে, ‘চোটি’ আর সে রাখবে না। দাদু শুনে-টুনে নিজেই একটা ‘চোটি’ করিয়ে বাড়ি ফেরেন! নাতিকে বলে দেন, দ্যাখ, আমিও করালাম। আমি তো আর মেয়ে না। যদিও এটা তোকে বেশি মানায়!
ধোনির সঙ্গে নতুন হেয়ারস্টাইলে আবির্ভাব গাওস্করের।
পড়ন্ত বিকেলের গ্রিন পার্কে গাড়িতে ওঠার সময় গাওস্কর যখন গল্পটা বিশদে বলছিলেন, দ্রুত একটা তুলনা কানপুরে উপস্থিত যে কোনও ক্রিকেট সাংবাদিকদের মগজে আসতে বাধ্য। মাঠে তো আজ ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের দু’টো প্রজন্মই ছিল। একটা অতীত। একটা বর্তমান। অতীত যদি আজ দিনের শেষে ও রকম জড়িয়ে ধরতে পারত বিরাট কোহালিদের বর্তমানকে? যদি একই রকম সস্নেহে বলতে পারত, দেশের পাঁচশো নম্বর টেস্ট দেখতে আজ আমরা এসেছিলাম। তোরা আমাদের একটা সোনার দিন উপহার দিলি। এ বার বল, তোদের জন্য আমাদের কী করতে হবে!
পুরোটাই কল্পনা। আন্দাজ। কেউ বলেননি। কেউ খোলাখুলি বলবেনও না। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে চোরা দুঃখ, আক্ষেপ কি কাজ করবে না কপিল দেব-দিলীপ বেঙ্গসরকরদের? পাঁচশো টেস্টের উত্সবের আলো, সেই আলো-সৃষ্ট মায়াবী ঝর্ণাধারা, সব কিছুর পাশে কি না কোহালিদের ক্রিকেট এত ম্রিয়মান, এত অনুজ্জ্বল থেকে গেল!
দুঃখ তো হওয়াই উচিত।
ব্যাটিং ব্যর্থতায় প্রথম দিনে দেখতে হল মহম্মদ শামির আউটও। -পিটিআই ও রয়টার্স
উপরের স্কোরলাইন দেখে কোনও ভাবে বলা যায় না যে, কোহালির ভারত ম্যাচ থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। প্রথম দিনের পর সে সব ভবিষ্যদ্বাণী করা মূর্খামি। উল্টোটা হওয়ার সম্ভাবনা এখনও বেশি। কানপুর উইকেটে ভয়াবহ টার্ন না থাকতে পারে, কিন্তু অসমান বাউন্সের সঙ্গে মন্থরতা মিশে থাকায় ব্যাটসম্যানের পক্ষে সামলে দেওয়া কখনও কখনও বেশ কঠিনই হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিরাট-রাহানের মতো টেকনিক-সম্পন্নদের যা কষ্টসাধ্য ঠেকেছে, সেটা যে রস টেলর-মার্টিন গাপ্টিলদের পক্ষে মসৃণ বিচরণভূমি হবে, ভাবা ঠিক নয়। তা সে যতই ভারতের প্রথম ইনিংস তিনশোর কমে শেষ হয়ে যাওয়ার জোরালো ইঙ্গিত দিয়ে রাখুক। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও অনস্বীকার্য যে, মিচেল স্যান্টনার এখনও ড্যানিয়েল ভেত্তোরি নন। ট্রেন্ট বোল্টকেও কোনও এক ওয়াসিম আক্রমের সমগোত্রীয় বলা যায় না নিশ্চয়ই। কিন্তু তাঁরাই কি না দু’জন মিলে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের মস্তিষ্ক থেকে পাদদেশ স্রেফ টুকরো করে চলে গেলেন। আর যা-ই হোক, ঐতিহাসিক টেস্টের মঞ্চে আক্রান্ত হচ্ছে ভারতীয় ব্যাটিং, ভাল শুরুর পরেও উইকেট উপহার দিয়ে আসছেন ব্যাটসম্যানরা, দেখতে তো খারাপ লাগে। বিরাট কোহালিও দুঃখ দিয়ে গেলেন।
অথচ সকাল থেকে সমগ্র গ্রিন পার্ক জুড়ে যা চলছিল, এ সব ভাবনাচিন্তার কোনও জায়গাই ছিল না। পুরোটাই ক্রিকেট মেহফিল, যা বাইশ গজে কোহালিদের ক্রিকেটকেও যেন দিন শেষে মধুরেণ সমাপয়েতের আহ্বান জানাচ্ছে। গ্যালারিতে বিশেষ টি-শার্ট, লাড্ডু বিতরণ চলছে পুরোদমে। একটা সময় মাঠের পাশে দেখা গেল, শ’য়ে শ’য়ে রঙিন বেলুন ধীরে-ধীরে দখল নিচ্ছে আকাশের। উল্টো দিকের ভিআইপি গ্যালারিতেও তখন আর এক দুর্লভ ছবি। সুনীল গাওস্কর, কপিল দেব, সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি— একের পর এক নাম ঘোষণা করা হচ্ছে সংবর্ধনা মঞ্চে, মাঠে উপস্থিত ক্রিকেটপ্রেমীদের গায়ে আবেগের শিরশিরানি তুলে। প্রথমে উত্তরীয়, তার পর মানপত্র, শেষে বিশেষ মুদ্রা তুলে দেওয়া হল প্রাক্তন বারো টেস্ট অধিনায়কের হাতে। ঠিক তখনই মাঠের হাজার সাত-আট দর্শক চিত্কারের ডেসিবেল আচমকা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিলেন। ব্যাপার কী? না, বাইশ গজের পাশে তখন ব্লেজার পরে বিরাট কোহালি হাঁটতে শুরু করে দিয়েছেন। সঞ্চালকের মাইকে বলে ফেলেছেন, ভারতের পাঁচশো নম্বর টেস্টের অধিনায়কত্ব তিনি করবেন, কস্মিনকালেও ভাবতে পারেননি! এমন আবহে ভারতের ব্যাটিং-বিপর্যয় জাতীয় কোনও বিদঘুটে সম্ভাবনা মাথায় আসে? সম্ভব?
বিরল নজির। বিরল ফ্রেম। ভারতের পাঁচশোতম টেস্ট ম্যাচ শুরুর আগের গ্রিন পার্ক। রয়েছেন দিলীপ বেঙ্গসরকর, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত, সচিন তেন্ডুলকর, মহম্মদ আজহারউদ্দিন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গাওস্কর, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, অঞ্জুম চোপড়া, ডায়না এডুলজি-সহ অন্যান্য অধিনায়কেরা। অনুষ্ঠানে ছিলেন বিভিন্ন বোর্ড কর্তারাও। -পিটিআই
রবি শাস্ত্রীদেরও আসছিল না। গ্রিন পার্কের ছাদে দাঁড়িয়ে একবার শাস্ত্রী বলছিলেন যে, এই টিমটাকে তিনি সবচেয়ে বেশি নেড়েচেড়ে দেখেছেন। কোহালিদের দ্রুত টেস্ট সিংহাসন বসে পড়া নিয়ে তাঁর কোনও সন্দেহ নেই। শাস্ত্রী তখন বরং পাঁচশোর আমেজ নিচ্ছেন। বলছেন, “এ রকম একটা ইতিহাসের পার্ট হওয়াটাই বিশাল ব্যাপার।” ভারতের প্রাক্তন টিম ডিরেক্টর একটু পরে গেলেন সচিন তেন্ডুলকরের সাক্ষাত্কার নিতে। যেখানে সম্মোহনের আর এক পর্ব। ভারতের পাঁচশো টেস্টের মধ্যে একাই দু’শোটা খেলা সচিন বললেন, “পাঁচশো টেস্টে এসে প্রচুর স্মৃতি মনে পড়ছে। গ্রিন পার্কেরই আমার দু’টো সেরা স্মৃতি। একটা অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ, একটা দক্ষিণ আফ্রিকা। দু’টোই জিতেছিলাম।” সঙ্গে কোহালিদের নিয়ে সপ্রশংস সচিন জুড়ে দিলেন, “আমি যা বুঝছি, আগামী আট-দশ বছর বিরাটের টিম বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করবে।” শাস্ত্রী-সচিনরা ব্যতিক্রম নন। চতুর্দিকেই সে সময় কেমন যেন একটা আচ্ছন্ন, ঘোর লাগা ভাব।
দুপুর পর্যন্ত যা চলছিলও। কমেন্ট্রি বক্সে শোনা গেল, ছিয়াশির টাই টেস্ট নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা হয়েছে। সে দিন ভারতের শেষ ব্যাটসম্যান মনিন্দর সিংহ নাকি আজও বিশ্বাস করেন, তিনি এলবিডব্লিউ ছিলেন না। বলটা তাঁর ব্যাটে লেগেছিল। একাশির মেলবোর্ন টেস্টে তিরাশি অলআউট হয়ে গ্রেগ চ্যাপেলদের ব্যাট ছুড়ে ফেলে দেওয়ার কাহিনিও নাকি আড্ডায় উঠে এসেছে। তখন ভাবাই যায়নি, ১৫৪-১ থেকে ভারত দ্রুত ২০৯-৫ হয়ে যেতে পারে! ক্রিকেটারকুল থেকে দর্শক, কারও পক্ষে বোধহয় দুঃস্বপ্নেও ভাবা সম্ভব হয়নি যে দিনের সেরা ব্যাট মুরলী বিজয়কেও শেষে এসে বলতে হবে, “একটা শিক্ষা হল আমাদের। এ সব উইকেটে কী ভাবে খেলতে হয়, ধৈর্য কতটা রাখতে হয়, গ্রিন পার্ক উইকেট আমাদের আজ তা শিখিয়ে গেল!
শিক্ষা বোধহয় আরও একটা পাওয়া গেল। সেটা দিল বোধহয় টেস্ট ক্রিকেট। সে বুঝিয়ে গেল, আজও তার পূর্ণতার মানদণ্ড বাইশ গজে, আবহে নয়। বুঝিয়ে গেল এক সমুদ্র আবেগেও সে অবিচল। পাঁচই হোক বা পাঁচশো, যে কোনও মঞ্চে এখনও সে পারে পারিপার্শ্বিককে অদৃশ্য করে দিতে।
মাত্র এক বলের চোরাবালিতে!
ভারত (প্রথম ইনিংস): লোকেশ ক ওয়াটলিং বো স্যান্টনার ৩২, বিজয় ক ওয়াটলিং বো সোধি ৬৫, পুজারা ক ও বো স্যান্টনার ৬২, কোহালি ক সোধি বো ওয়াগনার ৯, রাহানে ক ল্যাথাম বো ক্রেগ ১৮, রোহিত ক সোধি বো স্যান্টনার ৩৫, অশ্বিন ক টেলর বো বোল্ট ৪০, ঋদ্ধিমান বো বোল্ট ০, জাডেজা নআ ১৬, শামি বো বোল্ট ০, উমেশ নআ ৮, অতিরিক্ত ৬, মোট ২৯১-৯। পতন: ৪২, ১৫৪, ১৬৭, ১৮৫, ২০৯, ২৬১, ২৬২, ২৭৩, ২৭৭। বোলিং: বোল্ট ১৭-২-৫৭-৩, ওয়াগনার ১৪-৩-৪২-১, স্যান্টনার ২০-২-৭৭-৩, ক্রেগ ২৪-৬-৫৯-১, সোধি ১৫-৩-৫০-১।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy