Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মিলখা-উষাদের সামনে রেখে ছাত্রীকে সতর্ক করবেন দ্রোণাচার্য

লন্ডনের চার নম্বর প্রশ্ন করলেন রিওর চার নম্বরকে। ‘‘দীপা, তুমি রিওতে পদকগুলো যে ভাবে দেখেছিলে, টোকিওর পদকে চোখ রাখার সময় একই রকম লাগছে কী?’’ জয়দীপ কর্মকারের প্রশ্নে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকেন তরুণ প্রজন্মের নয়া আইকন।

ময়দানে ভবানীপুর ক্লাবের সংবর্ধনা নেওয়ার পর দীপা।

ময়দানে ভবানীপুর ক্লাবের সংবর্ধনা নেওয়ার পর দীপা।

রতন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:২০
Share: Save:

লন্ডনের চার নম্বর প্রশ্ন করলেন রিওর চার নম্বরকে।

‘‘দীপা, তুমি রিওতে পদকগুলো যে ভাবে দেখেছিলে, টোকিওর পদকে চোখ রাখার সময় একই রকম লাগছে কী?’’

জয়দীপ কর্মকারের প্রশ্নে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকেন তরুণ প্রজন্মের নয়া আইকন। তার পর আর এক কর্মকারের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘‘রিওতে মনে হচ্ছিল ব্রোঞ্জটা পেতে পারি। এখন মনে হচ্ছে, চার বছর পর সোনাও পেতে পারি।’’

বণিকসভার সংবর্ধনায় হলঘর তখন আহ্লাদে আটখানা। হাততালিতে মুখর।

শুধু দর্শকাসনে বসা জয়দীপের মুখের অভিব্যক্তিতে যেন অবিশ্বাসের ছোঁয়া। লন্ডন অলিম্পিক্সে দীপার মতোই অল্পের জন্য ব্রোঞ্জ হারিয়েছিলেন শ্যুটার জয়দীপ। দীপার মতো দেশজুড়ে না হলেও সংবর্ধনায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকেও। দীপার মতো তিনিও সংবর্ধনা সভায় নিয়মিত বলতেন, ‘‘রিওতে পদকটা মুঠোর মধ্যে আনার জন্য এ বার ঝাঁপাব। চেষ্টার কোনও ত্রুটি থাকবে না।’’

জয়দীপ কিন্তু আর এগোতে পারেননি। উল্টে লন্ডন গেমসের চার বছর পর এখন তিনি অলিম্পিক্স বৃত্তের অনেক বাইরে।

কেন পারেননি? জয়দীপের ব্যাখ্যা, ‘‘আমার কোনও বিশ্বেশ্বর স্যার ছিল না। একাই লড়তে হত। তাই পারিনি।’’ আর দীপার জন্য তাঁর টিপস—‘‘সংবর্ধনা, উচ্ছ্বাস এ সব মাথা থেকে সরিয়ে রেখে নেমে পড়ো। ফের শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। অনুশীলন দ্বিগুণ করতে হবে। কারণ বিশ্বের সব জায়গায় অন্যরাও কিন্তু তোমার মতোই তৈরি হবে পদকের জন্য।’’

রোম অলিম্পিক্সে মিলখা সিংহ চতুর্থ হয়েছিলেন। লস অ্যাঞ্জেলিসে পিটি উষাও গিয়েছিলেন ওই পর্যন্তই। জয়দীপ তো টাটকা উদাহরণ লন্ডনে। চার বছর পরের অলিম্পিক্সে নেমে ওঁরা কিছু করতে পারেননি।

মিলখা, উষারাও যে অলিম্পিক্সে তাঁর মতোই চারে শেষ করেছিলেন, জানেন না দীপা। জানেন না, তাঁদের পরবর্তী সময়ের ব্যর্থতার কথাও। ময়দানের ভবানীপুর ক্লাবের সংবর্ধনা নিয়ে বেরোনোর পথে আগরতলার মেয়ের মন্তব্য, ‘‘তাই না কি? জানি না তো। ওঁরা তো আমার চেয়ে অনেক বড় প্লেয়ার ছিলেন।’’ সোমবার এক সংবর্ধনা সভায় জয়দীপের সঙ্গে হাতের আঙুল তুলে ‘চার’ দেখিয়ে ছবির পোজ দেওয়ার সময় সংশয় হচ্ছিল, দীপাও শেষ পর্যন্ত একই রাস্তায় হাঁটবেন না তো?

আজ নরেন্দ্র মোদীর শুভেচ্ছা তো কাল অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে সেলফি তোলা। সচিন তেন্ডুলকরের কাছ থেকে বিএমডব্লিউ গাড়ি নেওয়ার পর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের হাত থেকে সোনার মুকুট! আজ ওড়িশা তো কাল দিল্লি। পরশু হায়দরাবাদ তো পর দিন কলকাতা। ঘণ্টায় ঘন্টায় প্রেস মিট। সোমবারই তো তিনটে হয়ে গেল। মহাতারকা হয়ে গেলে যা হয়।

কী সব প্রশ্ন? প্রতিদিন তোমার প্রোদুনোভা ভল্ট দেখতে ইচ্ছে করে, কী করব? বিব্রত দীপাকে উত্তর দিতে হল, ‘‘দিল্লির সাইয়ে আমি প্রতিদিন ওই ভল্টটা অনুশীলন করি। দিল্লিতে চলে আসুন দেখতে পাবেন।’’ কেউ প্রশ্ন করছেন, তোমার নাকি খুব রাগ? কোচের সঙ্গে সমস্যা হয় না? এমএ পরীক্ষা দিয়ে আসা দীপা উত্তর দেন, ‘‘রাগ না থাকলে জেদ আসে না। খেলোয়াড়দের রাগ থাকতে হয়।’’ তার পরের প্রশ্ন, এমএ পরীক্ষাটা কেমন হল? দীপা হেসে ফেলেন। এড়িয়ে যান। রিও যাওয়ার আগে তাঁর মনোবিদ পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘‘প্রতিপক্ষকে বুঝতে দিও না টেনশনে আছ। সব সময় হাসি হাসি মুখ করে থেকো।’’ দু’দিনের কলকাতা সফরে সেটাই সারাক্ষণ বজায় রাখলেন জিমন্যাস্টিক্স নিয়ে দেশকে জাগিয়ে তোলার মহানায়িকা। ‘‘তোমার জন্য টোকিও অলিম্পিক্সে প্লেন ভর্তি করে যাব,’’ শুনেও দীপার মুখে হাসি অমলিন। মনোবিদের টিপস অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। সোনার মেয়ে মজা পেলেন যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হল, ভবানীপুর ক্লাবের সচিব সৃঞ্জয় বসু তো আপনাকে অনেক কিছুর সঙ্গে শাড়িও উপহার দিয়েছেন। ওটা পরবেন? ‘‘ছোটবেলায় স্কুলে শাড়ি পরেছি। তারপর আর পরিনি। দেখি কবে পরতে পারি।’’


দীপা কর্মকার ও জয়দীপ কর্মকারের দেখা হল শহরের এক বণিকসভার অনুষ্ঠানে। সেলফিতে ধরা থাকল সেই মুহূর্ত।

অনন্ত প্রশ্ন। অসংখ্য জিজ্ঞাসা। যার উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত মনে হচ্ছিল বিশ্বেশ্বর নন্দীর ছাত্রীকে। ‘‘২০২০-র টোকিওর পো়ডিয়ামে ওঠাই আমার লক্ষ্য’’ শোনার পরও প্রশ্ন আসে, ‘‘সোনা, রুপো না ব্রোঞ্জ, টার্গেট কী।’’ বিরক্ত দীপা উত্তর দেন, ‘‘সোনাকেই লক্ষ্য রাখতে হবে। ব্রোঞ্জ কেউ টার্গেট করে নাকি!’’

চার বছর অনেক লম্বা সময়, জানেন দীপার দ্রোণাচার্য বিশ্বেশ্বর নন্দী। মাঝে মন্ট্রিয়লে বিশ্ব জিমন্যাস্টিক্স, কমনওয়েলথ, এশিয়াড। তারপর আবার টোকিও অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জনের যুদ্ধ।

সে জন্যই ফের রিও-পূর্ববর্তী জীবনে ছাত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন বিশ্বেশ্বর। ঠিক করেছেন, পুজো পর্ব মিটিয়ে অনুশীলন শুরুর পর কোনও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যাবেন না। মোবাইল ফোনে কথা বলা বন্ধ করে দেবেন। আর কী করবেন? ‘‘দীপার জেদ আরও বাড়াতে মিলখা, উষাদের মতো কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের ব্যর্থতার কাহিনি শোনাব। সতর্ক করব বারবার। বলব, টোকিওয় পদক পেতে হলে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হবে। বাড়াতে হবে একাগ্রতা। শিখতে হবে নতুন জিনিস।’’ বলছিলেন বিশ্বেশ্বর।

বিশ্বেশ্বরের রিমোটেই চলেন দীপা। দু’দিনের চারটি সংবর্ধনার মাঝে দীপা বারবার বলে গেলেন, ‘‘আমি তো পদক আনিনি। তবুও আপনারা যে ভাবে আমাকে…..’’। এ সবই কোচের শেখানো কথা। যাতে ছাত্রী চার নম্বর হয়েও উচ্ছ্বাসের স্রোতে গা না ভাসান। মাথা ঘুরে না যায়।

আপনার ছাত্রী পরের অলিম্পিক্সে পদক আনতে পারবেন? চার বছর তো অনেক সময়। বিশ্বেশ্বর বললেন, ‘‘যখন জাতীয় ক্যাম্পে ওকে নিয়ে কাজ শুরু করি তখন ও বলেছিল, ‘স্যার আপনি বললে দশতলা থেকেও ঝাঁপ দিতে পারি।’ সেই মনোভাবটা জাগিয়ে তুলতে হবে ওর মধ্যে। নতুন করে ওকে নিয়ে ভাবছি। অনেক কিছু ঘুরছে আমার মাথায়। রিওর সেই রাতের দুঃখটা ভোলার জন্য আমি দিন-রাত পরিশ্রম করতে রাজি। ’’

ইতিহাস গড়ে ফেলা দীপার প্রোদুনোভা টোকিওর ভল্টিং টেবলে কতটা আলো ছড়াবে তা সময় বলবে। তবে দীপার সবচেয়ে বড় সুবিধা, তাঁর একটা বিশ্বেশ্বর স্যার আছেন। যিনি অনুশীলনের সময় হেডস্যারের মতোই আচরণ করেন। অত্যন্ত কড়া ধাতের মানুষ।

দীপা যদি মিলখা-উষা-জয়দীপদের রেকর্ড ভেঙে টোকিওয় পদক পান, তা হলে সেটা হবে তাঁর দ্রোণাচার্যের জন্যই।

ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dipa Karmakar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE