Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

মহানাটকীয় ভাবে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসার দিকে এগিয়ে ডালমিয়া

এখন রাত এগারোটা। চেন্নাইয়ের পার্ক শেরাটন হোটেলে নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের ডিনার সেরে বেরোচ্ছেন জগমোহন ডালমিয়া। আর বাইরে তাঁর জন্য অপেক্ষায় কারা? শ্রীনির ডিনারের বাইরে যাঁরা এতক্ষণ একান্তে নৈশভোজ সারছিলেন। এঁদের নাম শরদ পওয়ার এবং শশাঙ্ক মনোহর! পারথে ভারত বনাম আমিরশাহিতে নাটকের উপাদানে ঠিক যতটা ঘাটতি ছিল, ততটাই ঘাটতি কয়েক হাজার মাইল দূরে পূরণ করছে চেন্নাইয়ের বোর্ড নির্বাচন।

গৌতম ভট্টাচার্য ও রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা ও চেন্নাই শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৫ ০৩:১২
Share: Save:

এখন রাত এগারোটা। চেন্নাইয়ের পার্ক শেরাটন হোটেলে নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের ডিনার সেরে বেরোচ্ছেন জগমোহন ডালমিয়া।

আর বাইরে তাঁর জন্য অপেক্ষায় কারা?

শ্রীনির ডিনারের বাইরে যাঁরা এতক্ষণ একান্তে নৈশভোজ সারছিলেন। এঁদের নাম শরদ পওয়ার এবং শশাঙ্ক মনোহর!

পারথে ভারত বনাম আমিরশাহিতে নাটকের উপাদানে ঠিক যতটা ঘাটতি ছিল, ততটাই ঘাটতি কয়েক হাজার মাইল দূরে পূরণ করছে চেন্নাইয়ের বোর্ড নির্বাচন। নাটকের সবচেয়ে বড় মোড় হল সিএবি প্রেসিডেন্ট ডালমিয়া, যাঁকে মনে করা হচ্ছিল পেট্রন পদে বসার ব্যাপারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তিনি আচম্বিতে প্রেসিডেন্ট পদের সবচেয়ে বড় দাবিদার হিসেবে হাজির হয়েছেন।

কে জানত, সত্তরোর্ধ্ব ডালমিয়ার জন্য প্রশাসনিক জীবনের প্রান্তে এমন জামাই আদর অপেক্ষা করে আছে? শ্রীনি হঠাৎ করে তাঁর ভালবাসায় ডগমগ। পওয়ার গোষ্ঠীও তাঁর সম্পর্কে সশ্রদ্ধ। যার নিটফল এই যে, রোববার তিনটের সময় প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়নের জন্য একমাত্র ডালমিয়ার দরখাস্তই জমা পড়া উচিত। গভীর রাতে চেন্নাই থেকে ফোনে এক সিএবি কর্তা বললেন, “যাক আমাদের কাজ হয়ে গিয়েছে। ওয়ান পয়েন্ট এজেন্ডা ছিল। গুরু যেন প্রেসিডেন্ট হন। সেটার রাস্তা পাকা।”

ঐতিহাসিক ভাবে ভারতীয় বোর্ড নির্বাচন হল টি-টোয়েন্টি ম্যাচের অবিকল ঠিকুজিকুষ্ঠি। কখন কী হবে, খেলা কোন দিকে ঘুরবে, কেউ জানে না। ডালমিয়ার জন্য কাপ ও ঠোঁটের মাঝে সামান্য একটা ফাঁক রয়েছে। সেটা হল, পওয়ার-মনোহর গোষ্ঠী তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদে চায় না। শনিবার রাতের ইঙ্গিত অনুযায়ী, চায় না কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারও। এদের সেন্টিমেন্ট হল, অসামান্য ভারতীয় ক্রিকেটে ডালমিয়ার অবদান। তাঁকে আমরা মাথায় করে রাখতে চাই। তা বলে প্রেসিডেন্ট পদ দিয়ে নয়। রাতে মনোহররা নানান প্রস্তাব নিয়ে সিএবি প্রধানের সামনে হাজির হলেন। একটা প্রস্তাব সেই পুরনো, আপনি পেট্রন হয়ে যান। একটা প্রস্তাব, তিনি আইসিসিতে ভারতের মনোনীত প্রতিনিধি হয়ে যান। একটা প্রস্তাব, তিনি আইপিএল প্রধান হয়ে যান। মনোহররা চান যে কোনও একটা প্রস্তাব মেনে নিয়ে ডালমিয়া প্রেসিডেন্টের জন্য জায়গা ছেড়ে দিন অনুরাগ ঠাকুরকে। এঁরা ঠারেঠোরে এমনও বুঝিয়েছেন যে, আপনাকে তো আমরা যথেষ্ট সম্মান দেবই। আপনি প্রেসিডেন্ট পদটা আঁকড়ে আছেন কেন?

কিন্তু ডালমিয়া অনড়। তালেগোলে হঠাৎ করে প্রেসিডেন্ট পদের অফারটা তাঁর কাছে ফ্রি হিটের মতো এসে গিয়েছে। আর ফ্রি হিট পেলে অতিমূর্খ ব্যাটসম্যানও ডিফেন্ড করে না। চালায়।

পরিস্থিতির এমনই নাটকীয় মারপ্যাঁচ, যে শ্রীনি চব্বিশ ঘণ্টা আগেও চেন্নাইয়ে ডালমিয়াকে স্বাগত জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি, তিনি এ দিন পরম সমাদরে ডালমিয়ার সঙ্গে যতক্ষণ বৈঠক করলেন, তার মধ্যে একটা ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ দেখা শেষ হয়ে যায়। শ্রীনির লক্ষ্য খুব পরিষ্কার। তিনি বুঝে গিয়েছেন, পওয়ার প্লাস বিজেপি প্লাস মনোহর ক্ষমতায় এলে জোট তাঁকে সমূলে উপড়ে ফেলবে। বোর্ড তো ইতিমধ্যেই গেছে। আইসিসিতেও যাওয়া হবে না তাঁর। আইসিসি প্রধানের পদটাও খোয়াতে হবে। ডালমিয়াকে প্রেসিডেন্ট করলে সেই সমস্যা নেই। তিনি শ্রীনিকে নিষ্কণ্টক আইসিসি রাখতে দেবেন।

সকালে নাগপুর থেকে ফোনে শশাঙ্ক মনোহর এবিপি-কে বলছিলেন, “একটু পরেই চেন্নাইয়ের জন্য উড়ছি। আমি, পওয়ার সাব, আমরা যখন যাচ্ছি, বুঝতেই পারছেন স্রেফ বেড়াতে যাচ্ছি না।” কিছু পরে বিরোধীদের আর এক কর্তা বললেন, “কীসের ভোটের ভয় দেখাচ্ছে শ্রীনি? বিজেপি ভোট আমাদের দিকে। সব মিলিয়ে অলরেডি ধস নামিয়ে দিয়েছি ওর ভোট ব্যাঙ্কে।” অঙ্কের হিসেবে এটা সত্যি হয়েও প্রেসিডেন্ট পদে কাজ করছে না। তার কারণ প্রেসিডেন্ট হতে গেলে এ বার পূর্বাঞ্চল থেকে একটি সংস্থার সমক্ষে প্রস্তাব তোলা এবং আর একটি সংস্থার সমর্থন দরকার। এই দুটো সংস্থা জোগাড় করতে পারছেন না মনোহররা। পূর্বাঞ্চল থেকে ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশা এখনও সম্পূর্ণ শ্রীনির দিকে। আর ডালমিয়ার দিকে অপ্রত্যাশিত ভাবে এসে গিয়েছে অসম আর ত্রিপুরা। নিয়ে এসেছেন সিএবি কর্তারা। অর্থাৎ গোটা পূর্বাঞ্চলই ডালমিয়া আর শ্রীনির কব্জায়। কারও কারও মনে হচ্ছে, শরদ পওয়ারের মতো কৌশলী রাজনীতিবিদ এই নিশ্ছিদ্র দুর্গেও একটা ফাটল খুঁজে পাবেন। ঠিক কোনও না কোনও জায়গা থেকে প্রস্তাব তুলিয়ে আর এক সংস্থা থেকে সমর্থন আদায় করে নেবেন। কিন্তু শনিবার রাত পর্যন্ত চেন্নাইয়ে দেখছি পওয়ার-মনোহর জুড়িও এখনও অবধি নিষ্ফলা। তাই তাঁরা বারবার ডালমিয়ার দ্বারস্থ হচ্ছেন। আপনি সিএবি থেকে অনুরাগ ঠাকুরের নাম প্রস্তাব করে এনসিসি থেকে সমর্থন করে দিন। ডালমিয়া যা ডে’ভিলিয়ার্সের ভঙ্গিতে মাঠের বাইরে ছুড়ে দিচ্ছেন।

বোর্ড প্রেসিডেন্ট পদে যদি বা নির্বাচন এড়ানো যায়, বোর্ড সচিব পদে এখনও পর্যন্ত চরম যুদ্ধং দেহি। অনুরাগ যদি প্রেসিডেন্ট হতে না পারেন, তা হলে সচিব পদে তাঁকে জেতাতে চাইবেন মনোহররা। উল্টো দিকে শ্রীনি খাড়া করতে চান তাঁর লোক সঞ্জয় পটেলকে। শ্রীনি জানেন, অনুরাগ ঢুকে গেলে তাঁর এত দিনকার বোর্ড চালানোর রিমোটটা মেরিনা বিচে ছুড়ে ফেলা ছাড়া উপায় থাকবে না। পওয়াররা আবার ডালমিয়াকে বোঝাবেন, আপনাকে যদি আমরা প্রেসিডেন্ট ছেড়ে দিই, তা হলে কিন্তু সেক্রেটারি পদে অনুরাগকে আপনার নাম প্রস্তাব ও সমর্থন করতে হবে।

রোববার দপুরে মনোনয়ন পেশ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ নির্ভর করবে পওয়াররা পূর্বাঞ্চল থেকে কাউকে ভাঙাতে পারেন কি না তার উপর। মোটামুটি ঠিক, পওয়াররা ক্ষমতায় এলে আইসিসিতে যাবেন শশাঙ্ক মনোহর। শ্রীনিকে খারিজ করে ফেলা হবে। এমনকী বোর্ডকে শ্রীনি কলঙ্কিত করেছেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবও আনা হতে পারে। কিন্তু পওয়ার? তাঁর কী হবে? তিনি শুধু শ্রীনিকে সরিয়েই সন্তুষ্ট থাকবেন? গোটা পরিস্থিতিতে অনুঘটকের কাজ করবেন শুধুমাত্র শ্রীনিকে সরানোর জন্য? নিজে কোনও পদ নেবেন না? ভারতীয় ক্রিকেটমহল না আঁচিয়ে বিশ্বাস করতে রাজি নয়। আর এই বিশ্বাস করার সময় শুরু হচ্ছে রোববার দুপুর তিনটেয়।

জগমোহন ডালমিয়ার মতোই আরও এক জন অপ্রত্যাশিত ভাবে ফ্রি হিট পেয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে এসে গিয়েছেন। তাঁর নাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ডালমিয়া যদি শ্রীনির সমর্থনে ক্ষমতায় আসেন, তা হলেও সৌরভ ভাল জায়গায় থাকবেন। যদি পওয়ারদের সমর্থনে আসেন তা হলে তো থাকবেনই। পওয়ার গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ শনিবার মুম্বইয়ে আলোচনাও শুরু করে দিয়েছেন যে, সৌরভ কি পরের আইপিএল চেয়ারম্যান? নাকি ডানকান ফ্লেচারের বদলে তিনিই হয়ে যাবেন কোচ?

দিল্লি এখনও দূরঅস্ত। কিন্তু শ্রীনি বিরোধীদের ট্রেন যে মোগলসরাই ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE