ডার্বি যুদ্ধের আগে ‘শান্তির’ স্নান। শনিবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
দেশ ভাগের পর কখনও এ রকম ঘটেনি!
বাঙাল-ঘটি লড়াইয়ের বস্তাপচা ‘কনসেপ্ট’ প্রায় বিলীন হওয়ার মুখে যা ঘটতে চলেছে আজ রবিবার। যুবভারতীতে লক্ষ দর্শকের সামনে।
কলকাতা ডার্বি হচ্ছে অথচ লিগ টেবিলে মোহনবাগান চার আর এবং ইস্টবেঙ্গল পাঁচ নম্বরে!
ময়দানি ফুটবলের ইতিহাসে সত্যিই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। দেড়শোতম ডার্বিতে এসে কিন্তু সেটাই নির্মম বাস্তব। টালিগঞ্জ অগ্রগামী, মহমেডান, আর্মি একাদশেরও পরে এই মুহূর্তে অবস্থান মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের! যেখানে বাগান আবার বেঙ্গলের চেয়ে দু’পয়েন্টে।
তাতে ডার্বি-মাহাত্ম্য যে কমছে সেটা অবশ্য বলা যাচ্ছে না। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১৫০ নম্বর দেশের ফুটবল-হৃৎপিণ্ডেও যখন পুরোদমে বার্সা, ম্যান ইউ, রিয়াল জমানা, তখনও কলকাতা ডার্বির আগের সকালে টিকিটের লম্বা লাইন দু’মাঠেই। টিমকে সমর্থন জানাতে বহু তরুণ মুখ সেখানে দাঁড়িয়ে। প্রিয় দলের ফুটবলারদের সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করার সে কী আকুতি! ফেসবুক, টুইটারে গত দু’দিনের অবিরাম ইস্ট-মোহন সমর্থক-যুদ্ধের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম।
বাংলার ফুটবল সংস্কৃতি বদলে গিয়েছে অনেক দিনই। কিন্তু এই চিরকালের ম্যাচটা ঘিরে আবেগটা রয়েই গিয়েছে। লাল-হলুদ বা সবুজ-মেরুন তাঁবুতে এ দিন ভিড় করে আসা সমর্থকদের সঙ্গে কথা বললেই সেটা বোঝা যায়। এঁদের পূর্বপুরুষ কোন বঙ্গের সেটা এখন আর তেমন বিচার্য নয়। নিখাদ সমর্থনের তাগিদই উচ্ছ্বাসের আসল রসদ। বড় ম্যাচের কলকাতা ভাগ হয়ে যায় এই আবেগের তাড়নাতেই। যেমন হয় মাদ্রিদ ডার্বিতেরিয়াল আর আটলেটিকোর খেলায়। ম্যাঞ্চেস্টারে ম্যান ইউ আর ম্যান সিটি-র ম্যাচে। অথবা মিলানে এসি মিলান আর ইন্টারের যুদ্ধে। মিলান ডার্বিতে গতবারও উপচে পড়েছিল স্টেডিয়াম, দু’টো দল সেরি আ-তে লিগ পাঁচ এবং আটে থাকা সত্ত্বেও। বিশ্বায়নের যুগে কলকাতা ডার্বি-ও সেই পরম্পরা থেকে বেরিয়ে ব্যতিক্রমী হবে কেন? তা সে খেলার স্ট্যান্ডার্ড রবি-বিকেলের যুবভারতীতে যে মানেরই হোক না কেন!
বঙ্গ ফুটবলে এখনও ডার্বির জয়-পরাজয়ের ঝড় কী ভাবে আছড়ে পড়ে জানেন মোহন টিডি সুভাষ ভৌমিক। গতবার ঠেকে শিখেছেন গোয়ার কোচ আর্মান্দো কোলাসোও। কলকাতা ডার্বিকে গুরুত্ব না দিয়ে গোয়া চলে যাওয়ায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল দেশের সফলতম ক্লাব কোচকে। লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেও কাতসুমির গোলে বাগানের কাছে হারের ধাক্কায় চাকরি খোয়ানোর অবস্থা হয়েছিল তাঁর। সম্ভবত সে জন্যই শনিবার সকালের সাংবাদিক সম্মেলনে লাল-হুলুদ কোচকে বেশ কয়েক বার বলতে হল, “ডার্বির পরেও আরও কঠিন ম্যাচ আছে। তা সত্ত্বেও বলছি এই ডার্বির গুরুত্ব আমি বুঝেছি। পারিপার্শ্বিক সব অবস্থা বিচার করলে এই ম্যাচে আমরা আন্ডারডগ। কঠিন লড়াই। তবু চেষ্টা করতেই হবে জেতার।” যার এর কিছুক্ষণ পর বাগান টিডি-র গলাতেও শোনা গেল একই কথা। ‘‘আমরাও আন্ডারডগ। এই ম্যাচ বরাবরই স্পেশ্যাল। এটার সঙ্গে অন্য ম্যাচের তুলনা করবেন না।”
তীব্র চাপের মুখে দুই প্রধানের কোচের মুখেই চূড়ান্ত সতর্কতা। ক্লোজড ডোর অনুশীলন করে নতুন কিছু করছিসদস্য-সমর্থকদের সেই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন দু’জনেই। যে মাঠে ইচ্ছে করলেই ফাঁকফোঁকর দিয়ে ঢুকে পড়া যায়, সেখানে আবার বিদেশের কায়দায় ক্লোজড ডোর প্র্যাকটিস! বিস্মিত হতে হয়। যেমন থমকে যেতে হয় সিরিয়াস প্রশ্নেও মোহন-টিডির উত্তর শুনে। গত চার বছর ট্রফি নেই মোহনবাগানে। সেই ক্লাবের কোচ হিসেবে ডার্বি খেলতে নামার আগে কি চাপে আছেন? সুভাষের জবাব, “চাপে আছি। তবে সেটা আমার বাড়ির কুকুরটার অসুস্থতার জন্য।” উন্নাসিকতা, না কি তীব্র চাপ থেকে বেরোতেই এমন কথাবার্তা।
সারদা কাণ্ডের জেরে ময়দানের সবচেয়ে উজ্জ্বল ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে এখন গুমোট ভাব। ক্লাব তাঁবুর গেট পাহারা দিচ্ছেন এক প্রাক্তন ম্যানেজার, এক ক্লাব কর্মী। মেহতাব-বার্তোসদের মনোবল বাড়াতে বহু দিন পর প্র্যাক্টিসে হাজির ক্লাব প্রেসিডেন্ট থেকে স্পনসরের প্রতিনিধি। তা সত্ত্বেও ইস্টবেঙ্গল কোচকে কেমন যেন উদভ্রান্ত পথিকের মতো মনে হয়। “আমার টিম খারাপ খেলছে। স্কুলে ছেলে খারাপ রেজাল্ট করলে বাবা যা করে তাই করছি। বোঝাচ্ছি। সব সময় তো এক রকম যাবে না। কালই হয়তো সেই ভাল দিনটা আসবে।” কপালের জমে যাওয়া ঘাম মুছতে মুছতে বলে দেন ভারতীয় ফুটবলের সব ট্রফি জেতা কোচ।
সুভাষ এবং আর্মান্দো দুই কোচের কাছেই এই ডার্বি দু’টো ভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বাগানে সামনেই নির্বাচন। ফলে ডার্বি জেতাটা সুভাষের কাছে বর্তমান শাসক দলের কর্তাদের আশ্বস্ত করার ওষুধ। জিতলে খুলে যেতে পারে লিগ খেতাবের দরজাও। আর আর্মান্দোর কাছে? ক্লাবের শীর্ষকর্তার গ্রেফতারের পর ইস্টবেঙ্গলের আকাশে হঠাৎ যে কালো মেঘ জমেছে, সেটা সরে যেতে পারে এই একটা ম্যাচের জয়েই।
জয়ের খোঁজে দুই কোচই নিজের নিজের মতো করে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন। চাপ কাটাতে মোহনবাগান ড্রেসিংরুমে বাজছে চটুল হিন্দি গান। ইস্টবেঙ্গলে সেখানে ঈশ্বরের ছবিতে মাথা ঠুকে শপথ আছে। আর্মান্দো নামছেন ৪-৪-১-১ ফর্মেশনে। র্যান্টির একটু পিছনে বিশ্বকাপার বার্তোস। আর সুভাষের ৪-১-৩-১-১-এ আক্রমণে বলবন্তের পিছনে কাতসুমি। তবে ডার্বির ইতিহাস বলছে এই ম্যাচের আগের দিন কোচেরা যা ফর্মেশন ঠিক করে দেন, দর্শকদের শব্দব্রহ্মের সামনে পড়লে তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওলট-পালট হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জেতার রেসিপি হয়ে ওঠে সে দিনের পারফরম্যান্স, অভিজ্ঞতা আর ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের দু্যুতি।
আর্মান্দোর সুবিধা, তাঁর টিমের কাঠামোটা তিন বছর ধরে প্রায় একই রয়েছে। সুভাষের চিন্তার কারণ হতে পারে প্রায় হাফডজন নবাগত ফুটবলারকে তাঁদের প্রথম ডার্বিতে নামানোর ঝুঁকি। তাঁর দলের বিদেশি ডিফেন্ডার ফাতাই কলকাতায় এসে এখনও কোনও ম্যাচ খেলেননি। সরাসরি নামছেন ডার্বিতে। পরিস্থিতির চাপে সুভাষ তাঁকে নামাচ্ছেন। ইস্টবেঙ্গলের বার্তোসও ফর্মে নেই। দুই কোচের রিজার্ভ বেঞ্চেই অবশ্য থাকবেন আনকোরা দুই বিদেশি স্ট্রাইকার। বাগানের বোয়া আর বেঙ্গলের ডুডু। ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের কখন নামান টিমের ‘বস’, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। হয়তো তাঁরাই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠতে পারেন জয়ের টেক্কা। সুপার-সাব।
ডার্বি যেমন নতুন নায়ক তৈরি করে, তেমনই আবার মহানায়ককে ভিলেন বানায়। আজ কার কপালে শনি, আর কার বৃহস্পতি জানা যাবে রবি-সন্ধ্যা নামার আগেই।
রবিবারে
কলকাতা লিগমোহনবাগান: ইস্টবেঙ্গল (যুবভারতী ৪-০০)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy