Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সেই ঘাড়েই আঘাত, হিউজের পথে অঙ্কিত

চোখ দু’টো বন্ধ, ঠোঁট অল্প ফাঁক। পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা ছেলেটার মুখে একটা হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে। গালে, কপালে, মাথায়। ওটা ওর দাদার। পুরোহিত এসে বসলেন পাশে। মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে একটু জল দিতে বললেন ঠোঁটের ফাঁকে। জলটা পড়ে গেল। ভদ্রলোককে আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। অঝোরে কাঁদতে-কাঁদতে বিলাপ ভেসে আসছে একের পর এক। ‘‘জানেন, শনিবারও দেখতে গেলাম যখন স্যুপ খাচ্ছিল। বলল, একটু দুর্বল লাগছে শুধু। বাকি সব ঠিক আছে।’’

শেষ যাত্রায় অঙ্কিত। সোমবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

শেষ যাত্রায় অঙ্কিত। সোমবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৪
Share: Save:

চোখ দু’টো বন্ধ, ঠোঁট অল্প ফাঁক। পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা ছেলেটার মুখে একটা হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে। গালে, কপালে, মাথায়। ওটা ওর দাদার। পুরোহিত এসে বসলেন পাশে। মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে একটু জল দিতে বললেন ঠোঁটের ফাঁকে।

জলটা পড়ে গেল।

ভদ্রলোককে আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। অঝোরে কাঁদতে-কাঁদতে বিলাপ ভেসে আসছে একের পর এক। ‘‘জানেন, শনিবারও দেখতে গেলাম যখন স্যুপ খাচ্ছিল। বলল, একটু দুর্বল লাগছে শুধু। বাকি সব ঠিক আছে।’’ অরিজিৎ মজুমদার ভাবছেন এখন ‘ছেলে’ ছাড়া আর বাঁচবেন কী করে? জন্ম না দিলেও আট বছর ধরে ক্রিকেট শিখিয়েছেন। এ ক্লাব, ও ক্লাব করে শেষ পর্যন্ত দিয়ে এসেছিলেন ইস্টবেঙ্গলে। আর আজ?

আজ, পাঁচ মিনিট আগে সন্তানসম ছাত্রকে দেখেছেন, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আগুনের লেলিহান শিখার কোলে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যেতে।

‘রাম নাম সত্য হ্যায়’ ধ্বনি উঠছে একের পর এক। রাত পৌনে আটটা এখন। কেওড়াতলা চুল্লির যত কাছে শরীরটা এগোচ্ছে, প্রার্থনা বাড়ছে তত। কান্নায় বেঁকেচুরে যাওয়া শরীরগুলো ছিটকে পড়ছে এ দিক, ও দিক। কেউ বন্ধু। কেউ কোচ। কেউ আত্মীয়। কেউ একই অ্যাকাডেমির সতীর্থ। হাঁটু মুড়ে বসে, মাটিতে শুয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছে এক এক জন।

অঙ্কিত কেশরী আর নেই।

বঙ্গ ক্রিকেটের পরবর্তী প্রজন্ম বলে যাঁদের ধরা হয়, বাঁশদ্রোণীর ছেলে ছিলেন তার মধ্যে মুখ্য। অভিমন্যু ঈশ্বরণ, আমির গনিদের সঙ্গে তাঁর নামটাও সম-মর্যাদায় উচ্চারিত হত ময়দানে। অনূর্ধ্ব-উনিশ বাংলা অধিনায়ক ছিলেন। উন্মুক্ত চন্দরা যে বছর অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপ ভারতের হয়ে জিতেছিলেন, তার প্রাথমিক দলে অঙ্কিত কেশরীরও নামটা ছিল। বর্তমানে অনূর্ধ্ব তেইশ বাংলা খেলতেন, লোকে বলত ছেলেটা ডে’জ প্লেয়ার। উইকেটে পড়ে থাকতে জানে। অরিন্দম দাস চলে গেলে ওর জায়গায় হেঁটে হেঁটে ঢুকবে।

কে জানত, জীবনের সবচেয়ে লড়াকু ইনিংসটা আড়াই দিন ধরে খেলার পর হেরে যাবেন অঙ্কিত। থেমে যাবে সেটা সোমবার সকাল আটটা কুড়ি নাগাদ। কে জানত, মাত্র চারটে বলের একটা অধ্যায়ে ক্রিকেট নয়, তাঁর জীবনটাই থেমে যাবে? কে জানত, তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে এমন তোলপাড় করা বিতর্কের সৃষ্টি হবে যে, কাঠগড়ায় উঠতে থাকবে একের পর এক নাম। ইস্টবেঙ্গল, সিএবি। দু’টো বেসরকারি হাসপাতাল।

সোমবার সকালে শেক্সপীয়র সরণির বেসরকারি হাসপাতালে ঢুকে দেখা গেল, ঠিক সিঁড়ির মুখে বসে আরও এক যুবক বিপর্যয়ে চুরমার হয়ে বসে। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মাথা চাপড়াচ্ছেন অনবরত। না, যুবক অঙ্কিতের পরিবারের কেউ নন। ওঁর নাম সৌরভ মণ্ডল। শুক্রবারের কালান্তক ঘটনার সময় তাঁর সঙ্গেই ধাক্কা লেগেছিল অঙ্কিতের। অঙ্কিতের মতো তিনিও ইস্টবেঙ্গল ক্রিকেটার। এ দিন লিগ কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে গিয়েছিলেন। ওয়ার্ম আপ চলার সময় কানে আসে, সব শেষ। অঙ্কিত নেই। শোনা গেল, খবর শুনে ড্রেসিংরুমেই নির্বাক হয়ে বসে পড়েছিলেন সৌরভ। অস্ফুটে বলে ফেলেছিলেন, ‘‘ছেলেটা আমার জন্যই চলে গেল।’’

সৌরভ মণ্ডল নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। তাঁর হাঁটু যতই লেগে থাকুক অঙ্কিতের কানের নীচে, ঘাড়ের পাশে, কেউ তার জন্য তাঁকে বিন্দুমাত্র দোষারোপ করছে না। বারবার আবেদন উঠছে, সৌরভকে ‘শন অ্যাবট’ বানানোর চেষ্টা যেন না হয়। ফিল হিউজ কাণ্ডের সঙ্গে তুলনাও যেন না টানে কেউ। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বরং অন্য। প্রশ্ন উঠছে, যে ছেলের অবস্থা এত গুরুতর ছিল, যেখানে বারবার তাঁর সিটি স্ক্যান করে পাওয়া যাচ্ছিল ‘ব্লাড ক্লটের’ ইঙ্গিত, সেখানে কোন যুক্তিতে অঙ্কিতকে এক হাসপাতাল থেকে আর একটায় পাঠানো হল রবিবার সন্ধেয়? আর পাঠালেনই বা কে?

সিএবি বলছে, নাইটিঙ্গলে ভাল নিউরোসার্জন ছিল। তাই অঙ্কিতকে আনা হয়েছিল। অঙ্কিতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে। তাদের সম্মতি নিয়ে। সিএবি যুগ্ম সচিব সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘নাইটিঙ্গলে চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত। নিউরোসার্জন এখানে অনেক বেশি ভাল।’’ ইস্টবেঙ্গলের অন্যতম শীর্ষকর্তা দেবব্রত সরকার বলে দিলেন, আমরিতে তিন দিন ধরে কোনও চিকিৎসা হচ্ছিল না। ‘‘সিএবি ও ইস্টবেঙ্গলের যৌথ উদ্যোগে হাসপাতাল পাল্টানো হয়। কারণ ওখানে অঙ্কিতের মাথার দু’টো ক্ষতে চিকিৎসা হচ্ছিল না। আমরা তো ছেলেটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করব। আর যখন শুনলাম ওকে জেনারেল বেডে পাঠানো হচ্ছে, তখন বুঝলাম যে অবস্থা আরও সঙ্গীন হবে।’’ যা শোনামাত্র ওড়ালেন আমরি-র সিইও রূপক বড়ুয়া। বলে দিলেন, ‘‘জেনারেল বেডে দেওয়ার কথা হয়েছিল একবার। কিন্তু শনিবার থেকে অঙ্কিতের জ্বর আসায় সিদ্ধান্তটা পাল্টানো হয়। আর আমরা বারণ করেছিলাম এই অবস্থায় হাসপাতাল পাল্টাতে।’’ নাইটিঙ্গল বলে দিল, তারা অঙ্কিতকে পেয়েছে রবিবার রাত সাড়ে আটটায়। মস্তিষ্কে ‘হেমারেজ’ ছিল। জ্বর-জ্বরের সঙ্গে একটা ঝিমোনো ভাবও ছিল। ভাবা হয়েছিল, সোমবার সকালে আরও কয়েকটা পরীক্ষানিরীক্ষা করা হবে। কিন্তু ভোরেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যান অঙ্কিত। যার পর আর কিছু করা সম্ভব হয়নি।

বাংলার ক্রিকেটাররা যে যুক্তি শুনতে চাইছেন না। সরাসরি মন্তব্য না করলেও ঘনিষ্ঠমহলে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, একজন ক্রিকেটারের জীবন নিয়ে যে ভাবে টালবাহানা চলল, তা অমার্জনীয়। তাঁদের ক্ষোভের লক্ষ্য যত না দুই হাসপাতালের অঙ্কিতের শারীরিক অবস্থা ধরতে না পারা, তার চেয়ে অনেক বেশি করে সিএবি ও ইস্টবেঙ্গল। এ দিন অঙ্কিতের মৃত্যুর খবর আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ার পর হাসপাতালে ঢুকতে শুরু করেন একের পর এক ক্রিকেটার। রণদেব বসু, শিবশঙ্কর পাল, সৌরাশিস লাহিড়ী, ইস্টবেঙ্গলের গোটা ক্রিকেট টিম— কেউ বাদ ছিলেন না। মনোজ তিওয়ারি, অশোক দিন্দা, ঋদ্ধিমান সাহারা শহরে ছিলেন না। আইপিএল খেলতে তাঁরা এখন বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজিতে । কিন্তু ফোন করে খবর নিয়েছেন সতীর্থদের থেকে। জন্ডিসে আক্রান্ত বাংলা অধিনায়ক লক্ষ্মীরতন শুক্ল আসতে না পারলেও ফোনে যোগাযোগ রেখে গিয়েছেন। এবং বাংলার ক্রিকেটারদের একটা অংশ থেকেই অভিযোগ আসছে যে, রবিবার রাতে নাইটিঙ্গলে অঙ্কিতকে আনার পরে দেড় ঘণ্টা স্রেফ বসিয়ে রাখা হয়েছিল। কোন যুক্তিতে? কারও কারও অভিযোগ, সেরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হলে তো বাইপাসের ধারে আরও একটা বড় হাসপাতাল আছে। সেখানে নিয়ে গেল না কেন সিএবি?

অঙ্কিতের পরিবারবর্গ যদিও কোনও অভিযোগ করেনি। অঙ্কিতের বাবা রাজকুমার কেশরী বলে গেলেন, তাঁর ছেলের বাঁচার কপাল ছিল না। কাউকে দোষারোপ তাঁরা করতেও চান না। তাঁরা বুঝে পাচ্ছেন না, রাতারাতি এত অবস্থার অবনতি হল কী ভাবে? ভাবতে চেষ্টা করছেন, শুক্রবার রাত পর্যন্ত অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু শনিবার তো অঙ্কিতকে সুস্থই দেখিয়েছে। অল্পস্বল্প খাওয়া-দাওয়া করেছেন। কথা বলেছেন টুকটাক। ডাক্তাররা কেউ কখনও বলেননি, আশা ছেড়ে দিন। তা হলে কোথা থেকে কী হয়ে গেল? বিহ্বল দেখায় তাঁদের। শোকে মূহ্যমান দেখায়। যেমন দেখাল বিকেলে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ক্লাব লনে শায়িত অঙ্কিতকে দেখে শোকে মালা দিতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী। বেরনোর সময় বলে যান, ‘‘শুধু দেখতে এসেছিলাম। জীবনটা তো ওর শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল।’’ অঙ্কিতের বন্ধু-বান্ধব, সতীর্থ— তাঁরাও নির্বাক। ভাষা হারিয়েছেন।

শিবসাগর সিংহ যেমন। স্পষ্ট মনে করতে পারছেন ছবিটা যেখানে মাঠে তিনি অঙ্কিতকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দিচ্ছেন। ‘‘ও আর সৌরভ একই ক্যাচের জন্য দৌড়ল। সংঘর্ষের পর অঙ্কিতকে দেখলাম কী রকম নিথর হয়ে গেল। শ্বাস পড়ছে না। আমি লাইফ সাপোর্ট চালু করতে আচমকাই গোঙানি শুনলাম। মনে হল, যাক বেঁচে যাবে।’’ ঋত্বিক চট্টোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করলেও তা তিনি বুঝতে পারছেন না। অসংলগ্ন উত্তর আসছে। তাঁর শটটাই তো এক্সস্ট্রা কভার দিয়ে উঠেছিল আকাশে। ‘‘তার আগের ম্যাচে আমারও ও রকম লেগেছিল, জানেন। ফিল্ডিংয়ে তা হলে কোথায় দাঁড়াব...।’’

সৌরভ মণ্ডল জানেন না, জীবনটা এর পর তাঁর কাছে কী দাঁড়াবে। তাঁকে কোচ, সতীর্থরা ক্রমাগত বুঝিয়েছেন যে এটা দুর্ঘটনা। এটা তুই ইচ্ছে করে করিসনি। শুনে সৌরভের মুখ থেকে নাকি একটাই উত্তর বেরিয়েছে, ‘‘এটা আমি কী করে ফেললাম।’’ একটা কথাই সৌরভ এখন বুঝতে পারছেন। কোচ তাঁকে ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। আর ফোনটা বন্ধ রাখতে বলেছেন।

কী করা যাবে? মনের কাছে মস্তিষ্ক এখন হেরে যাচ্ছে। যুক্তি, বোধ সব লোপ পেয়ে বঙ্গের ক্রিকেট-জীবন এখন নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে শুক্রবার দুপুরের সল্টলেক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে। একটা ইস্টবেঙ্গল-ভবানীপুর সিএবি ম্যাচে। দুপুর একটার আশেপাশে একটা সময়সীমায়।

যখন আদরের অঙ্কিত পরিবর্ত হিসেবে শুধু চারটে বলের জন্য নেমেছিল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE