Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বোর্দোর যুদ্ধই আসল, এটাই ইউরো ফাইনাল

মিরোস্লাভ ক্লোজে কিছু একটা আঁচ করেছেন বোধহয়। ব্রাজিল বিশ্বকাপের পর জোয়াকিম লো-র টিমের সঙ্গে ‘মিরো দ্য ম্যাজিকে’র যে মারাত্মক যোগাযোগ আছে, বলাটা অমার্জনীয় অপরাধ হবে।

জার্মানির বিরুদ্ধে নামার আগে ইতালির অনুশীলন। ছবি: এএফপি।

জার্মানির বিরুদ্ধে নামার আগে ইতালির অনুশীলন। ছবি: এএফপি।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
প্যারিস শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৬ ০৪:১০
Share: Save:

মিরোস্লাভ ক্লোজে কিছু একটা আঁচ করেছেন বোধহয়। ব্রাজিল বিশ্বকাপের পর জোয়াকিম লো-র টিমের সঙ্গে ‘মিরো দ্য ম্যাজিকে’র যে মারাত্মক যোগাযোগ আছে, বলাটা অমার্জনীয় অপরাধ হবে। জার্মান কোচ কোনও দিন উপদেশ নিতে ছোটেননি, সংশয়ে পড়লে ফোন করে জিজ্ঞেস করেননি, ‘‘আচ্ছা মিরো, এটা নিয়ে তোমার কী মনে হয়?’’ দূরত্ব বুঝতে পেরে ক্লোজেও সরে এসেছেন, তুলে দিয়েছেন অদৃশ্য বার্লিন দেওয়াল। ফোন অনেক বড় ব্যাপার। বাস্তিয়ান সোয়াইনস্টাইগার, স্যামি খেদিরাদের সঙ্গে এখন আর মেসেজেও কথাবার্তা হয় না মিরোর।

তবু, মিরোস্লাভ ক্লোজের পক্ষে আজ আর চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। জাত্যভিমান বিপন্ন যেখানে, ছুটকো মান-অভিমানের মূল্য তার পাশে কতটুকু? আসলে মারিও গোমেজের পেনাল্টি বক্সে পড়ে থাকা, ওটুকু জায়গাতেই ঘুরঘুর করা, একদম ভাল লাগছে না মিরোর। বুঝতে পারছেন, জার্মান স্ট্রাইকারকে গিলে ফেলাটা কোনও এক জিওর্জিও কিয়েলিনির কাছে দেড় মিনিটের কাজ হবে! নিজে খেলেছেন, কিয়েলিনি কী বস্তু, জানেন মিরো। তার পরেও ফোন-এসএমএস কিচ্ছু করেননি। মিডিয়া জিনিসটা যত দিন পৃথিবীতে আছে, দরকার তো নেই ও সবের। যা বার্তা দেওয়ার মিডিয়াতে দেওয়া যায়। বলে রাখা যায়, ওহে গোমেজ, পেনাল্টি বক্সে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। বাইরে থাকো। বল নিয়ে বক্সে ঢোকো। রেফারি যাতে তোমাকে ফলো করে উঠে দেখতে পায়, ইতালি ডিফেন্ডার কিয়েলিনি কী করছে না করছে। বক্সে ইতালীয় ডিফেন্ডারের একটু বদভ্যাস আছে প্রতিপক্ষ স্ট্রাইকারদের টেনে ধরার। রেফারিকে সেটা বুঝতে দিতে হবে তো!

“জার্মানিকে ভাবতে হবে, আমরা পারি। এখনই পারি ইতালিকে হারাতে। এই পজিটিভ ভাবনা-চিন্তা শুধু দরকার। তা হলে আর অসুবিধে হওয়ার কথা নয়,” এ দিন এক সাক্ষাৎকারে বলে ফেলেছেন ক্লোজে। এক দিক থেকে ভাবলে, সত্যিই অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। লো-র টিম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, ছেড়ে দেওয়া যাক। তাঁর মতো ফুটবল-বোধ, তুখোড় মস্তিষ্ক, এত রত্নখচিত মিডফিল্ড ইউরোর আর কোন টিমে আছে? এর পর আত্মবিশ্বাস জার্মানরা দেখাবে না তো কারা দেখাবে? ইতালি-জার্মানির প্লেয়ার ধরে-ধরে মেলানো হোক। প্রত্যেকের গুণগত মান বিচার করা হোক। দেখা যাক, কে জেতে। একটা সোয়াইনস্টাইগার আছে ইতালিতে? আছে একটা টনি ক্রুজ? আছে একসঙ্গে এত গেমচেঞ্জার?

পাস, পাস, পাস— বিশ্ব ফুটবলে ভিসেন্তে দেল বস্কির স্পেনের যা এত দিন সেফ ডিপোজিট ভল্ট ছিল, তার অনেকটাই ভেঙে ফেলেছে ‘ইয়োগি’ লো-র জার্মানি। পাওয়ার ফুটবল জার্মানদের চিরকালীন ঐতিহ্য। রুডি ফোলাররা খেলে গিয়েছেন, আজও টমাস মুলাররা খেলেন। কিন্তু তার সঙ্গে পাসিং ফুটবলের অপরূপ সৃষ্টিশীলতাও এখন মিশে থাকে। য়ুরগেন ক্লিন্সম্যানের ভাবশিষ্যের হাতে পড়ে জার্মান ফুটবল পাল্টে গিয়েছে অনেক। নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক ফুটবল আর খেলে না জার্মানি। আন্তোনিও কন্তের হাত ধরে ইতালীয় ফুটবলের পুনর্জাগরণ, ডিফেন্সসর্বস্ব কাতানেচ্চিও ছকের অপবাদ ছুড়ে ফেলে ইউরোয় হিংস্র আক্রমণে দে’রোসিদের উঠে আসা, বারবার ফর্মেশন পাল্টানো, যুদ্ধের আগে ‘আমরা তো হেরেই গিয়েছি’ গোছের বিভ্রান্তিকর প্রচেষ্টা আমদানি পৃথিবীর প্রত্যেক ফুটবল-দর্শককে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে ছেড়েছে, নিঃসন্দেহে। কিন্তু ইতালি তার পরেও জার্মানি নয়।

ইউরোয় লো-র যন্ত্রণা দু’টো। ক্লোজে অবসর নেওয়ার পর শত্রুপক্ষের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার মতো কোনও স্ট্রাইকার আজও তাঁর নেই। মারিও গটজে নিয়ে আশা ছিল, কিন্তু চলতি মরসুমটাই তাঁর অবিশ্বাস্য খারাপ যাচ্ছে। তা ছাড়া, ক্ষিপ্রতা বা ক্ষমতায় গোমেজকে ক্লোজে ভাবা যাবে না নিশ্চয়ই। দ্বিতীয় যন্ত্রণা— টমাস মুলার। বিশ্বকাপে বরাবরের দুর্দান্ত। অথচ ইউরোয় আজ পর্যন্ত একটা গোল নেই! সমস্যা কন্তেরও আছে। দে’রোসি শনিবার চোটের জন্য খেলবেন না। থিয়াগো মোতাকে কার্ড ছিটকে দিয়েছে। এত দুর্দমনীয় জার্মান মিডফিল্ড একটা জুভেন্তাস ‘বিবিসি’ ভাঙতে পারবে না? পারবে না একটা ‘বোনুচ্চি-বারজাগলি-কিয়েলিনি’ প্রতিরোধ ধুলোয় মিশিয়ে চলে যেতে?

পারা উচিত, কিন্তু জার্মান কোচ ‘পারব’ বলতে পারছেন না। বরং কেমন যেন একটু কুঁকড়ে তিনি, গলায় সন্দেহ। “জেতার কোনও গ্যারান্টি আছে? একটা ছোট্ট ভুল সব শেষ করে দিতে পারে,” যথেষ্ট আশঙ্কায় বিশ্বজয়ী কোচ। দোষও দেওয়া যায় না। মারিও বালোতেলি নামটা আজও ঘুমোতে দেয় না লো-কে। মনে পড়িয়ে দেয় চার বছর আগের ওয়ারশ ইউরো সেমিফাইনাল। যে দিন ইতালিকে কেউ ধরেনি। বালোতেলিকে মহানায়ক হিসেবে কল্পনা করেনি কেউ। পরে শুধু দেখেছিল, জোড়া গোল করে ইতালীয় স্ট্রাইকারের জার্সি খুলে উল্লাস। কালান্তক ইতিহাস ভোলেননি লো, বালোতেলি তাঁকে ভুলতে দেন না।

ইতিহাস!

ইউরো কেন, বিশ্বের যাবতীয় ফুটবল-বিশেষজ্ঞ বলে দিচ্ছেন, শনিবার বোর্দোয় জার্মানি-ইতালি কোয়ার্টার ফাইনালের যুদ্ধটাই আসল, এটাই ইউরো ফাইনাল। যে জিতবে, সম্ভবত তারাই চ্যাম্পিয়ন। গবেষণা টেবিলেও ধুন্ধুমার। প্রাক্তন রিয়াল মাদ্রিদ কোচ কার্লো আন্সেলোত্তিকে আবিষ্কার করা গেল যিনি বলেছেন, ‘‘জার্মানিকে এত খোঁচাখুচি করলে কপালে দুঃখ আছে!’’ যার পাল্টা দিতে কেউ কেউ তুলে আনছেন ইতিহাসের পাতা— দেখো, কোথায় জার্মানি? বড় টুর্নামেন্টে ইতালির সঙ্গে যখনই তাদের দেখা হয়েছে, স্রেফ উড়ে গিয়েছে! ইতালির অলিম্পিক্স কমিটির প্রেসিডেন্ট জিওভানি মালাগো শুনিয়ে রেখেছেন, ‘‘জার্মানরা তো আগেভাগে কেঁপে আছে! ওরা জিতবে কী!’’ এমনকী জার্মান ফুটবল ফেডারেশনের এক স্পোর্টস সাইকোলজিস্ট বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ইতিহাস নিয়ে ভাবলে ডুবে যেতে হবে।

জার্মান টিম যদিও ‘ইতিহাস’ শব্দটা শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছে। টনি ক্রুজ যেমন। রিয়াল মিডফিল্ডারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ইতিহাস ঠিক বলছে কি না। ইতালি জার্মানির কাছে মারণ টিম হয়ে উঠছে কি না। শুনে ক্রুজ ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, “কী বলতে চাইছেন? আর আমি সে ভাবে ইতালি ম্যাচ খেলিনি। আমার কাছে কীসের ইতিহাস?” ক্রুজ এর পরেও থামেননি। শুনিয়ে রেখেছেন যে, ইতালিকে তিনি সম্মান করেন। কিন্তু জার্মানরা পুরনো কথা ভেবে আতঙ্কিত, কে বলল?

ইতালির বিখ্যাত কাগজ ‘লা গেজেত্তা দেলো স্পোর্ট’ দেখা গেল, জার্মানি-ইতালি ম্যাচ নিয়ে আলাদা একটা সেকশন করেছে। অনলাইন সংস্করণে ভিডিও দিয়ে তারা বোঝাচ্ছে, কোন যুক্তিতে এগিয়ে ইতালি। বলা হচ্ছে, দু’জন প্লেয়ার বেরিয়ে যাওয়ায় চুপচাপ আছেন কন্তে। গবেষণাগার থেকে নিশ্চয়ই জার্মান-বধের ওষুধ বার করছেন! উত্তরে জার্মানির ‘বিল্ড’ও এক বিশেষজ্ঞ ধরেছে। যিনি কন্তের ওই ‘মারণ’ দাওয়াই ব্ল্যাকবোর্ডে এঁকে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। অর্থাৎ, শুধু ফুটবল-বিশ্ব নয়। বোর্দো যুদ্ধ ঘিরে হানাহানিতে নেমে পড়েছে মিডিয়াও।

হোক না, চলুক না। সত্তর বিশ্বকাপের সময় ফুটবল নিয়ে জার্মানরা মজার একটা শব্দ চালু করেছিল— ‘শোয়াফোগেনফুসবল’। ইংরেজিতে দাঁড়ায়, ‘স্লিপিং কার ফুটবল’। ফ্রান্স ইউরো তো সে দিকেই হাঁটছে। ইব্রাহিমোভিচ বিদায় নিয়েছেন। ওয়েন রুনি দেশে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো থেকেও মাঠে অদৃশ্য। শনিবার রাত অন্তত একটু অন্য রকম হোক। শনিবার রাতে সব কিছু একটু অন্য ভাবে চলুক।

ইউরো ফাইনালে ‘শোয়াফোগেনফুসবল’ আর কে চায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bordeaux
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE